অভিমত
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা ও তরুণদের চাকরি

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমার কয়েকজন সহপাঠীকে দেখতাম, সকাল ৮টা বা ৯টার ক্লাস তাঁরা কখনই করতে পারতেন না। তাই উপস্থিতি কম থাকায় পরীক্ষার ফরম পূরণ করতে গিয়ে তাঁদের গুনতে হতো বাড়তি টাকা।
তাঁদের কয়েকজনকে কর্মজীবনে এসে দেখছি ভিন্নভাবে। তাঁরাই সকাল ৮টার সময় নিয়মিত অফিসে যাচ্ছেন। একদিনও দেরি হচ্ছে না। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত করতে হচ্ছে কাজ। কষ্টের এই চাকরি পেতেও অনেক ভোগান্তি পেতে হয়েছে। তবু তাঁরা চাকরি পেয়ে মহা খুশি।
প্রতিবছর দেশের পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজার হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছেন। এ ছাড়া মেডিকেল কলেজ ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিভিন্ন কলেজও রয়েছে। সেগুলোতে উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হচ্ছেন আরো অনেক শিক্ষার্থী।
উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির সুযোগ পাওয়াটা শিক্ষার্থীদের জন্য একটি আনন্দের বিষয়ও বটে। কারণ, বিশাল এক ভর্তিযুদ্ধ শেষে অনেক প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে ওই শিক্ষার্থীকে নিজের জায়গা করে নিতে হয়। নিশ্চয় মেধাবী ছাড়া সেই সুযোগ কেউ পান না। কিন্তু দেশের সেরা পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়ার পরও চাকরি পাচ্ছেন না এমন তরুণ আমাদের দেশে অনেক।
সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট রিসার্চের (সিডার) ‘কর্মসংস্থান ও শ্রমবাজার পর্যালোচনা, ২০১৭’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি।’
ওই প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়, ‘দেশের ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী প্রায় ২৫ শতাংশ তরুণ নিষ্ক্রিয়। তাঁরা কর্মবাজারে নেই, শিক্ষায় নেই, প্রশিক্ষণও নিচ্ছেন না। এঁদের সংখ্যা প্রায় এক কোটি ১০ লাখ।’
এই পরিসংখ্যান আমাদের জন্য শঙ্কারই বটে। পরিসংখ্যান সব সময় নির্ভুল হয় না। কিন্তু কাছাকাছি একটা তথ্য পাওয়া যায় সেখান থেকে। মানতেই হবে দেশের উচ্চশিক্ষা পাওয়া অনেক তরুণ এখন সমাজের কাছে ‘বোঝা’। তাই এখন বড় একটি প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, তাহলে কি তরুণরা ভালো করে শিক্ষা নিচ্ছেন না? বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে শিক্ষা দিতে পারছে না?
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি গণমাধ্যমে কাজ করার সুবাদে ওই বিদ্যাপীঠের অনেক বিভাগের পাঠ্যসূচি নিয়ে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, সামাজিক বিজ্ঞান ও কলাসহ কয়েকটি অনুষদের বেশকিছু বিভাগের বহু পুরোনো বিষয় শিক্ষা দেওয়া হয়। যার সঙ্গে এখনকার কোনো সম্পর্ক নেই। তাই ওসব শিখে কর্মজীবনে শিক্ষার্থীরা কিছুই করতে পারছেন না। শুধু তাই নায়, ওই শিক্ষায় শিক্ষার্থীরা নিজেদের যে গঠন করতে পারছেন সেটাও বলা যায় না। অনেকেই হয়তো নিজের যোগ্যতায় কিছু করছেন। তবে সেই চিত্রটি একেবারেই ভিন্ন।
চাকরির পরামর্শ দেওয়ার জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে উঠেছে তিনটি কোচিং সেন্টার। এই কোচিং সেন্টার দেশের অনেক জায়গাতেই রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা কতটা অনুপযোগী হয়ে পড়েছে এই কোচিং তার বড় উদাহরণ হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুমগুলোতেও এখন পাঠ্যবই না পড়ে শিক্ষার্থীরা চাকরির বিভিন্ন বই পড়ছেন বলে একাধিক সময় অভিযোগ করেছেন শিক্ষকরা। তাই উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে বৈকি।
এই অবস্থা এক দিনে সৃষ্টি হয়নি। আমাদের দেশের চাকরির বাজার ও শিক্ষাব্যবস্থার মাঝে দূরত্বই তরুণদের ওই দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তাই উচ্চ শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে ভাবার সুযোগ এসেছে। কিন্তু সামান্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যবই যে দেশে নির্ভুল ছাপা ও একটি মানদণ্ডে নিয়ে আসা যায় না, সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা পাল্টাবে কী করে। তাই যুগ যুগ ধরে পুরোনো বিষয় শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনেক বিভাগেই। আবার কিছু কিছু বিভাগ অনেক ভালো করছে সেটাও মানতে হবে।
দেশের দুজন শিক্ষাবিদ ও গবেষকের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। তাঁদের মতে, বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মজীবনে প্রবেশের সুযোগ করে দিতে পারে এমন শিক্ষা এবং গবেষণাধর্মী শিক্ষার পাশাপাশি আরো অনেক ধরনের শিক্ষা হতে পারে সেখানে। গবেষণাধর্মী শিক্ষা গ্রহণকারীরা নিজেদের শিক্ষাপেশায় নিয়োগ করতে পারেন। আর অন্য শিক্ষা নেওয়া শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপেশার বাইরে গিয়ে কাজ করবেন। তবে শিক্ষাকে অবশ্যই যুগের সঙ্গে সামঞ্জস্য করে গড়ে তুলতে হবে।
এই পদ্ধতি কতটা কাজে লাগবে তা বলতে পারছি না, কিন্তু আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই হয়তো চলমান শিক্ষা কাঠামো পরিবর্তন করতে চাইবেন না। কারণ, এটা করলে তাঁরাই যে অকেজো হয়ে যাবেন! সেই ভয় অনেক শিক্ষকেরই হয়তো রয়েছে। তাই সরকার এ বিষয়ে উদ্যোগ নিলেও প্রথম বাধা দেবেন শিক্ষকরাই।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বিভাগেই দেখেছি, শিক্ষার্থীদের টাকায় শিক্ষকরা একটি গবেষণা পত্রিকা (সেখানে কি গবেষণা হয় সেটা নিয়ে প্রশ্ন আছে) বের করেন। কিন্তু তার কোনো ক্রেতা না থাকায় উল্টো শিক্ষার্থীদেরই বাধ্য করা হয় ওই পত্রিকাটি কিনতে। বিষয়গুলো নিয়ে কোনো শিক্ষার্থী প্রতিবাদ করতে পারেন না। কারণ, পরীক্ষায় নম্বর কমিয়ে দেওয়ার ভয় শিক্ষকরা সব সময় দিয়ে থাকেন। একবেলা না খেয়ে সেই পত্রিকার টাকার সংগ্রহ করলেও শিক্ষার্থীরা তার প্রতিবাদ করবেন না। তাঁদের যে একটা সনদপত্র দরকার। যা দিয়ে জীবিকা পাওয়া যাবে! কিন্তু সেই অকেজো সনদও যে কর্মজীবনে কাজে আসে না, তা হয়তো ওই শিক্ষার্থীরা বোঝেন একটু দেরিতে।
তবে আমাদের দেশেই যে শুধু বেকার আছে, বিষয়টি এমন নয়। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতেও বেকারত্বের সংখ্যা কম নয়। যুক্তরাজ্যের মতো দেশে এখন বেকার মানুষের সংখ্যা প্রায় ১৬ লাখ, এমন তথ্য যুক্তরাজ্যের অফিস ফর দ্য ন্যাশনাল স্টাটিসটিকস (ওএনএস)-এর। একই চিত্র বিশ্বের অন্য দেশেও। তবে তাদের দেশের মোট জনগণের চেয়ে বেকারের সংখ্যাটা হয়তো অনেক কম।
তাই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কিছু ব্যক্তির ‘জীবিকা’ নির্বাহের হাতিয়ার না করে সেগুলো নিয়ে প্রথমে শিক্ষকদেরই ভাবতে হবে। দেশের বর্তমান ‘বেকার সংকট’ নিয়ে সরকারকে পরামর্শ দিতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরই। শুধু তাই নয়, নির্দিষ্ট এলাকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ওই এলাকার নানা সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে কাজ করতে হবে। এরপর সরকারের কাছে একটি পরামর্শ তুলে দিতে হবে। তবেই হয়তো একদিন দেশ থেকে ‘বেকার সংকট’ কমে যাবে। আমাদের সোনার বাংলাদেশের তরুণরা সত্যিই একদিন দেশের জন্য একেকটি স্বর্ণ হয়ে উঠবেন।
লেখক : সাংবাদিক