মেয়র নির্বাচন
নারায়ণগঞ্জ নিয়ে আমাদের প্রত্যাশা

আগামীকাল অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এ নিয়ে রাজনীতির মাঠে রয়েছে যথেষ্ট উত্তাপ-উত্তেজনা। নির্বাচনটি স্থানীয় নির্বাচন হলেও বাস্তবিকক্ষেত্রে জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে এর বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। এর আগে অন্যান্য স্থানীয় ক্ষেত্রে হলেও নারায়ণগঞ্জে এই প্রথমবার সরাসরি দলীয় প্রতীকে সিটি করপোরেশন নির্বাচন হচ্ছে। উল্লেখ্য, ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জে দলীয় প্রতীকে না হলেও দলীয়ভাবেই সিটি নির্বাচন হয়েছিল। জাতীয় রাজনীতির সাংগঠনিক তৎপরতা এবং সরকার ও নির্বাচন কমিশনের ভাবমূর্তির মাপকাঠি নির্ধারণে আগামীকালের নির্বাচনটির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। বিশেষ করে নির্বাচন কমিশনের শেষ সময়ে এসে এই নির্বাচনটি সুষ্ঠু হবে কি না, তা নিয়েও রয়েছে এক ধরনের চ্যালেঞ্জ ও শঙ্কা। তবে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে ২০১১ সালের নির্বাচনে যে পরিমাণ টানটান উত্তেজনা কাজ করেছিল তেমন উত্তেজনা এবার লক্ষ করা না গেলেও নির্বাচন কেমন হবে এ নিয়ে শঙ্কা ও সম্ভাবনার মাঝামাঝি একটি অবস্থান লক্ষ করা যাচ্ছে।
ইতিমধ্যেই পুলিশের পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলার বিষয়ে সর্বোচ্চ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও নির্বাচনী আচরণবিধি পর্যবেক্ষণে ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভ্রাম্যমাণ আদালত কাজ করবে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক।
আমরা জানি, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলই প্রার্থী নির্বাচনে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে। বিভিন্ন কারণেই নাগরিকদের ভোট দিতে যাওয়ার বিষয়ে যথেষ্ট স্বস্তিভাব দেখা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের ‘নৌকা’ প্রতীক নিয়ে ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী এবং বিএনপির ‘ধানের শীষ’ প্রতীকের প্রার্থী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান লড়াইয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন। নানা মান-অভিমানের পরও দলের প্রধান শেখ হাসিনার নির্দেশ মান্য করেই আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমান আইভীর পক্ষে আনুষ্ঠানিক সমর্থন দিয়েছেন। আওয়ামী লীগে অভ্যন্তরীণ বিভক্তি কোন্দল থাকলেও দৃশ্যত তা বোঝা যাচ্ছে না। অন্যদিকে বিএনপি প্রার্থীর ক্ষেত্রে কেন্দ্র থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা অব্যাহত রয়েছে।
নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া, না হওয়া, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো থাকা, না থাকা প্রভৃতি বিষয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মত-দ্বিমত রয়েছে। নানা বিবেচনায় নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনটি উভয় দলের জন্য একটি অগ্নি পরীক্ষা। শুধু তাই নয় নির্বাচন কমিশনও এক ধরনের পরীক্ষার মধ্যে রয়েছে। আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হতে যাচ্ছে বিধায় শেষ সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক ভাবমূর্তি রক্ষা ও নিজেদের যথার্থতা প্রমাণ করার মাধ্যমেই একটি ন্যায্য সমাপ্তি কমিশনের নিকট প্রত্যাশিত। এরইমধ্যে জোরেসোরে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে বৈঠকে মিলিত হচ্ছেন। তা ছাড়া সিটি করপোরেশন নির্বাচন ও জেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে সারা দেশে একটি রমরমা নির্বাচনী উৎসব বিরাজ করছে।
এর আগে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন সারা দেশে একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। তার আগে ২৩ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু করতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দিন আহমদকে নির্দেশ দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করতে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নিতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। কারণ এই সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠানের স্বচ্ছ প্রক্রিয়া মানুষকে আরো অনেক বেশি গণতান্ত্রিক ও নির্বাচনমুখখী আচরণে উদ্বুদ্ধ করবে। কাজেই আগামীকালের নির্বাচনে জনগণের ভোট এমনভাবে নিশ্চিত করতে হবে যেন তারা যোগ্য প্রার্থীকে স্বাধীনভাবে বেছে নিতে পারে।
বিএনপির বর্তমান অবস্থায় নির্বাচনে জয়লাভের কোনো বিকল্প নেই। আইভী ও শামীম ওসমানের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং বিএনপির রাজনৈতিক সংকট মিলিয়ে এই কঠিন পরীক্ষায় কে উত্তীর্ণ হতে যাচ্ছেন তা নিশ্চিত করে কোনোভাবেই বলা যাচ্ছে না। তবে বিএনপির পক্ষ থেকে নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে যেসব অভিযোগ তৈরি করা হচ্ছে সেগুলো বিরোধী রাজনৈতিক অবস্থানে থেকে উত্থাপন করাটা অযৌক্তিক কিছু নয়। কারণ সরকারি দল সবসময়ই স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে একটি বিশেষ সমর্থন পায়। সে হিসাব অনুযায়ী আওয়ামী লীগের প্রার্থীর ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম নেই। তবে নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ বিভক্তি বিচারে সরকারি সমর্থনের বিষয়টি একটি বিশেষ অবস্থানে রয়েছে।
সবার মনে এখন একটাই জিজ্ঞাসা, ২০১১ সালের মতো নির্বাচনের আগমুহুর্তে কিংবা নির্বাচন চলাকালীন নির্বাচন বর্জন কিংবা নির্বাচন থেকে সরে আসার মতো আত্মঘাতী ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না তো! যদিও এই মুহূর্তে খুব যুক্তিসঙ্গতভাবেই বিএনপিকে নির্বাচনী চ্যালেঞ্জ নিয়ে নির্বাচনী মাঠে টিকে থাকতে হবে। নির্বাচন বর্জনের ঘোষণার মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেশবাসী দেখতে চায় না। বিশেষ করে বিএনপির কর্মী-সমর্থকরা এমনটি চায় না। ২০১১ সালের নারায়ণগঞ্জের সিটি নির্বাচন থেকে তৈমূর আলম খন্দকারের কাঁদতে কাঁদতে সরে যাওয়ার ঘোষণার কথা কেউই ভুলে যাননি। কাজেই এমন পুনরাবৃত্তি নিয়ে সবারই দ্বিধা রয়েছে। স্থানীয় নির্বাচনের মাধ্যমে যথাযথ নির্বাচনী সংস্কৃতি বজায়ের যথার্থ চর্চা অব্যাহত রাখার বিকল্প নেই।
একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক চর্চা এবং নির্বাচন পদ্ধতির ওপর নাগরিকদের স্থায়ী আস্থা সৃষ্টির লক্ষ্যে স্বচ্ছ নির্বাচন ব্যবস্থাই এখন সবার প্রত্যাশা। আমাদের দেশে একসময় নির্বাচনে ভোট ডাকাতি, বুথ দখল ও সিল মারার গণতন্ত্র ছিল। আজ সেই অধ্যায় নেই। এখন গণমাধ্যমের প্রভাবে কারো পক্ষেই ওই রকম জোরজবরদস্তি করে নির্বাচনে জয়ী হওয়া সম্ভব নয়। বিএনপি তো সংসদেও নেই, রাজপথেও সক্রিয় নেই। বর্তমান চলমান রাজনীতির ধারায়, আগামীকালের সিটি করপোরেশন নির্বাচন তাদের জন্য বড় একটি চ্যালেঞ্জ। সঙ্গত কারণেই সরকারের সামনে অনেক কিছুই এখন পরিষ্কার। কিন্তু বিএনপির সামনে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এখন অন্ধকার। কাজেই বিএনপির রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের অদৃশ্য বিভক্তি, নির্বাচন কমিশনের শেষ সময় ও কমিশনের পুনর্গঠন প্রভৃতি বিষয়কে সামনে রেখে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন জাতীয় রাজনীতির বেড়াজাল থেকে কোনোভাবেই মুক্ত নয়। অতএব এই নির্বাচনটি কেমন হচ্ছে তার ওপরই নির্ভর করছে ভবিষ্যৎ রাজনীতির গতিপথ।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।