রোজায় স্বাস্থ্য
রোজায় ডায়াবেটিক রোগীদের করণীয়

পবিত্র রমজান মাস চলছে। ছোট-বড় অনেকেই রোজা রাখছেন। সুস্থ লোকের পাশাপাশি অনেক অসুস্থ বা দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত মানুষও রোজা রাখেন।
ডায়াবেটিসে যাঁরা ভুগছেন, তাঁরাও রোজা রেখে থাকেন। সুষ্ঠুভাবে রোজা পালন করার জন্য ডায়াবেটিক রোগীদের অনেক নিয়ম মেনে চলতে হয়। রোজা রাখার ক্ষেত্রে তাঁদের কিছু বিষয় খেয়াল করতে হয়।
হাইপোগ্লাইসেমিয়া বা রক্তে গ্লুকোজ যাতে কমে না যায়। হাইপারগ্লাইসেমিয়া বা রক্তে গ্লুকোজ অতিরিক্ত বেড়ে না যায়। রোগী দেহে যেন পানিশূন্যতা বা ইলেকট্রোলাইটস ভারসাম্যহীন না হয়।
এ ছাড়া সার্বিকভাবে যেন একজন ডায়াবেটিক রোগী রোজা রাখতে পারে, সে জন্য সে রকম ব্যবস্থা নিতে হবে। ডাক্তারের চেকআপ করা খুবই জরুরি। বিশেষ করে এইচবিএওয়ানসি, রক্তের হিমোগ্লোবিন, লিপিড প্রোফাইল সিরাম ক্রিয়েটিনিন ও সিরাম ইলেকট্রোলাইটস চেক করে ওষুধ বা ইনসুলিনের ডোজ ঠিক করে নেওয়া উচিত। বিশেষ করে অনেক ডায়াবেটিক রোগীদেরই উচ্চ রক্তচাপ বা হার্টের সমস্যা থাকে। তাই প্রয়োজনে অন্য পরামর্শগুলো নেওয়া জরুরি।
হাইপো হওয়ার সতর্কতা
ডায়াবেটিক অনেক রোগীকেই দেখা যায়, রোজা রাখার কারণে রক্তের গ্লুকোজ অনেক কমে গিয়ে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হতে। এটি খুবই বিপজ্জনক। তাই এই হাইপো যাতে না হয়, সে জন্য রোগীকে নিয়মিত রক্তের সুগার চেক করতে হবে।
ওষুধ বা ইনসুলিনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। হাঁটা বা ব্যায়াম সতর্কতার সঙ্গে করতে হবে। এ ছাড়া খাবারে জটিল কার্বোহাইড্রেট ও প্রোটিনযুক্ত খাবার সঠিক মাত্রায় গ্রহণ করতে হবে। ইফতারে তাজা ফলের জুস, ডাবের পানি, টক দইয়ের লাচ্ছি তরল হিসেবে খাওয়া যেতে পারে। মিক্স ফ্রুটস, কলা, খেজুর হাইপো প্রতিরোধে অনেক উপকারী। এ ছাড়া যাঁরা অনেক ডোজ ইনসুলিন নেন, তাঁরা চাইলে ইফতারে ফলের জুসের সঙ্গে ভাত (পরিমিত), মাছ বা মুরগি ও সবজি খেতে পারেন। সে ক্ষেত্রে রাতের খাবার হালকা কিছু হলেই চলে। আবার রোজা রেখে সারা দিন যাতে হাইপো না হয়, সে জন্য সেহরি একটু দেরি করে করলে ভালো। সেহরি খাওয়ার পর একটি বা দুটি খেজুর ও এক কাপ ননিহীন দুধ খেলে অনেক উপকারে আসে।
হাইপারগ্লাইসেমিয়া
রক্তে শর্করা বা গ্লুকোজ বেড়ে যাওয়া। অনেক সময় অতিরিক্ত ইফতার বা খাদ্য গ্রহণ ভুলে ওষুধ বা ইনসুলিন না নেওয়া, অতিরিক্ত মিষ্টি, আম, কার্বোহাইড্রেটযুক্ত খাদ্য খেয়ে ফেলা ইত্যাদি কারণে রক্তে গ্লুকোজ অনেক বেড়ে হাইপারগ্লাইসেমিয়া হতে পারে। এ থেকে নানা সমস্যা হতে পারে। তাই এ অবস্থা প্রতিরোধে সঠিক মাত্রার ওষুধ বা ইনসুলিন গ্রহণ পরিমিত খাদ্য গ্রহণ, সময় অনুসারে, অর্থাৎ সঠিক সময়ে ইফতার, সেহরি ও রাতের খাবার গ্রহণ করলে এই সমস্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব।
যাঁদের রক্তের সুগার বেশি বেড়ে যায়, তাঁরা ফলের জুসের বদলে তরল হিসেবে ইসুবগুল বা তোকমার শরবত, লেবু পানি, ডাবের পানি, টক দইের মাঠা খেতে পারেন। মিষ্টিজাতীয় ফল যেমন আম, কলা সাবধানে গ্রহণ করতে হবে। রাতের খাবারে ওটস বা দুধ বা সাগু অথবা দুধ-রুটি, সবজি, দুধ ইত্যাদি খেতে পারেন।
নিয়মিত রক্তে শর্করা পরীক্ষা
ঘরে গ্লুকোমিটারে নিয়মিত ডায়াবেটিক রোগীদের রক্তের সুগার বা গ্লুকোজ চেক করা অতি জরুরি। বিশেষ করে ইফতারের দুই ঘণ্টা পর অথবা সেহরির আগে রক্তের গ্লুকোজ চেক করা যেতে পারে এবং রেকর্ড রাখাও অনেক জরুরি। কোনো কারণে পরীক্ষার পর গ্লুকোজ কম বা বেশি পাওয়া গেলে সেই অনুপাতে খাদ্য গ্রহণ, ইনসুলিনের ডোজ কমানো বা বাড়ানো, ওষুধের ডোজ ঠিক করা যেতে পারে। সব সময় মাথায় রাখতে হবে, কোনোভাবে যেন হাইপোগ্লাইসেমিয়া বা রক্তের সুগার কমে না যায়।
খাদ্যব্যবস্থা
সঠিক ভারসাম্যপূর্ণ স্বাস্থ্যসম্মত খাবার মেন্যুতে রাখা অনেক জরুরি। কেননা, সুস্থভাবে রোজা রাখতে হলে সঠিক পুষ্টি বজায় রাখতে হয়। কোনোভাবেই যেন ডিহাইড্রেশন না হয়, সে জন্য সঠিক মাত্রার তরল ও পানি গ্রহণ করতে হবে। ইলেকট্রোলাইটস যাতে ইমব্যালান্স না হয় সে জন্য ফল, ডাবের পানি, দুধ, খেজুর পরিমিতভাবে খেতে হবে। যাঁদের শরীরে সোডিয়াম কমে যাওয়ার ইতিহাস রয়েছে, তাঁরা অবশ্যই রোজার মাঝামাঝি সময়ে রক্তের ইলেকট্রোলাইটস চেক করতে পারেন।
ডায়াবেটিক রোগীর খাদ্যতালিকায় সঠিক পরিমাণে প্রোটিনযুক্ত খাবার থাকতে হবে। বিশেষ করে ডিম, ননিহীন দুধ, মাছ, মুরগির মাংস ইত্যাদি পরিমিত পরিমাণে তিনটি খাবারের মধ্যে ভাগ করে খেতে হবে। ডালের তৈরি পেঁয়াজু, অতিরিক্ত বেসনের খাদ্য, ছোলা, অতিরিক্ত খাওয়া যাবে না।
ছোলা খেলে পেঁয়াজু এড়িয়ে চলা ভালো। এ জাতীয় খাবার ভারসাম্যপূর্ণভাবে খেতে হবে। অতিরিক্ত ভাজাপোড়া ও ফ্যাটজাতীয় খাদ্য এড়িয়ে চলতে হবে। গ্রিল, বেকড স্টিমজাতীয় খাবার ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য উপকারী।
ক্যালরির যথাযথ বরাদ্দ অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ইফতার, সেহরি ও রাতের খাবারে যথাযথ ক্যালরির বরাদ্দ থাকতে হবে। যেন কোনো বেলায় অতিরিক্ত ক্যালরি গ্রহণ করা না হয়। রোজার সময় ডায়াবেটিক রোগীদের হাঁটা বা ব্যায়ামের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া অনেক জরুরি।
লেখক : প্রধান পুষ্টিবিদ, অ্যাপোলো হাসপাতাল।