শিশু শুনছে না, কীভাবে বুঝবেন?

বিভিন্ন কারণে শিশু বধির হয় বা তার কানে শোনার সমস্যা হয়। বিষয়টি নিয়ে এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২৩৫২তম পর্বে কথা বলেছেন ডা. নাজমুল ইসলাম। বর্তমানে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজের নাক কান ও গলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।
প্রশ্ন : শৈশবকালীন বধিরতা কী এবং সেটি কীভাবে হচ্ছে?
উত্তর : শৈশবকালীন বধিরতা শিরোনাম থেকে আমরা এটুকু বুঝতে পারি, এটি ছোট বয়সে, শিশুকালে হবে। জন্মের পর থেকে এক দুই তিন বছর থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত শৈশবের যে সময়টা, এই সময়ে বাচ্চারা নানা কারণে কম শোনে। এই কম শুনবার কিছু বিষয় একেবারই জন্মগত। মায়ের গর্ভ থেকেই বাচ্চা বিষয়টি নিয়ে আসে।
আর কিছু কারণ পৃথিবীতে আসবার পর আমাদের বুঝতে না পারা, অবহেলা, যথাসময়ে ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে, সমস্যা ঘটতে পারে।
মায়ের পেটে যখন শিশু বড় হতে থাকে, তখন যদি উচ্চ শব্দে তাকে রাখা হয়, মা যদি উচ্চ শব্দে গান শোনেন অথবা তার, চারপাশের যে পরিবেশ সেখানে যদি উচ্চ শব্দ তৈরি হয়, সেটি বাচ্চার শ্রবণ ক্ষমতার ওপর প্রভাব ফেলে। অন্যদিকে গর্ভকালে মায়ের ভাইরাসজনিত কিছু রোগ আছে, সেই সব রোগ মামস, মিজেলস, রুবেলা –এই জাতীয় ঘাতক ভাইরাস দিয়ে যদি মা আক্রান্ত হন, তাহলে সেই সব শিশুর গর্ভাবস্থায় শুনবার ক্ষমতা যেখান থেকে তৈরি হয়, সেই জায়গাটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে তারা শ্রবণ প্রতিবন্ধী হিসেবে পৃথিবীতে আসে।
অন্যদিকে শিশুর জন্মের পর এক থেকে তিন বছর সময়ের মধ্যে ঊর্ধ্বশ্বাসনালিতে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা হতে পারে। সেই সংক্রমণ থেকে কোনো কোনো বাচ্চার পর্দার পেছনে পানি জমে যায়। কখনো কখনো কানে তীব্র প্রদাহ হয়। সেই তীব্র প্রদাহের ফলে কানে পুঁজ তৈরি হয়। কানের পর্দা ছিদ্র হয়ে যায়। এভাবে করে বাচ্চা বধির হয়ে যেতে পারে।
এ ছাড়া অন্যন্য কিছু রোগ আছে, যেগুলো থাকার কারণে কানে শুনবার অসুবিধা হতে পারে। বাচ্চাদের টনসিল আছে, এডিনয়েড আছে। এডিনয়েডের কারণে মধ্যকর্ণে তরল পর্দাথ কমে যেতে পারে এবং জমে গেলে বাচ্চা কানে কম শুনতে শুরু করে। এভাবে বিভিন্ন কারণ রয়েছে আমরা একটু সচেতন হলে এগুলো নির্ণয় করতে পারি এবং ব্যবস্থা নিতে পারি।
প্রশ্ন : যখন একটি শিশু কানে কম শুনছে সে তো বলতে পারছে না। তার সমস্যা সাধারণভাবে একজন মা কীভাবে বুঝবেন?
উত্তর : আসলে মা তো সবচেয়ে কাছে থাকেন, এই বিষয়ে মায়ের ভূমিকাটাই সবচেয়ে বেশি। ধরেন, জন্মের পর তিন মাস বয়স পরে আমরা একটি ছোট বাচ্চার ক্ষেত্রে আশা করি, সে বাচ্চা একটি শব্দ শুনলে ভ্রু কুঁচকাবে। দেখল, বাচ্চাটা ভ্রু কুঁচকাচ্ছে না। একটি পাঁচ মাস বয়সী বাচ্চা আমরা আসা করব একটি শব্দ শুনলে তার চোখকে শব্দের দিকে নাড়াবে। আর একটু বড় বাচ্চা ঘাড় নাড়াবে। এইভাবে করে করে বাচ্চার বিভিন্ন বয়সে, কিছু কিছু কাজ করবে বলেই আমরা ধরে নেই। এই কাজগুলো হচ্ছে না। বাচ্চা খেলছে, মনোযোগ দিয়ে খেলছে- এক দেড় বছরের বাচ্চা- আমরা হয়তো তাকে একটা কিছু বললাম, ‘ পুতুলটা নাও, বলটা নাও’। বাচ্চা খেলেই যাচ্ছে, আমাদের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে না। তখন মাকে বা অভিভাবকদের সন্দেহ করতে হবে যে নিশ্চয়ই সে শুনতে পাচ্ছে না। আর কানে শোনার সঙ্গে কথা বলার বিষয়টি সম্পর্কিত। না শুনলে তো বলতে পারবে না। কাজেই আমাদের সবসময় সন্দেহ মাথায় রাখতে হবে।
প্রশ্ন : একটি বাচ্চা কানে শুনতে পাচ্ছে না বা শৈশবকালীন বধিরতায় সে আক্রান্ত হয়েছে, সেই ক্ষেত্রে তার করণীয় কী?
উত্তর : বধিরতা হওয়ার আগেই কিছু কিছু বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। গর্ভাবস্থায় মা যদি ভাইরাসজনিত রোগে আক্রান্ত হন, তাহলে স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। আমরা যদি গর্ভবতী মাকে মামস, মিজেসল, রুবেলা- এই ভাইরাসগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিষেধক টিকা দিয়ে দেই, আমরা যদি ম্যানিনজাইটিসের হাত থেকে বাচ্চাকে রক্ষা করতে পারি, তাহলে বাচ্চার বধির হওয়ার আশঙ্কা কমে আসে।
অন্যদিকে ছোট বাচ্চার সামান্য নাকে ঠান্ডা লেগেছে, সর্দি হচ্ছে, গলা ব্যথা হয়েছে- এমন হলে আমরা যদি চিকিৎসকের পরামর্শ নিই, চিকিৎসকের কাছে যাই এবং আমরা নাক পরিষ্কার রাখার ব্যবস্থা করি, যথাযথ চিকিৎসা দিতে পারি, তাহলে কিন্তু এই ছোট ছোটোবিষয়গুলো অল্পতেই মিটে যায়। এই বিষয়গুলো জটিলতা হিসেবে কানে পানি জমে যাওয়া, কানে সংক্রমণ হওয়া, তখন সেগুলোকে প্রতিরোধ করা যায়।
এর বাইরে আমরা যে শব্দের জগতে বাস করি, সেখানে তো প্রতিনিয়ত শব্দ দূষণ হচ্ছে, উচ্চ শব্দে হর্ন বাজছে, মাইক বাজছে। এখন যেটা হয়, ছোট বাচ্চাদের হাতে স্মার্টফোন, সেলফোন তুলে দিচ্ছি। বাচ্চারা গেম খেলছে, গান শুনছে। আমরা না জেনেই এই কাজগুলো করছি। কিন্তু এই যে উচ্চ স্বরে বাচ্চা গান শুনছে, এটি কিন্তু তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তার অন্তকর্ণে ক্ষতি করছে। তার শুনবার ক্ষমতা কমে যাচ্ছে এবং পরিণামে সে বাচ্চাটা একেবারে হয়তো শ্রবণ প্রতিবন্ধী হয়ে যাচ্ছে। সে কারণে আমরা একটু খেয়াল করে, এসব বিষয় থেকে বাচ্চাকে দূরে রাখলে বাচ্চাদের রক্ষা করতে পারি।