রোজায় শিশুর মাতৃদুগ্ধ পান

শিশুর জন্য মাতৃদুগ্ধ পান গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর বুকে দুধ আসা এবং কীভাবে শিশুকে দুধ খাওয়াবেন—এসব নিয়ে চিন্তিত থাকেন। আজ ২১ জুন, এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২০৭৩তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. সেলিনা খানম।
প্রশ্ন : নবজাতক ও শিশু—এ দুই শ্রেণির মধ্যে পার্থক্য কী এবং এদের মাতৃদুগ্ধ পানের প্রয়োজনীয়তা আসলে কী?
উত্তর : আসলে নবজাতক বলতে বোঝায় জন্মের পর থেকে এক মাস বয়স পর্যন্ত সময়কে। আর এক মাসের পর থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত যারা, তারা সবাই শিশু। তবে পাঁচ বছর পর্যন্ত তো আসলে বুকের দুধের প্রয়োজনীয়তা পড়ে না। দুই বছর পর্যন্ত যেন মায়েরা বুকের দুধ অবশ্যই বাচ্চাদের খাওয়ায়। এবং জন্মের পর থেকে নবজাতকের অবশ্যই বুকের দুধ খাওয়া উচিত, অন্য কিছুই না।
প্রশ্ন : শিশু যখন ভূমিষ্ঠ হয় তখন অনেক সময় হয়তো দেখা যায়, মায়ের বুকে দুধ আসে না। এ রকম সমস্যায় অনেকে ভোগে। সে ক্ষেত্রে বাচ্চাটিকে কীভাবে খাবারটা দেবে। এবং বুকে দুধ যাতে আসে, সে জন্য কী করণীয়?
উত্তর : এটি একটি বড় সমস্যা। বাচ্চা জন্ম নেওয়ার পর বেশির ভাগ সময় দেখা যায় মা এবং মায়ের সঙ্গে যে আত্মীয়স্বজন থাকেন, তাঁরা নিজেও জানেন না বাচ্চাকে বুকের দুধ কখন দিতে হবে। কীভাবে খাওয়াতে হবে। দেখা যায়, তখন বাচ্চা যে বুকের দুধ পাচ্ছে না, বাচ্চা কাঁদছে। এ নিয়ে আত্মীয়স্বজনের মধ্যে একটা সাংঘাতিক গোলমাল পড়ে যায়, বাচ্চা হওয়ার পরপরই।
যদি গাইনির চিকিৎসক বাচ্চা হওয়ার আগে একটু ধারণা না দেন, হওয়ার পরে তাকে কীভাবে বুকের দুধ দিতে হবে, তাহলে সমস্যা হয়। যদি একটু ভিডিওতে দেখানো যায়, বাচ্চা হওয়ার পর মা কীভাবে বুকের দুধ খাওয়াবে, তাহলে মা একটা মানসিক প্রস্তুতি গর্ভাবস্থায় নিয়ে রাখতে পারবেন।urgentPhoto
ওই সময়টাই গুরুত্বপূর্ণ সময় বোঝানোর জন্য, হওয়ার পরে নয়। ওই সময়টায় যদি আমরা ধারণা দিতে পারি, তবে দুগ্ধ পান অক্ষম হওয়ার কথা কখনোই না।
প্রশ্ন : তাহলে দুগ্ধ পান অক্ষম হওয়ার কারণ কী এই সময় বলে না দেওয়া?
উত্তর : চেকআপের সময় যদি সঠিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ না করা হয় বুকের দুধ খাওয়ানো সম্পর্কে, তাহলে বাচ্চা হওয়ার পর মনে হবে দুধ পাচ্ছে না কেন? আপনি দেখেন একটা মা যখন বাচ্চা জন্ম দেয়, সেটা সাধারণভাবেও দিতে পারে, অস্ত্রোপচারের মাধ্যমেও দিতে পারে। তখন কতটা ব্যথা, কতটা কষ্ট পেতে হয়। মা জানে না, বুকের দুধ আসবে কীভাবে। দেখা যায় নার্স, আত্মীয়স্বজন সবাই বাচ্চা ঠেলে ধরে বুকের মধ্যে ধরে রাখে। মা চিৎকার করছে, ব্যথা লাগছে, বাচ্চা সরাও। বাচ্চাও ঠিকমতো কাছাকাছি যাচ্ছে না। বুকের দুধ পাচ্ছে না। হয়তো কিছু বাচ্চার মায়ের স্তনের বোঁটায় সমস্যা রয়েছে। জ্ঞানটা থাকলে হয়তো প্রথম থেকেই ঠিক হয়ে আসে। তবে ওই কষ্টের অবস্থায়, যখন তলপেট ব্যথা করছে ওই সময় এই কষ্টটা অনেকটাই কমে যায়, যদি আগে থেকে বিষয়টি সম্পর্কে জানা থাকে।
আরেকটি বিষয় থাকে, সে কী খাবার খাবে। বাচ্চাকে কতক্ষণ পরপর চুষাবে বা কীভাবে খাওয়াতে হবে, সবটাই যদি তাকে না জানানো হয় তবে কষ্ট বাড়বে। বাচ্চা হওয়ার পরপর যে নার্স বা মুরুব্বি থাকেন, তাকে কীভাবে ধরতে হবে মায়ের বুকে, সেটা শিখতে হবে।
প্রশ্ন : বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হওয়ার কতক্ষণের মধ্যেই দুধ খাওয়াতে হবে?
উত্তর : বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরপরই যত তাড়াতাড়ি পারা যায় মায়ের বুকে দেওয়া, সঠিকভাবে ধরা, চোষানো এবং মাকে আশ্বস্ত করা। ওই সময় একটু ব্যথা হবেই, এটা ভালো। এটা হলে জরায়ু ছোট হয়ে যাবে। তা না হলে মা আশ্বস্ত হবে না। বলবে ব্যথা হচ্ছে, বাচ্চা দুধ পাচ্ছে না। সঠিক অবস্থায় না গেলে বাচ্চা কাঁদবে, বিরক্ত হয়ে যাবে। ফলে কী হবে, বাচ্চাকে বুকের কাছে নিলেই জোরে চিৎকার শুরু করবে।
তখন ধারণা হয়, মায়ের বুকে দুধ নাই, এ জন্য বাচ্চা কাঁদছে। তখন বাচ্চাকে ফিডার খাওয়াল। বাচ্চা গোগ্রাসে খেয়ে টানটান হয়ে শুয়ে আছে।
আসলে ঘটনা হলো, কীভাবে বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোর সময় বুকের কাছে ধরতে হবে, খাওয়াতে হবে এই জ্ঞানের অভাব।
প্রশ্ন : আমরা আশা করছি, যাঁরা চিকিৎসক তাঁরা এই বিষয়টিতে খেয়াল রাখবেন...
উত্তর : অবশ্যই গাইনোকোলজিস্ট যাঁরা, তাঁদের ভূমিকা অনেক, শিশু চিকিৎসকদের চেয়েও। শিশু চিকিৎসক তো জন্মের পরে। তাই মাকে অবশ্যই প্রশিক্ষিত করতে হবে। স্তনকে চেকআপ করতে হবে। স্তনের বোঁটায় কোনো সমস্যা থাকে, এই নয় মাস কীভাবে এটাকে সঠিক অবস্থায় আনা যায়, তাকে সম্পূর্ণ জ্ঞান দিতে হবে। লিফলেট দিতে হবে। ভিডিও দেখানো, এগুলো করা উচিত।
প্রশ্ন : এই যে মায়ের বুকের দুধের কথা আপনি বলছিলেন, এর উপকারিতাটা তো বলে ঠিক করা যাবে না। অনেকে আছেন, বাচ্চার দুই-তিন মাস যাওয়ার পরে পাশাপাশি কৌটার দুধ বা গরুর দুধ শুরু করলেন। এটার আসলে খুব বেশি প্রয়োজনীয়তা কী আছে? বা কতখানি ক্ষতি করতে পারে এটি?
উত্তর : শুধু বুকের দুধই খাওয়ানো উচিত জন্মের পর থেকে ছয় মাস বয়স পর্যন্ত। ছয় মাস পরে বাড়তি খাবার দেওয়া উচিত। কারণ, ওই ক্যালরিটা কেবল বুকের দুধে মেটানো যাবে না। তবে বুকের দুধ ছাড়া অন্য কিছুর প্রয়োজন পড়বে না ছয় মাস বয়স পর্যন্ত। যদি না নিয়ম মেনে সঠিকভাবে বাচ্চাকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো যায়।
মাকে পর্যাপ্ত পানিজাতীয় জিনিস, ঝোলজাতীয় জিনিস, দুধ এগুলো খেতে হবে। সবই একটু বেশি পরিমাণে খেতে হবে। বাচ্চাও অনায়াসে বুকে দুধ পাবে। তাতে করে লাভ যেটা, বাচ্চা অনেক অসুখ থেকে বেঁচে যাবে। বিশেষ করে সংক্রমিত রোগ যেগুলো। ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কিওলাইটিস ইত্যাদি থেকে বাচ্চার প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হবে। এই দুধে প্রাকৃতিকভাবে এমন কিছু আছে, যা থেকে বাচ্চার রোগ প্রতিরোধ হবে।
প্রশ্ন : রোজার সময় তো অনেকেই মা হয়েছেন, যাঁরা বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন, এমন মায়েদের ইচ্ছা থাকে রোজা রাখি। সেটি সঠিকভাবে যেন থাকতে পারেন এবং বাচ্চাকে দুধও খাওয়াতে পারেন, তাঁদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
উত্তর : তাঁদের জন্য পরামর্শ, ইফতারের পর থেকে তরলজাতীয় খাবার বেশি খাবে। আর যে খাবারগুলোতে দুধ বাড়ে, বিশেষ করে লাউ, কালিজিরা, দুধ, সাগু, ঝোলজাতীয় খাবার এগুলো বেশি খাবে। এবং রাতে বাচ্চাকে বেশি খাবার খাওয়াবে। তাহলে আমার মনে হয়, মা রোজা রাখতে পারবেন।
প্রশ্ন : এটি নিয়েও একটি ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে, বাচ্চাকে যখন বুকের দুধ খাওয়ানো হয়, তখন রোজা রাখতে পারবে কি না?
উত্তর : রোজা রেখেও বাচ্চার মা সহজেই দুধ খাওয়াতে পারবেন।
প্রশ্ন : কোন কোন জাতীয় খাবার বেশি খেলে বাচ্চার মা এবং বাচ্চার শক্তি হবে সেটি জানতে হবে...
উত্তর : তরলজাতীয় খাবার খেতে হবে। সেটা পানি, শরবত, জুস, দুধ—এগুলো খেতে হবে। অর্থাৎ শুকনো জাতীয় খাবার এড়িয়ে যত ঝোলজাতীয় খাবার আছে, সেগুলো খেতে হবে।
প্রশ্ন : কোনো বিশেষ খাবার কি তাঁদের জন্য খুব ক্ষতিকর হতে পরে রোজার সময়?
উত্তর : না। তবে আমি বলব, ঝাল মসলাটা কম খাওয়া উচিত। ঝালজাতীয় খাবার খেলে হয় কী, বুকের দুধের মাধ্যমে বাচ্চার পেটে সমস্যা হতে হয়। এ জন্য ঝালজাতীয় খাবার এড়িয়ে চলতে হবে।