খাদের কিনারা থেকে ফিরে এসেছে দেশের ব্যাংক খাত : গভর্নর

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, গত এক বছরে দেশের ব্যাংকিং খাত খাদের কিনারা থেকে ফিরে এসেছে। তার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলেই এই খাতটি ধ্বংসের মুখ থেকে ফিরতে পেরেছে বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।
রোববার (১০ আগস্ট) সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত ‘অন্তর্বর্তী সরকারের ৩৬৫ দিন’ শীর্ষক সেমিনারে গভর্নর এ কথা বলেন।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, গত বছরের আগস্টে সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সময় ব্যাংক খাত একেবারে খাদের কিনারায় ছিল। তিনি বলেন, আমাদের দুটি প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল— ম্যাক্রোইকোনমি স্থিতিশীল করা ও আর্থিক খাত সংস্কার। এক বছরে পূর্ণ সংস্কার সম্ভব নয়, তবে আমরা প্রতিটি খাতে সংস্কার শুরু করেছি।
ঋণ সংযোগ (লাইন অব ক্রেডিট) বজায় রাখতে দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছেন বলে জানান আহসান এইচ মনসুর।
গভর্নর বলেন, ‘আমরা তাদের আশ্বস্ত করেছি— আমরা আমাদের সব পাওনা পরিশোধ করব, আমরা তা করেছি। আমাদের অবস্থা শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানের মতো হয়নি।’
গত এক বছরে রেমিট্যান্স প্রবাহ ও রপ্তানি আয়ই ঋণ পরিশোধে বড় সহায়তা করেছে বলে মনে করেন আহসান এইচ মনসুর। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকেও বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি।
গভর্নর বলেন, গত বছরের ১৪ আগস্ট থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে এক ডলারও বিক্রি করেনি, বরং বাজারে চাপ সত্ত্বেও প্রতি ডলার ১২২ টাকায় কিনেছে। ফলে বর্তমানে মুদ্রাস্ফীতি ১০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে ও ভবিষ্যতে তা ৫ শতাংশের নিচে নামবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
গভর্নর আরও বলেন, ‘এখন দেশের ব্যালান্স অব পেমেন্টস উদ্বৃত্তে আছে, তবে বিনিয়োগ আকর্ষণে এখনও পিছিয়ে রয়েছে অর্থনীতি। নির্বাচনের আগে বড় বিনিয়োগ আসবে না, তবে আমরা নির্বাচন পরবর্তী সময়ের জন্য ইতোমধ্যেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি।’
কেন ব্যাংক কমিশন গঠন করা হয়নি— এ প্রসঙ্গে গভর্নর বলেন, ‘কমিশন করলে সিদ্ধান্ত নিতে ৬ থেকে ৯ মাস সময় লাগত। তাই আমরা ব্যাংক খাত সংস্কার, বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যক্রম ও বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারে তিনটি টাস্কফোর্স গঠন করেছি।’
বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধার সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ বলে উল্লেখ করে এর জন্য ৮ থেকে ১০টি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় প্রয়োজন বলে জানান আহসান এইচ মনসুর।
গভর্নর জানান, বৃহৎ পরিসরে আইনি সংস্কার চলছে। এর মধ্যে রয়েছে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন সংস্কার (যাতে সম্পদ পুনরুদ্ধারের ধারা যুক্ত করা হচ্ছে) ও বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার সংশোধনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জবাবদিহিতা ও স্বাধীনতা বাড়ানো। এ ছাড়া দীর্ঘদিনের ঋণ খেলাপি মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য ডিপোজিট ইনস্যুরেন্স আইন ও ঋণ আদালত আইন সংশোধন করা হবে।
অনিয়মের কারণে কোনো ব্যাংকের তারল্য সংকট দেখা দিলে বাংলাদেশ ব্যাংক যেন সেটি অধিগ্রহণ করতে পারে, এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক রেজুলেশন অর্ডিন্যান্সেও সংশোধন আনার পরিকল্পনার কথাও জানান আহসান এইচ মনসুর।
সবাইকে সতর্ক করে গভর্নর বলেন, আর কোনো ছাড় নয়। কোনো ব্যাংক যদি সঠিকভাবে চলতে না পারে, বাংলাদেশ ব্যাংক তা নিজের হাতে নেবে। সব ব্যাংক পর্যবেক্ষণের জন্য ‘৩৬০ ডিগ্রি মনিটরিং’ নামে একটি সংস্থা গঠন করা হবে বলেও জানান তিনি।
এ ছাড়া বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ক্যাশলেস ব্যবস্থায় রূপান্তরের ওপর জোর দেন গভর্নর। এ জন্য কিউআর কোড ব্যবহারে উৎসাহ, ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের প্রসার, ক্ষুদ্র ঋণ (ন্যানো লোন), স্কুল পর্যায়ে ব্যাংকিং শিক্ষা, শিক্ষার্থীদের জন্য ২০০ টাকার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, আবাসন খাতে সংস্কার, রাজস্ব বিভাগ পুনর্গঠন এবং স্মার্টফোনের দাম কমিয়ে ডিজিটাল ব্যাংকিং বিস্তারের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।