অপরিবর্তিত রেপো সুদহার, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে জোর বাংলাদেশ ব্যাংকের

গত জুনে ৩৫ মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি সর্বনিম্ন অবস্থানে পৌঁছেছে। এসময়ে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ছয় দশমিক ৪০ শতাংশে। বাংলাদেশ ব্যাংক আপাতত প্রধান নীতি সুদহার (রেপো) অপরিবর্তিত রেখে ১০ শতাংশে বহাল রেখেই চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতিতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
আজ বৃহস্পতিবার (৩১ জুলাই) বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে মুদ্রানীতি ঘোষণাকালে এই সিদ্ধান্তের ঘোষণা দেন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। সংবাদ সম্মেলনে ডেপুটি গভর্নর, নীতিনির্ধারক পরামর্শকসহ সংশিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন।
গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, যতক্ষণ না মূল্যস্ফীতির হার সাত শতাংশের নিচে স্থায়ীভাবে নেমে আসে, ততদিন নীতি রেপো হার ১০ শতাংশ নির্ধারণ থাকবে। আর স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি হার ১১ দশমিক পাঁচ শতাংশ এবং স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি হার আট শতাংশ বজায় রাখা হবে।
চলতি মুদ্রানীতিতেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই প্রধান অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। ২০২৫–২৬ অর্থবছরের বাজেটে আগামী বছরের জুন নাগাদ গড় মূল্যস্ফীতি ছয় দশমিক ৫০ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। অপরদিক জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা রাখা হয়েছে পাঁচ দশমিক ৫০ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বশেষ ২০২৪ সালের ২২ অক্টোবর রেপো সুদহার ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ১০ শতাংশে উন্নীত করে। রেপোর মাধ্যমে ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে সরকারি সিকিউরিটিজ বন্ধক রেখে স্বল্পমেয়াদি ঋণ গ্রহণ করে। নতুন মুদ্রানীতিতে স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটির হারও পূর্বের মতো ১১ দশমিক ৫০ শতাংশেই অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। তবে, ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে অর্থ রাখলে যে সুদ পায়—সেই স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি হার গত ১৫ জুলাই ৫০ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে আট শতাংশে নামানো হয়েছে।
ব্যাংক থেকে জানানো হয়, ২০২৪ সালের আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের সময় বাংলাদেশ তীব্র অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। এর মধ্যে ছিল উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, মুদ্রার অবমূল্যায়ন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস, বৈদেশিক পরিশোধের বকেয়া বৃদ্ধি, তারল্য সংকট, দুর্বল সুশাসন এবং অস্বাভাবিক হারে ঋণ খেলাপি বৃদ্ধি।
এই পরিস্থিতির মোকাবিলায় বাংলাদেশ ব্যাংক কড়া মুদ্রানীতির পাশাপাশি সম্পূর্ণভাবে বাজারভিত্তিক নমনীয় বিনিময় হার চালু করেছে এবং ব্যাংকিং খাতে ব্যাপক সংস্কার কর্মসূচি শুরু করেছে। ফলে, ধীরে ধীরে মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস পাচ্ছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পুনর্গঠিত হচ্ছে, বিনিময় হার স্থিতিশীল হয়েছে এবং আমানতকারীদের আস্থা ফিরে আসছে।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথমার্ধ এর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি বিবৃতি সরকারের লক্ষ্য অনুযায়ী প্রণয়ন করা হয়েছে—যার মধ্যে ৫.৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং ৬.৫ শতাংশের মধ্যে মুদ্রাস্ফীতি ধরে রাখা অন্যতম। এই মুদ্রানীতির মূল লক্ষ্য হলো মুদ্রাস্ফীতির হার আরও কমানো, বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা এবং আর্থিক খাতকে আরও শক্তিশালী করা।
বিশ্ব অর্থনীতিতে চাহিদা হ্রাস, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য শুল্ক বৃদ্ধি এবং বৈশ্বিক অনিশ্চয়তা বৃদ্ধি পাওয়ায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দুর্বল হতে পারে। অনেক কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার কমিয়ে বা স্থিতিশীল রেখে নীতিনির্ধারণ করছে। বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম ২০২৫-২৬ সালে হ্রাসের সম্ভাবনা রয়েছে।
দেশীয়ভাবে, মুদ্রাস্ফীতির চাপ, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, স্থবির বেসরকারি বিনিয়োগ, এবং ঋণ খেলাপির উচ্চ হার প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে থাকছে। পাশাপাশি, বৈদেশিক বাণিজ্যও আমদানি শুল্কের কারণে চাপের মুখে পড়তে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপসমূহের মধ্যে রয়েছে—নীতি রেপো হার ১০ শতাংশেই বজায় থাকবে, যতক্ষণ না মুদ্রাস্ফীতি সাত শতাংশের নিচে নামে। এসএলএফ হার ১১.৫ শতাংশ এবং এসডিএফ হার ৮ শতাংশে বজায় থাকবে। ২০২৫ সালের মে মাসে চালু হওয়া নমনীয় বিনিময় হার ব্যবস্থাপনা চালু থাকবে। দিনে দুইবার রেফারেন্স রেট প্রকাশ করা হবে এবং অতিরিক্ত অস্থিরতা রোধে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজন অনুযায়ী হস্তক্ষেপ করবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকিং খাতে সুশাসন ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে : একিউআর ভিত্তিক সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকের পুনর্গঠন এবং ঝুঁকিভিত্তিক তত্ত্বাবধান ২০২৬ সালের জানুয়ারি থেকে চালু করতে যাচ্ছে। যদিও সাম্প্রতিক মুদ্রাস্ফীতি কমেছে, তা এখনও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি এবং টাকার অবমূল্যায়নসহ বিভিন্ন খরচজনিত চাপ অব্যাহত থাকায় এ ধারা কতদিন স্থায়ী হবে তা অনিশ্চিত। তাই বাংলাদেশ ব্যাংক এ কড়া মুদ্রানীতি অব্যাহত রাখবে, যাতে মুদ্রাস্ফীতি সাত শতাংশের নিচে রাখা যায় এবং উৎপাদনমুখী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডেও সহায়তা করা যায়।