আদালতে হাসিনার কণ্ঠস্বর মিলের প্রমাণ উপস্থাপন, রাজসাক্ষীর বক্তব্য শনাক্ত

জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে একজন বিচারক ও একজন চিকিৎসকসহ আরও পাঁচজন সাক্ষ্য প্রদান করেছেন।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে আজ মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) জবানবন্দি দেন অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাকির হোসাইন, ডা. মোহাম্মদ সিরাজুস সালেহীন, সিআইডির শেখ নজরুল ইসলাম, মো. শাহেদ জোবায়ের লরেন্স ও মো. রুকুনুজ্জামান।এ পর্যন্ত আদালতে মোট ৪৫ সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয়েছে।
সাক্ষীর জবানবন্দিতে বিচারক মো. জাকির হোসাইন বলেন, ‘আমি অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে ঢাকায় কর্মরত আছি। গত ২৪ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার ফরোয়ার্ডিংয়ের আলোকে ঢাকার বিজ্ঞ চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট অত্র মামলার আসামি সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুাল রুলস অব প্রসিডিউরের ২৪ ও ২৫(১) বিধি মোতাবেক ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে তার স্বেচ্ছায় প্রদত্ত দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করার নির্দেশ প্রদান করেন।’
বিচারক মো. জাকির হোসাইন জবানবন্দিতে বলেন, ‘উক্ত নির্দেশনার আলোকে আমি গত ২৪ মার্চ অত্র মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মো. আলমগীরের উপস্থাপনমতে দুপুর ১২টা ১৫ মিনিটের সময় উক্ত আসামির (আব্দুল্লাহ আল মামুন) জবানবন্দি আমার খাস কামরায় তার নিয়োজিত বিজ্ঞ আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদের উপস্থিতিতে গ্রহণ করি। উক্ত আসামিকে আমার খাস কামরায় জবানবন্দি দেওয়ার বিষয়ে চিন্তা ভাবনা করার ও বিশ্রাম নেওয়ার জন্য আমার উপস্থিতিতে দুই ঘণ্টা ৩০ মিনিট সময় প্রদান করি। উক্ত সময় পর আসামি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের প্রদত্ত দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ও বক্তব্য বিস্তারিত আলাপ আলোচনাক্রমে কম্পিউটারে টাইপ করে লিপিবদ্ধ করি। জবানবন্দি শেষে আসামি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন সমগ্র জবানবন্দি নিজে পাঠ করেন এবং সম্পূর্ণ শুদ্ধ ও সঠিক স্বীকারে স্বাক্ষর করেন। তিনি তার পুরো নাম লেখেন এবং তারিখসহ সংক্ষিপ্ত স্বাক্ষর প্রদান করেন। জবানবন্দি শেষে আমি এই জবানবন্দির সমর্থনে প্রত্যয়ন প্রদান করি। আমি প্রত্যয়নে উল্লেখ করি, আসামি সম্পূর্ণ সুস্থ ও স্বাভাবিক অবস্থায় তার নিয়োজিত আইনজীবীর উপস্থিতিতে অত্র জবানবন্দি প্রদান করেন। তিনি সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় অনুতপ্ত হয়ে এ জবানবন্দি প্রদান করেন। এই সেই জবানবন্দি (প্রদর্শনী-১৫)। জবানবন্দির ব্যপ্তি ছয় পৃষ্ঠা। জবানবন্দিতে আসামি পূর্ণ নামের পাঁচটি স্বাক্ষর এবং সংক্ষিপ্ত পাঁচটি স্বাক্ষর প্রদান করেন (প্রদর্শনী-১৫/১ সিরিজ)। ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে আমি ছয়টি স্বাক্ষর প্রদান করি।’
জবানবন্দিতে সাক্ষী জাকির হোসাইন বলেন, ‘এই আমার স্বাক্ষর (প্রদর্শনী-১৫/২ সিরিজ)। দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি শেষে একটি আদেশের মাধ্যমে আমি জবানবন্দিসহ খণ্ড নথি চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট প্রেরণ করি। এই সেই খণ্ড নথি। খণ্ড নথিতে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে আদেশ নং ২ এ প্রদত্ত স্বাক্ষর দুটি আমার (প্রদর্শনী-১৬/১ সিরিজ)। খণ্ড নথির আদেশ নং ১ ও ৩ এ প্রদত্ত চারটি স্বাক্ষর ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের। আমি তার স্বাক্ষর চিনি। এগুলো তার স্বাক্ষর (প্রদর্শনী-১৬/২ সিরিজ)। দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি শেষে আসামি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে কারাগারে প্রেরণের নির্দেশ প্রদান করি।’
পঙ্গু হাসপাতালে নিহত-আহতদের বর্ণনা দিলেন ডা. মোহাম্মদ সিরাজুস সালেহীন
অপর সাক্ষীর জবানবন্দিতে ডা. মোহাম্মদ সিরাজুস সালেহীন বলেন, ‘আমি সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালে (পঙ্গু হাসপাতাল) কর্মরত আছি। আমি এই হাসপাতালে ২০২৪ সালের ১২ জুন যোগদান করি। অই বছরের ১৯ জুলাই (শুক্রবার) আমার ডিউটি ছিল না। আমি বাসায় ছিলাম। সেদিন বিকেলে (হাসপাতালের) পরিচালক ফোন দিয়ে জানান, হাসপাতালে অনেক আহত রোগী এসেছে, দ্রুত হাসপাতালে আসেন। হাসপাতালে ইমার্জেন্সি বিভাগে গিয়ে দেখি অনেক আহত রোগী এসেছে। তাদের শরীরের বিভিন্ন অংশে গুলিবিদ্ধ ছিল। রোগীদের মধ্যে বেশিরভাগই আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত। তাদের কেউ কেউ রিকশাচালক, ভ্যানচালক এবং পথচারীও ছিল। আমরা প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাদেরকে অপারেশন থিয়েটারে অস্ত্রোপচারের জন্য নিয়ে যাই এবং সেখানে তাদের অস্ত্রোপচার করা হয়। এইরূপ আহত রোগী ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট পর্যন্ত এসেছে। আমাদের হাসপাতালে আগত রোগীদের মধ্যে ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই হতে ৪ আগস্ট পর্যন্ত আটজন রোগী মারা যায়। তাদের মধ্যে দুজন রোগীকে মৃত অবস্থায় আনা হয়। বাকি ছয়জন অপারেশনের পরে মারা যায়। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তিনজনের একটি করে হাত কেটে ফেলা হয়েছিল এবং ১৭ জনের একটি করে পা কেটে ফেলা হয়েছিল।’
শেখ হাসিনা-ভিসি মাকসুদ কামালের কণ্ঠস্বর মিলের জবানবন্দি দেন সিআইডির তিন কর্মকর্তা
সাক্ষীর জবানবন্দিতে সিআইডির শেখ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বর্তমানে আমি সিআইডি ঢাকা, ব্যালিস্টিক শাখায় বিশারদ হিসেবে কর্মরত আছি। এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট থেকে গত ১০ মার্চ দুটি বুলেট ও তিনটি ধাতব পিলেট পরীক্ষার জন্য পাই। পরীক্ষান্তে গত ১৯ মার্চ আমার মতামত সম্বলিত প্রতিবেদন তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট প্রেরণ করি। আমি মতামত প্রস্তুত করেছিলাম গত ১৬ মার্চ। এই সেই মতামতের সত্যায়িত কপি, যা আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট প্রেরণ করেছিলাম (প্রদর্শনী-১৮)। মতামতের সত্যায়িত কপিতে এই আমার স্বাক্ষর (প্রদর্শনী-১৮/১)। মূল মতামত দাখিল করি নাই, কারণ তার প্রতিপাদ্য বিভিন্ন মামলায় দাখিল করা হবে। মূল প্রতিবেদন আমার নিকট আছে।’
সাক্ষীর জবানবন্দিতে সিআইডির মো. রুকুনুজ্জামান বলেন, ‘বর্তমানে আমি পুলিশ পরিদর্শক পদে সিআইডি ঢাকায় ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাবে কর্মরত আছি। গত ১৫ জানুয়ারি এই মামলার বিশেষ তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট থেকে একটি ডিভিডি-আর ও একটি হার্ড ড্রাইভ আলামত হিসেবে গ্রহণ করি। ডিভিডি আর- এ একটি তর্কিত অডিও ফাইল রয়েছে। হার্ড ড্রাইভটিতে প্রামাণ্য ফাইল রয়েছে। উক্ত আলামত পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে মতামত প্রদান করি। একইসঙ্গে আমি ট্রান্সক্রিপটও সরবরাহ করি। ডিভিডি আর- এ রক্ষিত একটি নারী কণ্ঠের সঙ্গে হার্ড ড্রাইভটিতে রক্ষিত প্রামাণ্য কণ্ঠটি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রামাণ্য কণ্ঠস্বরের মিল পাওয়া যায়। এই সেই মতামতের সত্যায়িত কপি, যা আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট প্রেরণ করেছিলাম (প্রদর্শনী-১৯)। মতামতের সত্যায়িত কপিতে এই আমার স্বাক্ষর (প্রদর্শনী-১৯/১ সিরিজ)। মূল মতামত দাখিল করি নাই, কারণ তার প্রতিপাদ্য বিভিন্ন মামলায় দাখিল করা হবে। মূল প্রতিবেদন আমার নিকট আছে।’
‘ঐ ডিভিডি আর এ রক্ষিত একটি পুরুষ কণ্ঠস্বরের সঙ্গে হার্ড ড্রাইভে রক্ষিত শেখ ফজলে নূর তাপসের প্রামাণ্য কণ্ঠস্বরের মিল পাওয়া যায়। এই সেই মতামতের সত্যায়িত কপি যা আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট প্রেরণ করেছিলাম (প্রদর্শনী-২০)। মতামতের সত্যায়িত কপিতে এই আমার স্বাক্ষর (প্রদর্শনী-২০/১ সিরিজ)। মূল মতামত দাখিল করি নাই, কারণ তার প্রতিপাদ্য বিভিন্ন মামলায় দাখিল করা হবে। মূল প্রতিবেদন আমার নিকট আছে। গত ১৯ মার্চ একটি পেনড্রাইভ আলামত হিসেবে গ্রহণ করি। পেনড্রাইভটিতে দুটি ভিডিও রয়েছে। একটি তর্কিত কথোপকথন সম্বলিত ভিডিও ফাইল। আরেকটি তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানের বক্তব্য সম্বলিত একটি প্রামাণ্য ভিডিও ফাইল। ২৩ মার্চ পরীক্ষা করে ঐ দিনই রিপোর্ট প্রদান করি। রিপোর্টে তর্কিত কণ্ঠস্বরের সঙ্গে ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানের কণ্ঠস্বরের মিল আছে। এই সেই মতামতের সত্যায়িত কপি, যা আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট প্রেরণ করেছিলাম (প্রদর্শনী-২১)। মতামতের সত্যায়িত কপিতে এই আমার স্বাক্ষর (প্রদর্শনী-২১/১ সিরিজ)। মূল মতামত দাখিল করি নাই, কারণ তার প্রতিপাদ্য বিভিন্ন মামলায় দাখিল করা হবে। মূল প্রতিবেদন আমার নিকট আছে’, যোগ করেন সিআইডির মো. রুকুনুজ্জামান।
সাক্ষীর জবানবন্দিতে সিআইডির মো. শাহেদ জোবায়ের লরেন্স বলেন, ‘বর্তমানে আমি উপপরিদর্শক (এসআই) পদে সিআইডির ঢাকায় ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাবে কর্মরত আছি। গত ১২ মে এই মামলার বিশেষ তদন্তকারী কর্মকর্তা এই মামলার আলামত হিসেবে একটি সিডি ও একটি ডিভিডি প্রেরণ করা হয়। সিডিতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তদানিন্তন উপাচার্য (ভিসি) মাকসুদ কামালের তর্কিত কথোপকথন সংরক্ষিত ছিল। ডিভিডিতে তাদের উভয়ের প্রামাণ্য কণ্ঠস্বর সংরক্ষিত ছিলো। পরীক্ষান্তে সিডিতে রক্ষিত কথোপকথন ফরেনসিক ল্যাবে ব্যবহৃত টুলসের সাহায্যে নারী কণ্ঠস্বর ও পুরুষ কণ্ঠস্বরকে আলাদা করি। ডিভিডিতে রক্ষিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তদানিন্তন ভিসি মাকসুদ কামালের নমুনা কণ্ঠস্বরের সিডিতে রক্ষিত নারী কণ্ঠস্বর ও পুরুষ কন্ঠস্বরের সঙ্গে তুলনামূলক যাচাই করি। যাচাই করে নারী কণ্ঠস্বরের সঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নমুনা কণ্ঠস্বরের মিল পাওয়া যায় এবং পুরুষ কণ্ঠস্বরের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তদানিন্তন ভিসি মাকসুদ কামালের নমুনা কণ্ঠস্বরের মিল পাওয়া যায়। এ ছাড়া উক্ত কথোপকথনের ট্রান্সক্রিপশন প্রদান করি। মতামতটি বিশেষ তদন্তকারী কর্মকর্তা নিজে এসে আমাদের দপ্তর থেকে নিয়ে যায়। এই সেই মতামতের সত্যায়িত কপি, যা আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট প্রেরণ করেছিলাম (প্রদর্শনী-২২)। মতামতের সত্যায়িত কপিতে এই আমার স্বাক্ষর (প্রদর্শনী-২২/১ সিরিজ)। মূল মতামত দাখিল করি নাই, কারণ তার প্রতিপাদ্য বিভিন্ন মামলায় দাখিল করা হবে। মূল প্রতিবেদন আমার নিকট আছে।’
সিআইডির মো. শাহেদ জোবায়ের লরেন্স আদালতে আরও বলেন, ‘ভয়েস পরীক্ষা করার ক্ষেত্রে সিআইডি ফরেনসিক ল্যাবে ব্যবহৃত আন্তর্জাতিক মানের সফটওয়্যারে এলআর রেশিও (স্কোর) সাধারণত ১ এর উপরে হলে বিতর্কিত কণ্ঠস্বর ও নমুনা কণ্ঠস্বর এক ও অভিন্ন মর্মে ধরে নেওয়া হয়। অত্র মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নমুনা কণ্ঠস্বর ও বিতর্কিত কণ্ঠস্বরের এল আর (স্কোর) ২.৭৫১৪৫ ছিলো। এই কারণে বিতর্কিত কণ্ঠস্বরটি শেখ হাসিনার মর্মে মতামত প্রদান করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি মাকসুদ কামালের নমুনা কণ্ঠস্বর এবং বিতর্কিত কণ্ঠস্বরের এলআর রেশিও (স্কোর) ৪.৬৪১৫৩ ছিল। এই কারণে বিতর্কিত কণ্ঠস্বরটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি মাকসুদ কামালের মর্মে মতামত প্রদান করি।’