রাস্তায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে ৮ বছরের শিশু মমিন!
সকালের সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়ছে কুষ্টিয়া–আলমডাঙা আঞ্চলিক সড়কে। চারদিকে ভিড়, যানবাহনের হর্নের শব্দ আর দীর্ঘ জট। কুষ্টিয়া সদর উপজেলার বটতৈল ইউনিয়নের ব্যস্ততম কদমতলা এলাকায় সড়কের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে আট বছরের শিশু মমিন। হাতে লাঠি আর মুখে বাঁশি। ট্রাফিক পুলিশের মতো ভঙ্গিতে গাড়ি থামাচ্ছে, আবার ছাড়ছে। অথচ এই বয়সে তার থাকার কথা ক্লাসরুমে, খেলার মাঠে।
ক্লাসরুম বা খেলার মাঠে নয়, দারিদ্র্য তাকে দাঁড় করিয়েছে সড়কের মাঝখানে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে। প্রতিদিন মাত্র ১০০ টাকার বিনিময়ে মমিন সামলাচ্ছে হাজারো গাড়ি আর যাত্রীদের ভিড়। দেখলে মনে হয়, সে একজন কর্তব্যপরায়ণ ট্রাফিক পুলিশ। এ যেন এক হৃদয়বিদারক বাস্তবতা—একটি শিশুর শৈশব কেড়ে নিয়েছে দায়িত্ববোধ।
স্থানীয়রা বলছে, এটি শুধু শিশুশ্রম নয়, মানবতার প্রতি এক অমানবিক আচরণ। একটি ব্যস্ততম আঞ্চলিক সড়কে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে শিশু মমিনের ছবি শুধু নির্মম বাস্তবতাই নয়, হৃদয়বিদারক এক প্রশ্নও।
বটতৈল–আলমডাঙা সড়কের কবুরহাট, কদমতলা, দোস্তপাড়া ও খাজানগর পর্যন্ত চলছে বিভাগীয় সড়ক ও জনপথের নির্মাণকাজ। এ কারণে প্রতিদিন সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। আর সেই যানজট নিরসনের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে ছোট্ট মমিনের কাঁধে। এতে যানজটের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ট্রাকচালক রাসেল বলেন, একটি শিশুকে দিয়ে এ কাজ করায় আরও সমস্যা তৈরি হচ্ছে, সৃষ্টি হচ্ছে যানযট। কারণ ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের নিয়ম সে বোঝে না, দুদিক থেকেই গাড়ি ছাড়ছে নির্বিচারে। ওর থাকার কথা পড়ার টেবিলে। ও কেন থাকবে সড়কে?
স্থানীয়দের অভিযোগ, খরচ বাঁচানোর জন্য শিশুশ্রমকেই বেছে নিয়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। যেখানে একজন প্রাপ্তবয়স্ক শ্রমিককে দিতে হয় ৬০০ টাকা, সেখানে মমিনকে দিয়ে কাজ সারছে মাত্র ১০০ টাকায়।
বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে মামুন নামে এক ব্যক্তি বলেন, দরিদ্র পরিবারের এই শিশুকে কৌশলে এখানে কাজে লাগানো মোটেও ঠিক হয়নি।
শামসুল ইসলাম নামে আরেকজন বলেন, দেখেও খুব কষ্ট লাগছে। আট বছরের শিশুকে মাত্র ১০০ টাকা দিয়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সড়কে দাঁড় করানো হচ্ছে। এই শিশু যদি দুর্ঘটনার শিকার হয়, সেই দায় কি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা নেবে?
মমিনের মা-বাবা কাজ করেন বটতৈল ইউনিয়নের কবুরহাট দোস্তপাড়া এলাকার স্থানীয় হাসকিং মিলে। সেখানে তিন ছেলে-মেয়েকে নিয়ে বসবাস করেন তারা।
মমিনের মা আফরোজা বেগম বলেন, আমি ও আমার স্বামী হাসকিং মিলের চাতালে কাজ করি। মাসে আট থেকে ১০ হাজার টাকা আয়ে চলে আমাদের সংসার। তাই বাধ্য হয়েই শিশু মমিন উপার্জনে যায়। আমার ছেলে ছোট বলে আমরা অনেক সময় বাধা দেই। তবুও সে চলে যায়। তবে পারিশ্রমিকের টাকাটা জমা দেয় আমার হাতেই। স্বপ্ন ছিল ছেলেকে স্কুলে পড়াব, কিন্তু টাকা পাব কই। ছেলেটাও অসুস্থ, ঠিকভাবে চিকিৎসা করাতে পারি না।
অভিযোগ রয়েছে, সড়ক ও জনপথ বিভাগের সুপারভাইজারের সামনেই শিশুটি দায়িত্ব পালন করে। অথচ তারা দেখেও না দেখার ভান করছেন। যদিও কর্মকর্তা বলছেন, শিশুকে দিয়ে কাজ করানো হবে না।
বিষয়টি নিয়ে সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রকৌশলী মুহাম্মদ মনজুরুল করিম বলেন, ‘শিশুটিকে কাজে আমরা আনিনি। মূলত যে শ্রমিকরা সড়ক সংস্কার করছে, তারা এনেছে। তবে বিষয়টি আমি দেখে ব্যবস্থা নেব।’