আনাসকে গোসল ছাড়াই দাফন করা হয়েছে, কান্নাজড়িত কণ্ঠে বাবা

জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে রাজধানীর চানখারপুলে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন সদস্যদের গুলিতে শিক্ষার্থী আনাসসহ ছয়জনকে হত্যার ঘটনায় সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ আট পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রথম সাক্ষ্য দিয়েছেন শহীদ আনাসের বাবা। সাক্ষ্য দেওয়ার সময় তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘দাফনের আগে আমরা আনাসকে গোসল করাইনি। তাকে শহীদি মর্যাদায় অর্থাৎ গোসল না করিয়ে রক্তাক্ত পরিধেয় পোশাকসহ দাফন করা হয়।’
আজ সোমবার (১১ আগস্ট) আর্ন্তজাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি মো. গোলাম মোর্তজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১ এ দুপুর থেকে বিকেল পৌনে চারটা পর্যন্ত মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ চলে।
সাক্ষীর জবানবন্দিতে আনাসের বাবা সাহরিয়া খান পলাশ বলেন, আমার নাম সাহরিয়া খান (পলাশ)। আমার বর্তমান বয়স আনুমানিক ৪২ বৎসর। আমি শহীদ শাহারিয়ার খান আনাসের (১৭) বাবা।
ধারাবাহিকভাবে জবানবন্দিতে আনাসের বাবা বলেন, গত বছরের ৫ আগস্ট সকাল আনুমানিক সাড়ে ৮ টার দিকে আমি, আমার স্ত্রী, আমার দুই সন্তান, মো. সাফওয়ান (৫ বছর), মো. সুফিয়ান (২ বছর) গেন্ডারিয়াস্থ আমাদের ভাড়া বাসায় অবস্থান করছিলাম। আমার স্ত্রী আনাসকে ঘরে দেখতে না পেয়ে তার পড়ার টেবিলে যায় এবং সেখানে তার হাতের লেখা একটি চিঠি পায়। চিঠিটা আনাস তার কোচিং ক্লাসের রসায়ন খাতায় রেখে যায়। চিঠিটা একটি ঔষধ কোম্পানির প্যাডে লিখা ছিল। চিঠিটা মাকে উদ্দেশ্য করে লিখে যায় আনাস।
সেখানে লিখা ছিল, মা আমি মিছিলে যাচ্ছি। যদি না ফিরি তাহলে গর্বিত হইয়ো। এ কথা বলে আনাসের বাবা ট্রাইব্যুনালে কেঁদে ফেলেন। কান্না জড়িত অবস্থায় তিনি বলেন, এটাই সেই চিঠির মূলকপি। এই চিঠিটিতে আনাসের স্বাক্ষর আছে। চিঠির একটি কপি তদন্তকারী কর্মকর্তা জব্দ করে আমার কাছে রাখেন। এই সেই জব্দ তালিকা। এতে আমার স্বাক্ষর আছে। এই সেই জিম্মানামা। এতে আমার স্বাক্ষর আছে। মিছিলটা ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচির। তখন বুঝতে পারি আনাস ওই কর্মসূচিতে গিয়েছে। দুপুর আনুমানিক দেড়টার দিকে আনাসের মায়ের মোবাইল নম্বরে একটি অপরিচিত নম্বর থেকে কল আসে এবং জিজ্ঞাসা করা হয় আপনাদের কেউ কি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কর্মসূচিতে গিয়েছে? তখন আমার স্ত্রী বলে, আমার ছেলে আনাস গিয়েছে। ঐ লোকটি তখন আমার স্ত্রীকে দ্রুত মিটফোর্ড হাসপাতালে যেতে বলে। আমার স্ত্রী তাকে জিজ্ঞাসা করে, আমার মোবাইল নাম্বার আপনি কীভাবে পেয়েছেন? ঐ লোকটি বলেন, আপনার ছেলের সঙ্গে থাকা সিমবিহীন মোবাইল থেকে আপনার নাম্বারটা পেয়েছি। পরে জানতে পারি ঐ লোকটিও আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী একজন ছাত্র। তার নাম সৌরভ আহম্মেদ। এটি আনাসের সঙ্গে থাকা সেই মোবাইল। এই মোবাইলটিও তদন্তকারী কর্মকর্তা জব্দ করে আমার উপরোক্ত জিম্মানামা মূলে আমার জিম্মায় দিয়েছিল।
জবানবন্দিতে আনাসের বাবা উল্লেখ করেন, পরে ছেলের সংবাদ শুনে আমি, আমার স্ত্রী এবং আমার শ্বশুর মিটফোর্ড হাসপাতালে গিয়ে জরুরি বিভাগের সামনে একটি স্ট্রেচারের ওপর রক্তাক্ত অবস্থায় আমার সন্তানের গুলিবিদ্ধ লাশ দেখতে পাই। সেখানে উপস্থিত আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী কয়েকজন ছাত্র-জনতার মাধ্যমে জানতে পারি, চানখারপুল মোড়, নিমতলি নবাব কাটারা গলিতে আমার ছেলে আনাসকে পুলিশ গুলি করে। তারপর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে জরুরি বিভাগে ভর্তির টিকিট, আনাসের ব্যবহৃত মোবাইল এবং মৃত্যু সনদ নিয়ে আমরা আনাসকে কোলে করে রিকশাযোগে বাসায় নিয়ে আসি। আনাসের শরীরের রক্ত আমার জিন্স প্যান্ট ও গেঞ্জিতে, আমার শ্বশুরের শার্টে এবং আমার স্ত্রীর ওড়নায় লাগে। এই রক্তমাখা কাপড়গুলি তদন্তকারী কর্মকর্তা জব্দ তালিকা মূলে জব্দ করেন এবং জিম্মানামা মূলে আমার জিম্মায় দেন। এগুলো সেই কাপড়। এই সেই রক্তমাখা জরুরি বিভাগের টিকিট এবং মৃত্যু সনদ। জরুরি বিভাগের ওই টিকিটে গানশট ইনজুরি এবং ব্রড ডেথ (Brought Dead) লিখা আছে।
জবানবন্দিতে আনাসের বাবা বলেন, বাসায় নিয়ে আসার পরে আনাসের মরদেহ নিয়ে এলাকার লোকজন স্বৈরাচার খুনি হাসিনার বিরুদ্ধে মিছিল করে। মিছিলে ‘আমার ভাই মরল কেন খুনি হাসিনা জবাব দে, খুনি হাসিনার ফাঁসি চাই’ ইত্যাদি স্লোগান দেয়। তারপর ঐ দিন আসরের নামাজের পর গেন্ডারিয়া ধুপখোলা মাঠে আনাসের জানাজার জন্য নিয়ে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি শেখ মেহেদী হাসান জুনায়েদ (১৪ বছর) নামক আরেকজন ছাত্রের মরদেহ জানাজার জন্য আনা হয়। সেও ওই দিনই চানখারপুল এলাকায় পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। দুজনের জানাজা একই সঙ্গে হয়। আমরা আনাসকে গোসল করাইনি। শহীদি মর্যাদায় অর্থাৎ গোসল না করিয়ে রক্তাক্ত পরিধেয় পোশাকসহ দাফন করা হয়।
তারপর আমরা আনাসের সঙ্গে থাকা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী রাব্বী হোসেন এবং মো. সৌরভ আহম্মেদের কাছে জানতে পারি তারা ঐ দিন অর্থাৎ ৫ আগস্ট সকাল আনুমানিক সাড়ে ১০টায় চানখারপুল হয়ে শহীদ মিনারের দিকে যাচ্ছিল। কিন্তু চানখারপুল এলাকায় পৌঁছে তারা পুলিশের বাধার সম্মুখীন হয়। সেখানে হাজার হাজার ছাত্র জনতা জড়ো হয়।
জবানবন্দিতে আনাসের বাবা আরও বলেন, পুলিশ সেখানে নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের ওপর সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ারশেল, শটগান এবং চাইনিজ রাইফেল দিয়ে নির্বিচারে গুলি করে। নিমতলির নবাব কাটারা গলির ভেতরে অবস্থানরত আমার ছেলে আনাসকে টার্গেট করে পুলিশ গুলি ছুড়লে একটা গুলি আমার ছেলের বুকের বামপাশে বিদ্ধ হয়ে পিছন দিয়ে বের হয়ে যায়। গুলি করা লোকটি এপিবিএনের পোশাক পরিহিত ছিল। আনাস গুলিবিদ্ধ হবার পর তাকে রাব্বি হোসেন, সৌরভ আহম্মেদসহ আরও অনেকে রিকশায় করে মিটফোর্ড হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যায়। ওই ঘটনা রাব্বি হোসেনসহ আরও অনেকে ভিডিও করে। ভিডিওগুলি আমার মোবাইলে দেওয়া হয় যা তদন্তকারী কর্মকর্তা আমার কাছ থেকে আমার মোবাইলসহ জব্দনামা মূলে জব্দ করে পেনড্রাইভে কপি নেয় এবং মোবাইলটি আমার জিম্মায় দেয়। এই সেই মোবাইল আইফোন ১১।
জবানবন্দিতে আনাসের বাবা বলেন, চানখারপুলের ঐ ঘটনায় আমার ছেলে আনাসসহ ছয়জন নিহত হয়। তারা হলেন-আমার ছেলে আনাস, জোনায়েদ, রাকিব, ইয়াকুব, মানিক এবং ইসমামুল। পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান, পুলিশের উপপুলিশ কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, এডিসি আক্তার, এসি ইমরুল, শাহবাগ ওসি অপারেশন আরশাদের পারস্পরিক নির্দেশে এবং নেতৃত্বে কনস্টেবল সুজন, কনস্টেবল ইমাজ হোসেন ইমন, কনস্টেবল নাসিরুল ইসলামদের গুলিতে ওই ছয়জন শহীদ হয় মর্মে বিভিন্ন গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া এবং আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের মাধ্যমে জানতে পারি। আমি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যারা আমার ছেলে আনাসসহ অন্যান্যদের নিহত ও আহত করেছে তাদের বিচার এবং ফাঁসি চাই। তদন্তকারী কর্মকর্তা আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এই আমার জবানবন্দী।
আজ সাক্ষ্যগ্রহণ উপলক্ষ্যে চার আসামিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। এ চারজন হলেন—শাহবাগ থানার সাবেক অফিসার ইনচার্জ (অপারেশন) মো. আরশাদ হোসেন, কনস্টেবল মো. সুজন মিয়া, মো. ইমাজ হোসেন ইমন ও মো. নাসিরুল ইসলাম। এদিকে সাবেক ডিএমপি কমিশনারসহ অপর চার আসামি এখনও পলাতক রয়েছেন।
গত ৩ জুন পলাতক চার পুলিশ কর্মকর্তাকে হাজির করতে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। গত ২৫ মে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট রাজধানীর চানখারপুলে গুলি করে ছয়জনকে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় প্রথম আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) আমলে নেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। গত ২৫ মে এ মামলায় আট পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়।
গত ১৪ জুলাই এ মামলায় পলাতক চার আসামিসহ আটজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।
বর্তমানে এ মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে চার পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। গত বছরের ৫ আগস্ট চানখারপুল এলাকায় শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে গুলি চালায় পুলিশ। এতে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটে। এতে শাহরিয়ার খান আনাস, শেখ মাহদী হাসান জুনায়েদ, মো. ইয়াকুব, মো. রাকিব হাওলাদার, মো. ইসমামুল হক ও মানিক মিয়া শাহরিক নিহত হন।