বাগেরহাটের এসপি ও তার প্রধান সহকারীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে তদন্ত কমিটি

বাগেরহাটের পুলিশ সুপার তৌহিদুল আরিফের বিরুদ্ধে তারই প্রধান সহকারী এসএম হাফিজুর রহমান কোটি কোটি টাকা অনিয়ম ও আত্মসাতের অভিযোগ করেছেন দুর্নীতি দমন কমিশন ও আইজিপির দপ্তরে। বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশের একধিক টিম। পুলিশ সুপারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করায় তার প্রধান সহকারীকে বাগেরহাট থেকে খাগড়াছড়ি বদলি করা হয়েছে এবং গত মাসে খুলনায় তার ওপর ছুরিকাঘাত করে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। বাগেরহাটের পুলিশ সুপার তৌহিদুল আরিফ তার বিরুদ্ধে প্রধান সহকারীর দুর্নীতির লিখিত অভিযোগের কথা স্বীকার করলেও বিষয়টা তদন্তাধীন থাকায় এ বিষয়ে কোন কথা বলতে রাজি হননি।
বাগেরহাট পুলিশ সুপার অফিসের প্রধান সহকারী এস এম হাফিজুর রহমান দালিলিক প্রমাণসহ ১০ পাতার অভিযোগে উল্লেখ করেছেন, ২০২৪ সালে সরকার পরিবর্তনের পর বাগেরহাট জেলার সাবেক পুলিশ সুপার আবুল হাসনাত সিলেট রেঞ্জে প্রথম বদলি (ওএসডি) হন। নতুন পুলিশ সুপার তৌহিদুল আরিফ যোগদান করে অফিস সহকারীর মাধ্যমে জানতে পারেন বিগত ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে টেন্ডার আহ্বান করা হলেও কোন মালামাল সরবরাহ না নিয়ে ঠিকাদারদের দিয়ে তাদের কাছ থেকে নগদ টাকা নেওয়া হয়েছে। বিনিময়ে ঠিকাদারদের ৫ শতাংশ লাভ দেওয়া হয়েছে। টেন্ডারের পণ্য না নিয়ে ঠিকাদারদের কাছ থেকে মোট ৩৯ লাখ ৭৬ হাজার ৯৫৮ টাকা নিয়ে গেছেন সাবেক পুলিশ সুপার আবুল হাসনাত।
বিষয়টি বর্তমান পুলিশ সুপার জানার পর পণ্য কেনার কথা বলে তিনি প্রধান সহকারীকে চাপ দিতে থাকেন টাকা ফেরত আনার জন্য। পরবর্তীতে পুলিশ সুপার কনস্টেবল মো. রুমেনুর রহমানকে (কনস্টেবল নং ১২০৪) সাবেক পুলিশ সুপার আবুল হাসনাতের কাছে পাঠিয়ে তার কাছ থেকে ৩৫টি আইটেম না কেনা বাবদ নগদ ২৩ লাখ ৩৮ হাজার ৯০৮ টাকা লিখিত স্বীকারোক্তিসহ বুঝে নেন। কিন্তু সাবেক পুলিশ সুপারের কাছ থেকে নগদ টাকা ফেরত আনার পরও তিনি কোন পণ্য ক্রয় করেননি বলে তারই প্রধান সহকারীর অভিযোগ।
অপরদিকে, একজন পুলিশ কনস্টেবলের মাধ্যমে এত নগদ টাকা গাড়িতে করে আনার বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলে ওই কনস্টেবলকে খাগড়াছড়িতে বদলি করে দেওয়া হয়।
এসএম হাফিজুর রহমানের অভিযোগ টাকা ফেরত পাওয়ার পর পুলিশ সুপার আগের পুলিশ সুপারের নামে তিনটি মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করিয়ে দেন এবং বাগেরহাট কারাগারে নিয়ে আসেন।
বাগেরহাটের সাবেক পুলিশ সুপার আবুল হাসনাত পরবর্তীতে বাগেরহাট জেলার তিনটি মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে বাগেরহাট জেলে ছিলেন। পরবর্তীতে তাকে বগুড়া জেলা কারাগারে হস্তান্তর করা হয় বলে বর্তমান পুলিশ সুপার তৌহিদুল আরিফ নিশ্চিত করেছেন।
তৌহিদুল আরিফ পুলিশ সুপারের দায়িত্ব নিয়ে আগের পুলিশ সুপারের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখে টেন্ডার আহ্বান করে ঠিকাদারের কাছ থেকে পণ্য না নিয়ে তাদের ৫-১০ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়ে স্বাস্থ্যবিধান সামগ্রী, মনিহারী সামগ্রী, ব্যবহার্য দ্রব্যাদি, কম্পিউটার সামগ্রী, কাঁচামাল ও খুচরা যন্ত্রাংশ, মোটরযান মেরামত, জলযান মেরামত, যন্ত্রপাতি ক্রয়, আসবাপত্র ক্রয়, পরিবহণ ব্যয়, চিকিৎসা ও শৈল্য সরঞ্জামাদি, ওষুধ ও প্রতিষেধক খাতে প্রায় দেড় কোটি টাকা আত্মসাত করেন বলে তারই প্রধান সহকারী দালিলিকভাবে প্রমাণ দিয়ে অভিযোগ করেন এবং তদন্ত কমিটির কাছে লিখিতভাবে স্বীকার করেন।
পুলিশ সুপারের বিরুদ্ধে দেওয়া তারই প্রধান সহকারী দুর্নীতির অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ সদর দপ্তর তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। এই কমিটির প্রধান খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার আবু রায়হান মোহাম্মদ সালেহ।
এ ব্যাপারে তদন্ত কমিটির প্রধান আবু রায়হান মোহাম্মদ সালেহর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি সম্প্রতি তদন্ত রিপোর্ট দাখিল করেছি। তাই তদন্তাধীন বিষয় নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলা ঠিক হবে না।
প্রধান সহকারী এস এম হাফিজুর রহমান আইজিপি বরাবরে আবেদনে জানান, পুলিশ সুপার গাড়ি রিকুইজিশনের ভুয়া বিল করে ৯ লাখ ৭৩ হাজার টাকা আত্মসাত করেছেন। পুলিশ সুপারের প্রধান সহকারী প্রতিটি অভিযোগের সঙ্গে দালিলিক প্রমাণও তুলে ধরেন।

ডিআইজি মো. রেজাউল হক প্রধান সহকারীকে ডেকে ঘটনা জানতে চাইলে পুলিশ সুপারের দুর্নীতির কথা তুলে ধরে লিখিত অভিযোগ দেন। প্রধান সহকারীর অভিযোগ ডিআইজি তার কাছে থেকে লিখিত অভিযোগ নিয়ে পুলিশ সুপারকে ডেকেও কোন ব্যবস্থা নেননি। এ প্রতিনিধি এ ব্যাপারে ডিআইজি রেজাউল হকের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি এক ঘণ্টা বসিয়ে রেখেও কথা বলবেন না বলে জানান।
এ ব্যাপারে বাগেরহাট পুলিশ সুপার তৌহিদুল আরিফ প্রধান অফিস সহকারীর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে ধরে জানান, হাফিজুর রহমানকে খাগড়াছড়িতে বদলি করা হয়েছে। হাফিজুর রহমান প্রধান অফিস সহকারী হিসেবে ২০১৪ সাল থেকে বাগেরহাট পুলিশ সুপার কার্যালয়ে যুক্ত ছিল। এই দীর্ঘসময় পুলিশ সুপার কার্যালয়ে চাকরিতে থেকে নিজেকে দণ্ডমুণ্ডের কর্তায় পরিণত করে। নিজের স্ত্রীর নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানসহ দীর্ঘ এক যুগে বাগেরহাটে ৭টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে পুলিশের যাবতীয় সরবরাহ টেন্ডার দিয়ে মালিকদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা নিয়েছে। এছাড়া ডিআইজি, পুলিশ সুপারের নামে নিয়োগ বাণিজ্য, অর্থ আত্মসাত, কর্মচারী বদলির নামে কোটি কোটি টাকার অবৈধ আয় করে খুলনা, ঢাকায় বাড়ি ও ফ্ল্যাট করেছে।
অপরদিকে, বাগেরহাট পুলিশ সুপার অফিসের অফিস সহকারী এস এম হাফিজুর রহমান খাগড়াছড়িতে যোগদান না করে এই বদলির বিরুদ্ধে খুলনা প্রশাসনিক আদালতে মামলা করেছেন। এই মামলায় গত মাসের ১১ জুলাই আদালত থেকে খুলনা হাজী মুহসিন রোড দিয়ে যাওয়ার সময় দুর্বৃত্তরা হাফিজুর রহমানের নিতম্বে ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছুরিকাঘাত করে। পরে তাকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এখনও সেখানে তিনি চিকিৎসাধীন।