ছাত্র-জনতার নজিরবিহীন আন্দোলনে হাসিনার বিদায়

সকাল তখন ১০টা ছুঁইছুঁই। হাইকোর্টের সামনে কদম ফোয়ারার সামনে দিয়ে দ্রুত গতিতে শহীদ মিনারের দিকে পিতার হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছেন দুই কন্যা। ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজের ড্রেস পড়া তাদের। চোখে মুখে যেন অগ্নিমূর্তি ধারণ করেছেন তারা। পাশে গিয়ে ‘কোথায় যাচ্ছেন’ জিজ্ঞেস করতেই যেন তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন দুই কন্যা। বললেন, ‘দেখতে পাচ্ছেন না কোথায় যাচ্ছি। আপনার কি চোখ নেই।’ বাবা তখন শান্ত গলায় সামলে নিলেন দুই কন্যাকে।
মা-বাবার হাত ধরে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের এক শিক্ষার্থীও ছুটছেন দুর্বার গতিতে। বাবা-মা পেছন পেছন ছুটছেন। গন্তব্য একই। তার সাথেও কথা বলার সুযোগ নেই। এমন আরও বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলার ব্যর্থ চেষ্টা প্রতিবেদকের। কেউ কারো সাথে কথা বলছেন না, সবাই ছুটে চলেছেন শহীদ মিনারের দিকে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে রাজধানীর সড়কে ছাত্র-জনতার উপস্থিতি বাড়তে থাকে। ঢাকার প্রবেশ মুখে নজিরবিহীন নিরাপত্তা। সব ব্যারিকেড ভেঙ্গে বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারের মতো ঢাকায় সবকটি প্রবেশ পথ দিয়ে শুধু আন্দোলনকারী নয় আপামর জনসাধারণ ঢুকতে থাকে। রাজধানী ঢাকার রাজপথ ততক্ষণে ছাত্র-জনতার দখলে। প্রশাসনের বাধামুখে ছাত্র-জনতা গণভবনমুখি হচ্ছেন।
সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এক সময় মনে হয় পরিস্থিতি আর নিয়ন্ত্রনে নেই। রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আন্দোলনকারীদের দমন কারার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এমন সময় খবর আসে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। দুপুর ২টায় ভাষণের সময় নির্ধারণ করা হয়। শুরু হয় নানা গুঞ্জন। তাহলে কি শেখ হাসিনা পদত্যাগ করছেন? নাকি অন্য কিছু? এরমধ্যে সেনাপ্রধানের ভাষণ এক ঘণ্টা পেছানো হয়। গুঞ্জনের ডালপালা আরও বাড়তে থাকে। তখনও ঢাকার রাজপথ পুরোপুরি উত্তাল। আবারও ঘোষণা আসে ৩টার পরিবর্তে এবার বিকেল ৪টায় ভাষণ দেবেন সেনাপ্রধান। এ পর্যন্ত সকলকে ধৈর্য ধরার অনুরোধ জানানো হয়।
এমন সব ঘটনাবহুল ৫ আগষ্ট আজ। আজকের এই দিনে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে তার বোন শেখ রেহানার সঙ্গে দুপুর ২টা ৩০ মিনিটে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যান। শেখ হাসিনা দেশত্যাগের আগে একটি ভাষণ রেকর্ড করে যেতে চেয়েছিলেন। তিনি সে সুযোগ পাননি। ওই হেলিকপ্টারটি ভারতে অবতরণ করে। এ সময় গণভবনে অসংখ্য মানুষ ঢুকে পড়ে। তারা গণভবন লুট করে। বিকেল ৪টায় আওয়ামী লীগের ঢাকা জেলা কার্যালয়ে আগুন দেয় আন্দোলনকারীরা।
কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এক দফা আন্দোলনে রূপ নেয়। শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবির আন্দোলনে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির ডাক দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ওই দিন সারা দেশ থেকে আন্দোলনকারীদের ঢাকায় আসার আহ্বান জানানো হয়। শিক্ষার্থীদের ৩৬ দিনব্যাপী আন্দোলনে শেষ পরিণতি শেখ হাসিনার পদত্যাগ করে দেশ থেকে পলায়ন।
মূলত ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শুরু হওয়া প্রথম দফার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে কোটা বাতিলের ঘোষণা দেন। ওই বছরের ৪ অক্টোবর কোটা প্রথা বাতিল প্রসঙ্গে পরিপত্র জারি করে সরকার। কোটা নিয়ে দ্বিতীয় দফা আন্দোলন শুরু হয় ২০২৪ সালের ১ জুলাই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা বাতিলের পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে ছাত্রসমাবেশ ও বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়।
২০২৪ সালের ৫ জুন সরকারি দপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত ও আধাস্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন করপোরেশনের চাকরিতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে (নবম থেকে ১৩তম গ্রেড) মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন আদালত। এর পরদিন পরিপত্র বাতিলের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন শিক্ষার্থীরা। মূলত এ দিনেই কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের দ্বিতীয় দফা আন্দোলনের বীজ বপন হয়। কোটা আন্দোলনে শুরুতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অংশ নিলেও পরর্বিতে এ আন্দোলন ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণে ‘ছাত্র-জনতার’ আন্দোলন হয়ে ওঠে। যার পরিসমাপ্তি ঘটে ৫ আগষ্ট শেখ হাসিনার দেশত্যাগের মাধ্যমে।