শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রথম দিনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ, কাল পর্যন্ত মুলতবি

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে হামলার ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রথম দিনে একজনের সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী তাকে জেরা করেন। আজ রোববার (৩ আগস্ট) ট্রাইব্যুনালে হাজির হয়ে প্রথম সাক্ষী দেন খোকন চন্দ্র বর্মণ নামে এক ভুক্তভোগী। যিনি জুলাই আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছিলেন। আগামীকাল সোমবার পর্যন্ত সাক্ষ্যগ্রহণ মুলতবি করা হয়েছে।
বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালে এ শুনানি হয়। ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য হলেন-বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
মামলার বেলা সোয়া ১১টার দিকে রাষ্ট্রপক্ষে এ মালায় সূচনা বক্তব্য শুরু করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। তার আগে অ্যাটর্নি জেনারেল আসাদুজ্জামান একটি বক্তব্য উপস্থাপন করেন। এ মামলার প্রথম সাক্ষী খোকন চন্দ্র বর্মণ কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে শপথবাক্য পাঠ করেন। পরে তিনি নিজে আহত ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহতদের বর্ণনা দিয়ে শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, ওবায়দুল কাদের, শামীম ওসমানের শাস্তি দাবি করেন। পরে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী তাকে জেরা করেন। দুপুর আড়াইটার দিকে এ মামলার শুনানি শেষে আগামীকাল পর্যন্ত মুলতবি করা হয়।
এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে অংশ নেন তাজুল ইসলাম, গাজী এম এইচ তামিম, মিজানুল ইসলাম। শেখ হাসিনার পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন শুনানি করেন।
এ মামলায় রাজসাক্ষী হওয়া সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনকে আজ রোববার (৩ আগস্ট) সকালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়েছে।
প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম বলেন, মামলার সূচনা বক্তব্য ও প্রথম সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হচ্ছে আজ। কোর্টের অনুমতি সাপেক্ষে বিটিভি ও ট্রাইব্যুনালের ফেসবুক লাইভে সরাসরি সম্প্রচার করবে। ট্রাইব্যুনালের বিধি ১৪ এবং ১৮(৪) অনুযায়ী সাক্ষীর সুরক্ষা ও নিরাপত্তা বিধানকল্পে সকল গণমাধ্যমকে এই মর্মে অনুরোধ করা যাচ্ছে যে, (১) সাক্ষীর ছবি বা ভিডিও ধারণ বা প্রচার করা যাবে না। (২) সাক্ষীর শুধু নাম প্রচার করা যাবে। (৩) সাক্ষীর ঠিকানা প্রকাশ করা যাবে না।
গত ১০ জুলাই এ মামলার রাজসাক্ষী হন চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। ট্রাইব্যুনালের আদেশে তাকে দোষ স্বীকারের শর্তে ক্ষমার কথা ঘোষণা করা হয়।
গত ১ জুন এই মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। শেখ হাসিনার পাশাপাশি আসামি করা হয় তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে। প্রসিকিউশন তাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ আনে।
পাঁচ অভিযোগ হলো—
প্রথম. গত বছরের ১৪ জুলাই গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারী ছাত্র-ছাত্রীদের রাজাকারের বাচ্চা ও রাজাকারের নাতিপুতি উল্লেখ করে উসকানিমূলক বক্তব্য দেন শেখ হাসিনা। এর পরিপ্রেক্ষিতে আসাদুজ্জামান খান, চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্ররোচনা, সহায়তা ও সম্পৃক্ততায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও সশস্ত্র আওয়ামী সন্ত্রাসীরা ব্যাপক মাত্রায় ও পদ্ধতিগতভাবে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণ করে। গুলি করে দেড় হাজার ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হয়। আহত হন প্রায় ২৫ হাজার।
দ্বিতীয়. হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের নির্মূল করার নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপি তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মাধ্যমে সেই নির্দেশ কার্যকর করেন। গত বছরের ১৪ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য এ এস এম মাকসুদ কামাল এবং ১৮ জুলাই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে কথা বলেন শেখ হাসিনা। দুজনের সঙ্গে কথোপকথনের পৃথক অডিও রেকর্ড থেকে জানা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট বাহিনীগুলোকে মারণাস্ত্র ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি।
শেখ হাসিনার সেই নির্দেশ তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপির মাধ্যমে সব বাহিনীর কাছে দেওয়া হয়। পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ও তার অন্যান্য অঙ্গসংগঠন এবং ১৪ দলীয় জোটের কাছেও এই নির্দেশ যায়। সেই নির্দেশের আলোকে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়। এর দায়ে তাদের (হাসিনা, আসাদুজ্জামান ও মামুন) বিরুদ্ধে সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির (সর্বোচ্চ দায়) আওতায় অভিযোগ গঠন করা হয়েছে।
তৃতীয়. রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করার ঘটনায় শেখ হাসিনার পাশাপাশি আসাদুজ্জামান ও মামুনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
চতুর্থ. রাজধানীর চানখাঁরপুলে আন্দোলনরত নিরীহ-নিরস্ত্র ছয়জনকে গুলি করে হত্যার ঘটনায়ও শেখ হাসিনার পাশাপাশি ওই দুজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
পঞ্চম. শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান ও মামুনের বিরুদ্ধে আশুলিয়ায় নিরীহ-নিরস্ত্র ছয়জনকে আগুনে পুড়িয়ে মারার ঘটনায়ও অভিযুক্ত করা হয়েছে।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালে মোট চারটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ২ জুলাই আদালত অবমাননার একটি মামলায় তাকে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এটিই প্রথম কোনো মামলা, যেখানে হাসিনার কারাদণ্ড হয়েছে।