গোপালগঞ্জে কারফিউয়ের সময়সীমা বাড়ল

গোপালগঞ্জে কারফিউ সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে। আগামীকাল শনিবার (১৯ জুলাই) সকাল ৬টা পর্যন্ত এ কারফিউ চলবে বলে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা প্রশাসক মুহম্মদ কামরুজ্জামান স্বাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
আজ বেলা ১১টা থেকে ৭ ঘণ্টার জন্য কারফিউ শিথিল হওয়ার পর গোপালগঞ্জ শহরে কিছুটা প্রাণের সঞ্চার হয়। যানবাহন চলাচল ও লোকজনের উপস্থিতি বাড়ে। স্বল্প সংখ্যক দোকানপাট খুলেছে, চলেছে কিছু বেচাকেনা। পরে জেলা প্রমাসক নতুন করে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে কারফিউয়ের সমসসীমা বাড়িয়েছে।
সংঘর্ষে মৃতের সংখ্যা বৃদ্ধি
গত বুধবার (১৬ জুলাই) জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতাকর্মীদের ওপর হামলা-সংঘর্ষের পর রাত ৮টা থেকে গোপালগঞ্জে কারফিউ চলছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানায়, নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগসহ আওয়ামী লীগ ও বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা ওই হামলা চালায়। এতে সেদিন গুলিবিদ্ধ হয়ে চারজনের মৃত্যু হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় রমজান মুন্সি (৩৫) নামে এক রিকশাচালক গতকাল বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ২টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। এ নিয়ে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে পাঁচ জনে।
নিহত রমজান মুন্সির ভাই জামাল মুন্সি তার মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করেছেন। রমজান মুন্সি পৌরসভার থানাপাড়ার ৬ নং ওয়ার্ডের মৃত আকবর আলী মুন্সির ছেলে। জামাল মুন্সি জানান, তার ভাই রিকশা চালাতেন এবং বুধবারের সংঘর্ষের সময় এক যাত্রীকে পৌঁছে দিতে রিকশা নিয়ে লঞ্চ ঘাট এলাকায় যান। তখন সংঘর্ষের মধ্যে জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি এম এইচ খান মঞ্জুর বাসভবনের পাশের গলিতে ঢুকে পড়ে গুলিবিদ্ধ হন। রমজান কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না বলে দাবি করেন জামাল মুন্সি। তিনি ভাইয়ের হত্যার বিচার দাবি করেন। জামাল আরও বলেন, ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ গোপালগঞ্জে নেওয়া হবে।
গোপালগঞ্জে এনসিপিরে জুলাই পদযাত্রা ও সমাবেশকে ঘিরে সংঘর্ষের ঘটনায় এ নিয়ে পাঁচজনের মৃত্যু হলো। এর আগে গত বুধবার ঘটনার দিনই চারজন নিহত হন। তারা হলেন—মোবাইল ফোনের যন্ত্রাংশের দোকানি সোহেল মোল্লা (৩৫), পোশাক ব্যবসায়ী দীপ্ত সাহা (২৫), ক্রোকারিজ পণ্যের দোকানের কর্মচারী ইমন তালুকদার (১৭) ও টাইলস মিস্ত্রির সহকারী রমজান কাজী (১৮)।
গোপালগঞ্জ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. জীবিতেষ বিশ্বাস বলেন, গুলিবিদ্ধ হয়ে রমজান মুন্সি বুধবার বিকেলে গোপালগঞ্জ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আসেন। তার অবস্থা সংকটাপন্ন ছিল। তাই তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ওইদিন রাতেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
পুলিশের ওপর হামলায় মামলা দায়ের
গোপালগঞ্জে পুলিশের ওপর হামলা, মারধর, গাড়ি পোড়ানো ও এক পুলিশ পরিদর্শকসহ পাঁচ পুলিশকে মরধর করে আহত করার ঘটনায় মামলা করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতে গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার গোপীনাথপুর পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক আহম্মেদ আলী বাদী হয়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নিউটন মোল্লা, সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান পিয়ালসহ ৭৫ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাত আরও সাড়ে চার থেকে ৫০০ জনকে আসামি করে এ মামলা দায়ের করেন।
গোপালগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মির মোহাম্মদ সাজেদুর রহমান আজ শুক্রবার বিকেলে মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
ওসি জানান, গত বুধবার সকালে এনসিপির পদযাত্রা কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে গোপালগঞ্জ-টেকেরহাট আঞ্চলিক সড়কের গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার উলপুরের পাশে খাটিয়া গড় চরপাড়ায় পুলিশ নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল। নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান পিয়ালের নেতৃত্বে একদল লোক অতর্কিতে কর্তব্যরত পুলিশের ওপর হামলা করে। তারপর তারা গোপীনাথপুর পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক আহম্মেদ আলী বিশ্বাসসহ পাঁচ পুলিশ সদস্যকে মারধর করে আহত ও গাড়ি ভাঙচুরের পর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়।
কারফিউর মধ্যে আটক ও ব্যবসায়ীদের দুর্ভোগ
কারফিউর মধ্যে যৌথ বাহিনী অভিযান চালিয়ে ১৬৪ জনকে আটক করেছে। এর মধ্যে মুকসুদপুর থানায় ৬৬ জন, গোপালগঞ্জ সদর থানায় ৪৫ জন, কাশিয়ানী থানায় ২৪ জন, টুঙ্গিপাড়া থানায় ১৭ জন ও কোটালীপাড়া থানায় ১২ জনকে আটক করা হয়। গোপালগঞ্জ সদর থানার ওসি মির মোহাম্মদ সাজেদুর রহমান, মুকসুদপুর থানার ওসি মোস্তফা কামাল, কাশিয়ানী থানার ওসি কামাল হোসেন, কোটালীপাড়া থানার ওসি মো. আবুল কালাম আজাদ ও টুঙ্গিপাড়া থানার ওসি খোরশেদ আলম এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। আটকদের বিকেলে আদালতে পাঠানো হয়েছে। তবে অভিযানের খবরে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা গা ঢাকা দিয়েছে।
এদিকে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ক্ষতির মুখে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। বিশেষ করে ফল-সবজির মতো কাঁচা পণ্যের ব্যবসায়ীরা পড়েছেন মহাবিপাকে। দোকান বন্ধ থাকায় তাদের পণ্য পচে যাচ্ছে।
শহরের বড় বাজারের ফল ব্যবসায়ী বিল্লাল খান বলেন, কারফিউয়ে দোকান খুলতে না পারায় মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছি। তিন দিনে হাজার হাজার টাকার ফল পচে গেছে। আজ সাত ঘণ্টার জন্য দোকান খুলেছি। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে তেমন একটা বিক্রি হয়নি। বাকি ফলগুলোও পচে যাবে। আমরা চাই, দ্রুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসুক।
শহরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সতর্কতার সঙ্গে টহল ও অবস্থান করতে দেখা গেছে। ফের কারফিউ শুরুর পর দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। শহরে যান চলাচল কমেছে। শহরের অলিতে গলিতে মানুষের চলাচল সীমিত হয়ে এসেছে।
নদীপথে টহল জোরদার
এনসিপির ওপর হামলার ঘটনায় জড়িতরা যাতে নৌপথে পালাতে না পারে, সেজন্য গোপালগঞ্জের নদীপথে টহল জোরদার করেছে কোস্ট গার্ড ও নৌবাহিনী। আজ দুপুরে কোস্ট গার্ড মিডিয়া কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার হারুন-অর-রশীদ গণমাধ্যমের কাছে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য জানিয়েছেন।
ওই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সম্প্রতি গোপালগঞ্জে এনসিপি নেতৃবৃন্দের ওপর সংঘটিত হামলার পরিপ্রেক্ষিতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে যৌথ বাহিনীর অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এ ধারাবাহিক অভিযানের অংশ হিসেবে দুষ্কৃতিকারীরা নদীপথ ব্যবহার করে যেন পালিয়ে যেতে না পারে, সেজন্য গোপালগঞ্জ জেলার নদীপথে বিশেষ টহল পরিচালনা করছে কোস্ট গার্ড ও নৌবাহিনী। সন্দেহভাজন নৌযানগুলোতে তল্লাশি, যাত্রীর পরিচয় যাচাই ও সন্দেহভাজন গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে বলে ওই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়।