কারফিউর শহর গোপালগঞ্জের সারা দিন

গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জুলাই পদযাত্রা ঘিরে গতকাল বুধবার দফায় দফায় হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায় চারজন নিহত, অন্তত নয়জন গুলিবিদ্ধসহ প্রায় অর্ধশত ব্যক্তি আহত হন। এরপর রাতে কারফিউ জারি করে জেলা প্রশাসন।
কারফিউর মধ্যে যৌথবাহিনী ২৪ জনকে আটক করেছে। এখনো মামলা হয়নি। কারফিউ চলমান বলে আজ বৃহস্পতিবার (১৭ জুলাই জানিয়েছে জেলা প্রশাসন)। তবে আগামীকাল বেলা ১১ থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত ৩ ঘণ্টা কারফিউ শিথিল থাকবে। পরবর্তী পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত জানানো হবে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।
জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার শরফ উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী এ তথ্য জানান।

সারা দিনের কারফিউর চিত্র
আজ সকাল থেকেই রাস্তাঘাট ফাঁকা ছিল। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সীমিত আকারে রিকশা ইজিবাইক চলতে দেখা যায়। দোকানপাট বন্ধ ছিল। তবে জরুরি সেবা সচল ছিল। প্রয়োজন ছাড়া মানুষ ঘর থেকে বাইরে বের হয়নি। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে শহরের বিভিন্ন স্পর্শকাতর স্থানে পুলিশ ও এপিবিএন ও মোতায়েন করা হয়। টহল ছিল সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যানের। সেনাবাহিনীর বিশেষ পাহারা ছিল জেলা কারাগারে।
২৪ জন আটক
কারফিউর মধ্যে যৌথবাহিনী অভিযান চারিয়ে ২৪ জনকে আটক করেছে। এরমধ্যে ১৪ জনকে গতকাল রাতে আটক করা হয়। আজ জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে ১০ জন আটক হন। ইউনিয়ন পর্যায়েও পুলিশ গ্রেপ্তারে তৎপর ছিল।
গোপালগঞ্জে সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মির মোহাম্মদ সাজেদুর রহমান ২৪ জনকে আটকের তথ্য নিশ্চিত করে গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, বুধবারের ঘটনায় এখনও মামলা হয়নি।
আত্মগোপনে হামলাকারীরা
আটক অভিযান শুরু পর আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা আত্মগোপনে চলে গেছেন। গ্রেপ্তার এড়াতে জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতারা চলে যান আত্মগোপনে। আটক নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যেও অজানা আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গোপালগঞ্জ পৌর আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, নির্বিচারে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের গ্রেপ্তার করছে। বাড়িতে বাড়িতে অভিযান চালাচ্ছে। এ ছাড়া নেতাকর্মীদের নির্যাতন করা হচ্ছে। এ কারণে আমরা আত্মগোপনে রয়েছি।
জেলা কারাগার পরিদর্শন
গোপালগঞ্জ কারাগার পরিদর্শন করেছেন অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল তানভীর হোসেন। তিনি আজ বেলা সোয়া ১১টার দিকে জেলা কারাগারে এসে পৌঁছান। এ সময় কারা কর্তৃপক্ষের পদস্থ কর্মকর্তা ও জেলা কারাগারের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাকে সেখানে অভিবাদন জানান। পরে তিনি তাদের সাথে কথা বলেন এবং খোঁজখবর নেন।
অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কথা বলেন গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গেও। তিনি বলেন, সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় কারাগারে হামলার ঘটনা রোধ করতে পেরেছি। এজন্য আমি সেনাবাহিনীকে ধন্যবাদ জানাই। কারাগারে ফের হামলার কোনো আশঙ্কা নেই উল্লেখ করে এই কর্মকর্তা বলেন, কোনো থ্রেট নেই। তার পরও সেনাবাহিনী, বিজিবি ও কারারক্ষীরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন। এরপর তিনি জেলা কারাগারে প্রবেশ করেন। এ সময় এআইজি প্রিজন দেওয়ান তারিকুল ইসলাম, জেলার তানিয়া জামানসহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন।
গতকাল এনসিপির পদযাত্রা ও সভাকে কেন্দ্র করে বিকেলে হামলা করা হয় জেলা কারাগারে। সেখানে ভাঙচুর করে অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটে। সেনাবাহিনী, বিজিবি ও কারারক্ষীরা সারারাত জেলা কারাগারের সামনে সতর্ক অবস্থানে ছিল।

ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের সংবাদ সম্মেলন
গোপালগঞ্জের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে আলোচনা ও পর্যালোচনার পর কারফিউ বাড়ানোর সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন ঢাকা বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার শরফ উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। আজ সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আছে। এর আগে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাবসহ বিভিন্ন বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে সভা করেন তিনি।
বিভাগীয় কমিশনার শরফ উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, বুধবার চারজনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রায় ৪০-৫০ জন আহত আছেন। ২৪ জন দুষ্কৃতকারীকে আটক করা হয়েছে। অন্যদের ধরতে আমাদের পুলিশের অভিযান অব্যাহত আছে।
বিভাগীয় কমিশনার শরফ উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী আরও বলেন, গোপালগঞ্জের মানুষ খুবই শান্তিপ্রিয় এবং আইনশৃঙ্খলার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। যার প্রমাণ তারা অতীতেও রেখেছেন, আমরা তাদের কাছে সেই প্রত্যাশা এখনও রাখি। আমরা সাধারণ মানুষকে বলতে চাই তাদের আতঙ্কিত বা ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। যারা দুষ্কৃতকারী আছে আমরা তাদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করছি এবং যাদের চিহ্নিত করতে পারব তাদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হবে। এই অভিযান অব্যাহত থাকবে। আইনশৃঙ্খলা পুরোপুর নিয়ন্ত্রণে আছে।
গতকাল বেলা ১১টার দিকে জেলা শহরের পৌর উন্মুক্ত মঞ্চে এনসিপির পথসভা শুরু হওয়ার কথা ছিল। সকাল থেকেই পথসভার মঞ্চ তৈরি ও সামনে চেয়ার গোছানোর কাজ শুরু হয়। সকাল সাড়ে ৯টা থেকে চালু হয় মাইক। এনসিপির স্থানীয় নেতাকর্মীরা মাঝেমধ্যে মাইকে কথা বলছিলেন। সকাল সাড়ে ৯টায় পুলিশের গাড়িতে আগুন ও বেলা সাড়ে ১১টায় ইউএনওর গাড়িতে হামলার খবর আসে। পুলিশ ও ইউএনওর গাড়িতে হামলার পর এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতাদের সভাস্থলে আসা নিয়ে কিছুটা শঙ্কা দেখা দেয়। এরই মধ্যে দুপুর ১২টার দিকে স্থানীয় নেতারা ঘোষণা দেন, কেন্দ্রীয় নেতারা পথেই আছেন; পথসভা অনুষ্ঠিত হবেই। তারা বিভিন্ন স্লোগানও দিতে থাকেন মঞ্চের মাইক থেকে। বেলা ১টা ১২ মিনিটের দিকে একপশলা বৃষ্টি হয়। তখন সভামঞ্চ ছেড়ে পাশে অবস্থান নেন নেতাকর্মীরা। সভামঞ্চ ও সামনের চেয়ার মিলিয়ে তখন ৭০-৮০ জন লোক ছিলেন। এ ছাড়া সেখানে ছিলেন পুলিশ সদস্য ও সংবাদকর্মীরাও।
বৃষ্টি কিছুটা কমার পর বেলা ১টা ২৫ মিনিটের দিকে এনসিপির নেতাকর্মীরা আবার মঞ্চে ওঠেন। ১টা ৩৪ মিনিটে গোপালগঞ্জ মহিলা কলেজের সামনের সেতু পার হয়ে ৫০-৬০ জনের একটি দল বাঁশ ও লাঠিসোঁটা নিয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে সেখানে আসে। তারা সভামঞ্চের চেয়ার ও সাউন্ডবক্স ভাঙচুর করে। এ সময় পুলিশ ও স্থানীয় এনসিপির নেতাকর্মীরা পাশের কোর্ট চত্বরে গিয়ে আশ্রয় নেন। তখন পুলিশ সুপার আরও সদস্য নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছান। পুলিশ ও এনসিপির নেতাকর্মীদের ধাওয়ায় হামলাকারীরা পালিয়ে যায়।
১০ মিনিটের মধ্যে এনসিপির নেতাকর্মীরা সভাস্থলে এসে স্লোগান দিতে শুরু করে। এ সময় জেলখানা মোড়, চৌরঙ্গী, বিসিক ব্রিজ ও বিভিন্ন অলিগলিতে আওয়ামী লীগের কর্মীরা বিক্ষিপ্তভাবে জড়ো হতে শুরু করে। বেলা ২টা ৪ মিনিটে সভামঞ্চে উপস্থিত হন এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতারা। ২টা ৪০ মিনিটে পথসভা শেষ হয়। এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সবার শেষে বক্তব্য দেন। তাঁর বক্তব্য শেষে নেতাকর্মীরা গাড়িতে উঠছিলেন। তখন লেকপাড়ের লঞ্চঘাট ব্রিজ, মহিলা কলেজ ব্রিজ, কাঁচাবাজার ব্রিজ ও বিসিক ব্রিজ পার হয়ে হামলাকারীরা সভাস্থলের দিকে আসতে শুরু করে। এ সময় তাদের ধাওয়া দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। পুলিশ বাঁশি বাজিয়ে ও লাঠি উঁচিয়ে সবাইকে সরে যেতে বলে। তবে হামলাকারীরা পিছু না হটে আরও সামনের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। এরই মধ্যে পুলিশ এনসিপির নেতাদের গাড়িবহর নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তাঁদের গাড়িবহরের সামনে-পেছনে অন্তত ১৫টি পুলিশের গাড়ি ছিল। সামনের কয়েকটি গাড়ি একটু এগোতেই বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু হয়। তখন পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ে। এরই মধ্যে পুলিশ গাড়িবহর ঘুরিয়ে এনসিপি নেতাদের পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের দিকে নিয়ে যায়। পরে ওই কার্যালয়ে আশ্রয় নেন এনসিপির নেতা-কর্মীরা।