হানাদারমুক্ত দিবস স্মরণে মানিকগঞ্জে আজ বিজয়মেলা

মানিকগঞ্জ হানাদারমুক্ত দিবস আজ। ১৯৭১ সালের এই দিনে মানিকগঞ্জ জেলা (তৎকালীন মহকুমা) পাকিস্তান হানাদারমুক্ত হয়। জেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে পিছু হটে মহকুমা শহরে অবস্থান নেয় হানাদার বাহিনী।
দিনটি স্মরণে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হোক আজকের প্রজন্ম’ এই স্লোগানে ও ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ত্বরান্বিত কর, জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা নির্মূল কর’ এই দাবিতে আজ থেকে শুরু হচ্ছে ১৪ দিনব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের বিজয়মেলা। জেলায় ২৬তম বারের মতো এ মেলার আয়োজন করা হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান বাহিনীর দপ্তর ছিল মানিকগঞ্জ সিঅ্যান্ডবির ডাকবাংলো। এখান থেকেই এ দেশীয় দোসরদের নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় নিধনযজ্ঞ পরিচালনা করত তারা। আর মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন পিটিআই ভবনে পাকিস্তানি বাহিনীর মূল ব্যারাক ছিল।
২৫ মার্চ রাতে মানিকগঞ্জের প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়। জেলা কমান্ড কাউন্সিল সদস্যরা যুদ্ধ পরিচালনার জন্য শপথ নেন ।
মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করার জন্য ওইদিনই মানিকগঞ্জে অ্যাডভোকেট খোন্দকার চান মিয়াকে চেয়ারম্যান করে প্রয়াত মো. মোসলেম উদ্দিন খান হাবু মিয়া, প্রয়াত ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল হালিম চৌধুরী, প্রয়াত খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন, সৈয়দ আনোয়ার আলী চৌধুরী, মীর আবুল খায়ের ঘটু ও মফিজুল ইসলাম খান কামালকে নিয়ে সাত সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির সিদ্ধান্তে মানিকগঞ্জ ট্রেজারিতে রক্ষিত অস্ত্র-গোলাবারুদ ও ক্যাপ্টেন আবদুল হালিমের লাইসেন্সকৃত বন্দুক-পিস্তল মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহার শুরু হয়।
পরে মুক্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে আরিচা ফেরিঘাট বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু ১ এপ্রিল হেলিকপ্টারে করে সৈন্য নামিয়ে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক দখল নেয় হানাদারা। ওই দিনের মধ্যেই মানিকগঞ্জসহ বিভিন্ন থানা পাকিস্তান বাহিনীর দখলে চলে যায়।
জুলাই মাসে রাজাকার, আল-বদর ও শান্তি কমিটি গঠিত হয়। স্বাধীনতা বিরোধীরা হানাদারবাহিনীকে ধ্বংসযজ্ঞে সহায়তা করতে থাকে। ওদিকে ভারত থেকে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে প্রতিরোধ শুরু করেন।
পাকিস্তান বাহিনী, আল-বদর, আল-শামস, রাজাকারদের আক্রমণ ও ষড়যন্ত্র প্রতিরোধে মানিকগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধারা দুই ভাগে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। অক্টোবরের আগে পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের সব কাজই অস্থায়ী সরকারের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা মুক্তিবাহিনীরা করতেন।
জুলাই মাসের ১৭ তারিখে ঘিওর থানা আক্রমণ করে পাকিস্তান সেনাদের আহত করে অস্ত্র ও গোলাবারুদ হস্তগত করেন মুক্তিযোদ্ধারা। ১৮ আগস্ট হরিরামপুর থানায় প্রবেশ করলে মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধে মুখে পিছু হটে হানাদাররা।
অক্টোবর মাসের ১৩ তারিখে ক্যাম্প দখলের জন্য মুক্তিবাহিনী আক্রমণ করলে হানাদাররা পরাজিত হয়। এ সময় পাকিস্তানিদের দোসর পাঁচ রাজাকার সদস্য মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ অবলম্বন করে। তখন পাকিস্তান বাহিনীর ৭০টি রাইফেল, তিনটি এলএমজি ও সাত বাক্স গুলি মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে।
পাকিস্তান বাহিনী ক্যাম্প দখলের পর সেখানকার ওয়্যারলেস অফিস পুড়িয়ে দেওয়ার সময় আগুনে পুড়ে মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজুর রহমান মারা যান ও পানু মোল্লা আহত হন। ১৪ অক্টোবর বালিরটেক ও ১৫ অক্টোবর সুতালড়িতে পাকিস্তান বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ হয়। বালিরটেক যুদ্ধে দুজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ৫ অক্টোবর সিংগাইর থানার বায়রায় ধলেশ্বরী নদীর উত্তর পার থেকে নৌকায় চলাচলকারী পাকিস্তান বাহিনীর ওপর ব্রাশফায়ার করলে ১৫ সেনা নিহত হয়।
মানিকগঞ্জে সবচে বড় যুদ্ধ বলে খ্যাত সিংগাইরের গোলাইডাঙ্গা যুদ্ধ। এ যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন তোবারক হোসেন লুডু। গোলাইডাঙ্গা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প দখলের জন্য তিন শতাধিক পাকিস্তানি বাহিনী ১০ থেকে ১২টি নৌকায় সেখানে আসে। এ খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে অবস্থান নেয়। সেখানে দ্বিমুখী আক্রমণে একজন কর্নেলসহ পাকিস্তানি বাহিনীর ৮১ সদস্য মারা যায়।
২২ নভেম্বর পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী ও এ দেশীয় দোসরা তেরশ্রী, সেনপাড়া, বড়রিয়া এবং বড়বিলা গ্রামের ঘুমন্ত মানুষের ওপর নারকীয় তাণ্ডব চালায়। নির্বিচারে গুলি, বেয়নেট চার্জ ও বাড়ি ঘরে পেট্রল ঢেলে আগুন দিয়ে তেরশ্রী জমিদার সিদ্ধেশ্বর প্রসাদ রায় চৌধুরী, অধ্যক্ষ আতিয়ার রহমানসহ ৪৩ নিরীহ মানুষকে হত্যা করে তারা।
১০ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী ও তাদের স্থানীয় চিহ্নিত দোসররা অতর্কিত আক্রমণ করে মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার মিরপুর গ্রামে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ইসমাইল উদ্দিন মোল্লার বাড়ি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে। মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা আক্রমণ করলে প্রায় দুইঘণ্টা সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এতে মুক্তিযোদ্ধা মুনসুর আলম গুলিতে আহত হন। এক পর্যায়ে হানাদার বাহিনী এলাকার কোকারাম মণ্ডলকে হত্যা করে এবং আগুনে পুড়িয়ে দেয় এই গ্রামের প্রায় অর্ধশত বাড়িঘর।
১৩ ডিসেম্বর বিজয়ী বেশে মুক্তিযোদ্ধারা মানিকগঞ্জ সরকারি দেবেন্দ্র কলেজ মাঠে সমবেত হন। সেখানে আওয়ামী লীগ নেতা মাজহারুল হক চান মিয়ার সভাপতিত্বে এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ওই সমাবেশ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়।
নয়মাসব্যপী মুক্তিসংগ্রামে মানিকগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধে ৫৪ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। যুদ্ধে আহত হয়ে পঙ্গু হয়ে যান নয় মুক্তিসেনা। মুক্তিযুদ্ধে স্কোয়াড্রন লিডার (অব.) বদরুল আলম বীর প্রতীক, ইব্রাহীম খান বীর প্রতীক, শহীদ মাহফুজুর রহমান বীর প্রতীক ও মোহাম্মদ আতাহার আলী খান বীর প্রতীক খেতাব পান।
শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড, শহরে ও তেরশ্রী স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে।
মানিকগঞ্জে আজকের এই দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে প্রতি বছর উৎসব মুখর পরিবেশে পালন করা হয় ১৫ দিনব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের বিজয়মেলা। ১৯৯১ সাল থেকে শহরে মানিকগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এই মেলা পরিচালনা করছেন মুক্তিযোদ্ধারা। প্রতি বছরের মতো এবারও মেলায় সার্কাস, নাগরদোলা এবং বিভিন্ন খাবারের দোকানসহ দুই শতাধিক বিভিন্ন ধরনের স্টল স্থান পাচ্ছে।
মেলার সময়সূচি অনুযায়ী মঙ্গলবার রাত ১২টা ১ মিনিটে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বীরমুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট আবদুস সালামের সভাপতিত্বে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট গোলাম মহীউদ্দিন পাকিস্তানি হানাদারমুক্ত দিবসের শুভ সূচনা করেন।
আজ বিকেল ৩টায় বিজয়মেলা উদ্বোধন করবেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক স্বপন।
প্রতিদিন বিকেল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত মেলার মঞ্চে দেশাত্মবোধক গান, নৃত্য, আবৃত্তি, নাটক, মুক্তিযুদ্ধ ও বিষয়ভিত্তিক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এতে দেশবরেণ্য কবি, সাহিত্যিক, লেখক, বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এবং মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোকপাত করবেন।