মাহিদুর-আফসারের আমৃত্যু কারাদণ্ড

একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার মাহিদুর রহমান (৮৪) ও আফসার হোসেন চুটুকে (৬৫) আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। আজ বুধবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এর বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বেঞ্চ এ রায় দেন। বেঞ্চের অপর সদস্যরা হলেন বিচারপতি শাহিনুর ইসলাম ও বিচারপতি মুজিবুর রহমান।urgentPhoto
সকাল পৌনে ৮টার দিকে মাহিদুর ও আফসারকে ট্রাইব্যুনালে নেওয়া হয়। বেলা ১১টা ১৮ মিনিট থেকে ১১টা ৩২ পর্যন্ত ১৩৩ পৃষ্ঠার রায়ের সারসংক্ষেপ পড়ার পর ট্রাইব্যুনাল এ আদেশ দেন। মাহিদুর-আফসারের বিরুদ্ধে আনা তিনটি অভিযোগের দুটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে ১ নম্বর অভিযোগে আমৃত্যু কারাদণ্ড এবং অধিকাংশ বিচারকের রায়ে ২ নম্বর অভিযোগে পাঁচ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ৩ নম্বর অভিযোগে আগেই শাস্তি ভোগ করার কারণে এ মামলায় তাঁদের খালাস দেওয়া হয়েছে।
আসামিদের সকাল সাড়ে ১০টায় দিকে এজলাসে হাজির করা হয়। এ সময় তাঁদের খুব বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। রায় ঘোষণার সময় মাহিদুরের স্ত্রী ও মা উপস্থিত ছিলেন।
এ সময় রাষ্ট্রপক্ষে প্রধান প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ও শাহিদুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। আসামিপক্ষে উপস্থিত ছিলেন অ্যাডভোকেট আবদুস সোবহান তরফদার ও অ্যাডভোকেট আবদুস সাত্তার পালোয়ান।
এদিকে, ৩ নম্বর অভিযোগে আগেই শাস্তি দেওয়া সত্ত্বেও একই ঘটনায় নতুন করে অভিযোগ আনায় তদন্ত কর্মকর্তাকে তিরস্কার করেছেন আদালত। রায় ঘোষণার একপর্যায়ে আদালত বলেন, ১৯৭২ সালের দালাল আইনে ৩ নম্বর অভিযোগে তাঁদের দণ্ড দেওয়া হয়েছিল। তাঁরা শাস্তিও ভোগ করেছিলেন। কিন্তু বিষয়টি আদালতে উপস্থাপন না করে অভিযোগ গঠন করে তদন্ত কর্মকর্তারা ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। এ জন্য তাদের ৩ নম্বর অভিযোগ থেকে খালাস দেওয়া হলো। এ সময় ব্যর্থতার পাশাপাশি তদন্ত কর্মকর্তাদের অথর্বও বলেছেন ট্রাইব্যুনাল।
গত ২২ এপ্রিল মাহিদুর রহমান ও আফসার হোসেন চুটুর মামলার বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ হওয়ায় রায় ঘোষণা অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখেন ট্রাইব্যুনাল।
মাহিদুর ও আফসারের বিরুদ্ধে তিনটি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে।
অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালে মো. মাহিদুর রহমান ও মো. আফসার হোসেন চুটু বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সংগ্রামকে অস্বীকার করে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীকে সহযোগিতা করার জন্য সশস্ত্র রাজাকার বাহিনীতে যোগদান করেন।
রাজাকার বাহিনীর প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর তাঁরা চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জে থানার আদিনা ফজলুল হক ডিগ্রি কলেজ দখল করে সেখানে রাজাকার ক্যাম্প স্থাপন করেন। এর পর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থেকে ওই এলাকায় হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, ধর্মান্তরসহ নানা মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেন।
১ নম্বর অভিযোগ
১৯৭১ সালের ৬ অক্টোবর চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ এলাকায় ৩৯ জনকে আটক করে ২৪ জনকে হত্যা করা হয়। বাকিদের নির্যাতন করে পঙ্গু করে দেওয়া হয়।
২ নম্বর অভিযোগ
১৯৭১ সালের নভেম্বরে বিভিন্ন সময় তাঁরা শিবগঞ্জ এলাকায় প্রতিটি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে।
এ ছাড়া ৩ নম্বর অভিযোগে দালাল আইনে আগেই তাঁদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
গত ২৭ জানুয়ারি থেকে ৭ এপ্রিল পর্যন্ত মাহিদুর-আফসারের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা জেড এম আলতাফুর রহমানসহ রাষ্ট্রপক্ষের মোট ১০ সাক্ষী।
অন্য সাফাই সাক্ষীরা হলেন—মো. আহসান হাবীব, মো. মহিবুল হক, রইস উদ্দিন, জাকারিয়া, মো. মোখলেসুর রহমান, মো. ফসি আলম সান্টু, মো. খুদি, মহসীন আলী ও দাউদ হোসেন। অন্যদিকে মাহিদুর-আফসারের পক্ষে কোনো সাফাই সাক্ষী ছিল না।
গত ১২ জানুয়ারি মাহিদুর-আফসারের বিরুদ্ধে সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর সাহিদুর রহমান।
গত বছরের ১ ডিসেম্বর তিনটি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মাহিদুর রহমান ও মো. আফসার হোসেন চুটুর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল।
গত বছরের ২৪ নভেম্বর মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে মাহিদুর-আফসারের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। ১৬ নভেম্বর এ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেন প্রসিকিউটর সাহিদুর রহমান।
এ দুজনের বিরুদ্ধে গত বছরের ২৭ অক্টোবর তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে তদন্ত সংস্থা। পরদিন ২৮ অক্টোবর তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রসিকিউশনের কাছে জমা দেওয়া হয়। এর ভিত্তিতে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ তৈরি করে ট্রাইব্যুনালে দাখিল করেন প্রসিকিউশন।
এ মামলার তদন্ত শুরু হয় গত বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি। তদন্ত শেষে সাত খণ্ডে ৯৫৬ পৃষ্ঠার চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করা হয়।
মামলার নথি থেকে জানা যায়, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালীন শিবগঞ্জ উপজেলার বিনোদপুর স্কুলমাঠে ও এর আশপাশে সংগঠিত গণহত্যার ঘটনায় ২০১৩ সালে মাহিদুর রহমান ও আফসার হোসেন চুটুসহ ১২ জনকে আসামি করে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আদালতে একটি মামলা করা হয়। গণহত্যার শিকার শহীদ পরিবারের সদস্য শিবগঞ্জ উপজেলার মনাকষা ইউনিয়নের পারচৌকা গ্রামের বদিউর রহমান বুদ্ধ বাদী হয়ে মামলাটি করেন। পরে গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে শিবগঞ্জ উপজেলার দুর্লভপুর ইউনিয়নের দাদনচক গ্রামের মাহিদুর রহমান ও বিনোদপুর ইউনিয়নের সাতরশিয়া গ্রামের আফসার হোসেন চুটুকে নিজ নিজ বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।