কৃষকের ইশকুল

দেখতে হয়তো অন্য দশটা সাধারণ স্কুলের মতোই। শিক্ষক আছে, শিক্ষার্থী আছে। নিয়ম করে পড়াশোনাও আছে। ব্যতিক্রম শুধু শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে। এখানকার স্কুলের শিক্ষার্থীরা আর সব স্কুলের মতো নয়। এখানকার শিক্ষার্থীরা সবাই কিষান-কিষানি। হাতে-কলমে কৃষিবিষয়ক শিক্ষা নেওয়ার জন্যই তাঁরা এখানে আসেন। শিক্ষা শেষে তাঁরা ফিরে যান মাঠে।
কিশোরগঞ্জের ভৈরবে পরিচালিত হচ্ছে এই ‘কৃষক মাঠ স্কুল’। কৃষি অধিদপ্তরের উদ্যোগে পরিচালিত হচ্ছে এ স্কুল। সমন্বিত খামার ব্যবস্থাপনার আওতায় এ স্কুলে আর্থিক সহযোগিতা দিচ্ছে ডেনমার্ক সরকার।
শিক্ষার্থীরা জানান, এ স্কুলে তাঁরা মূলত সারা বছর বাড়ির আঙিনায় নানা রকমের বিষমুক্ত সবজি চাষ, হাঁস-মুরগি পালন, দেশীয় পদ্ধতিতে গরু-ছাগল মোটাতাজাকরণ, মৎস্য চাষ, ফলের আবাদ, ধানসহ অন্যান্য ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির নানা কৌশল শিখছেন এবং পরে এ জ্ঞান কাজে লাগিয়ে তাঁরা নিজেদের আর্থিক সক্ষমতা বাড়াচ্ছেন। পাশাপাশি পরিবারের সদস্যদের প্রয়োজনীয় পুষ্টির ব্যাপারেও তাঁরা সচেতন হচ্ছেন এ স্কুলের মাধ্যমে।
কৃষি অধিদপ্তরের ভৈরব কার্যালয় জানায়, এ স্কুলে সাধারণত এলাকার ভূমিহীন, প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষক পরিবারের সদস্যদেরই শিক্ষার্থী হিসেবে নির্বাচিত করা হয়।
তাঁদের দক্ষতা ও ক্ষমতায়নের সক্ষমতা তৈরি, কৃষক সংগঠন গড়ে তোলার মাধ্যমে তাঁদের ক্ষমতায়ন করা, সেবা প্রদানকারী সংস্থা, বাজার নিয়ন্ত্রণকারী এবং ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী সংস্থার সঙ্গে যোগসূত্র তৈরির কাজটিও এখান থেকে তাঁরা শিখতে পারেন।
একই পরিবারের কিষান ও কিষানি কৃষক মাঠ স্কুলের শিক্ষার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন। ২৫ জন কৃষক ও ২৫ জন কিষানি—মোট ৫০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে স্কুলটি পরিচালিত হয়। তাঁরা সপ্তাহে দুদিন স্কুলে এসে হাতে-কলমে শিক্ষা গ্রহণ করেন। টানা ৪২ সপ্তাহ পরিচালিত হওয়ার পর একেকটি স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রম শেষ হয়। শিক্ষা কার্যক্রম শেষে প্রতি শিক্ষার্থী দেড় হাজার টাকা পান। পাশাপাশি তাঁরা বিনামূল্যে বীজ, সার, গাছের চারাসহ হাঁস-মুরগি ও পশু পালনের খামার তৈরির সরঞ্জাম পেয়ে থাকেন।
ভৈরবের কালিকাপ্রসাদ ইউনিয়নের আতকাপাড়া, সিদ্দিরচর, শিবপুর ইউনিয়নের ছনছাড়া ও শিমুলকান্দি ইউনিয়নের পাঁচঘরহাটি, তেয়ারিরচর গ্রামের কৃষক রবিউল্লাহ, তাসলিমা, বাসির মিয়া, আবুল খায়ের, লিপি বেগমের মতো অনেকেই জানান, কৃষক মাঠ স্কুল থেকে সমন্বিত খামার ব্যবস্থাপনায় শিক্ষা গ্রহণ করে তাঁরা বেশ ভালো আছেন। তাঁদের উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধিসহ পরিবারে সচ্ছলতা ফিরে আসছে।
এই স্কুল থেকে যাঁরা ভালো ফল করেন, তাঁরাই আবার পরে স্কুলের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য শিক্ষক বা শিক্ষিকা হিসেবে নিয়োগ পান। প্রতিটি স্কুলে একজন কিষান ও একজন কিষানি শিক্ষক হিসেবে থাকেন। ওই কিষান-কিষানি শিক্ষকরা সপ্তাহে প্রতিটি ক্লাসের জন্য সাড়ে চারশ টাকা করে ভাতা পেয়ে থাকেন।
অন্যদিকে স্কুলগুলোর সার্বিক দেখাশোনার দায়িত্বে থাকেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। আর অতিথি শিক্ষক হিসেবে থাকেন উপজেলা মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। তাঁরাও ভাতা পান। স্কুলের সার্বিক সমন্বয়কারীর ভূমিকায় থাকেন সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা।
এ ব্যাপারে ভৈরব উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আবুল কালাম এনটিভি অনলাইনকে জানান, এখানকার শিক্ষা কাজে লাগিয়ে কৃষকরা ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কাজে ভালো ভূমিকা রাখছেন। এতে করে দেশের কৃষি ও অর্থনীতি উন্নতির চরম শিখরে উপনীত হবে।