পুলিশ বলেছিল আইএস আছে, তারাই বলছে অস্তিত্ব নেই

গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর। সামিউন রহমান নামে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এক ব্রিটিশ নাগরিককে সাংবাদিকদের সামনে হাজির করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ( ডিবি)। পরে সংবাদ সম্মেলনে গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান দাবি করেন, আটক সামিউন আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট বা আইএসের সদস্য।
সংবাদ সম্মেলনে ডিবি পুলিশের মুখপাত্র মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘সামিউন রহমানের দুটো উদ্দেশ্য ছিল- তাদের ভাষায়, শপ ওপেন ফর বাংলাদেশ অ্যান্ড মিয়ানমার। মানে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে শপ ওপেন করবে। মানে এই যে একিউআইএসের যে ঘোষণা ছিল সেই অনুসারে তারা কার্যক্রম চালাবে। সাথে সাথে যারা এই মুহূর্তে সিরিয়ায় যেতে চায় আইএসের সাথে কার্যক্রম কিংবা একিউএসের সাথে যারা যেই এলাকায় যেতে পারবে সেই এলাকায় যাদের আধিপত্য তাদের সাথেই তারা জিহাদে যোগদান করবে। এই রকম একটা প্রস্তুতির ভিত্তিতে তারা আলাপ আলোচনা করছিল।’
ডিবির দাবি, আটক সামিউন রহমান আগেও সিরিয়ায় আসা-যাওয়া করেছেন।
এ বছরের ২৫ মে রাজধানীর উত্তরা ও মোহাম্মদপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে আইএসের দুই সদস্য আমিনুল বেগ ও সাকিব বিন কামালকে আটক করে ডিবি পুলিশ। গোয়েন্দা পুলিশ জানায়, আটক দুজন রাজধানীতে জঙ্গি তৎপরতার সহায়তার কাজ করছিলেন। এদের মধ্যে আমিনুল বেগ পুলিশের কাছে স্বীকার করেছেন, নিষিদ্ধ ঘোষিত জেএমবির ২০ তরুণকে ইসলামী শাসনব্যবস্থা কায়েমের উদ্দেশ্যে প্রস্তুত করতে তিনি কাজ করছিলেন। ইসলামী রাষ্ট্র ও খেলাফতে বিশ্বাস করেই আমিনুল এই কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। তাঁর সহযোগী সাকিব আইএসের ট্রেনিং নিয়েছেন বলে জানায় ডিবি পুলিশ।
এ নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে গোয়েন্দা পুলিশের মুখপাত্র ও ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, আমিনুল ও সাকিবকে জিজ্ঞাসাবাদে যাঁদের নাম পাওয়া গেছে তাঁরা বেশির ভাগই বয়সে তরুণ এবং আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত। তাঁরা কথিত জিহাদে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক।
এ দুটি ঘটনায় দেখা যায় বাংলাদেশে ইসলামিক স্টেট বা আইএস সদস্য হিসেবে কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। দুটি সংবাদ সম্মেলনেই আটক ব্যক্তিদের সঙ্গে আইএসের সম্পৃক্ততা আছে বলে দাবি করেছে গোয়েন্দা পুলিশ।
শুধু এ দুটি ঘটনাই নয়। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৫ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত আইএস সদস্য হিসেবে অন্তত ২৩ জনকে আটক করেছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।
এর মধ্যেই গত মঙ্গলবার পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক দাবি করেছেন, দেশে আইএসের তৎপরতা নেই। পুলিশ সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত অপরাধ পর্যালোচনা ত্রৈমাসিক সভায় আইজিপি বলেন, ‘দেশে ইসলামী জঙ্গি সংগঠন আইএসের কোনো সাংগঠনিক তৎপরতা নেই।’
এর কয়েকদিন আগে একই কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল।
গত রোববার জাতিসংঘ সম্মেলন থেকে ফিরে এক সংবাদ সম্মেলনে দেশে আইএসের অস্তিত্ব নেই বলে জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সংবাদ সম্মেলন শেষে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকার জঙ্গিবাদীদের প্রশ্রয় দেয় না। এখন পর্যন্ত এখানে আইএসের কোনো ঘাঁটি গড়ে ওঠেনি।’
এর আগে গত ৩০ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ইতালির নাগরিক চেসারে তাভেলা হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, ‘বাংলাদেশে আইএসের কোনো অস্তিত্ব নেই। তাই ইতালির নাগরিক হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আইএস জড়িত নয়, এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত।’
দেশে আইএস না থাকলে যাদের আইএস পরিচয়ে এত দিন আটক করা হয়েছে তাদের পরিচয় কি সাংবাদিকরা তা জানতে চাইলে মন্ত্রী জানান, এদের সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করা হয়েছে।
ফিরে দেখা :
গত বছর ১৯ সেপ্টেম্বর জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) সাত সদস্যকে আটক করে পুলিশ। পুলিশ দাবি করে, আটক ওই সাত ব্যক্তির সঙ্গে আইএসের যোগাযোগ আছে।
এক সপ্তাহ পর ২৪ সেপ্টেম্বর আসিফ আদনান ও ফজলে এলাহী তানজিল নামের দুই ব্যক্তিকে আটক করে। পুলিশ দাবি করে, আইএসে যোগ দেওয়ার জন্য তাঁরা সিরিয়া যাওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছিল।
২৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর রামপুরা থেকে নিষিদ্ধ ঘোষিত হরকাতুল জিহাদের (হুজি) তিন সদস্যকে আটক করার কথা জানায় ডিবি। ডিবি দাবি করে, ওই তিন সদস্য আইএসের কর্মী।
পরের দিন অর্থাৎ ২৭ সেপ্টেম্বর আইএসের কর্মী সন্দেহে পুলিশ আরো এক ব্যক্তিকে আটক করে।
২৯ সেপ্টেম্বর সামিউন রহমান নামের বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিককে সাংবাদিকদের সামনে হাজির করে ডিবি। সংবাদ সম্মেলনে গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান জানান, আটক সামিউন আইএসের সদস্য। ডিবি আরো দাবি করে, আটক সামিউন রহমান আগেও সিরিয়ায় আসা-যাওয়া করেছেন।
চলতি বছর ১৯ জানুয়ারি জঙ্গি সন্দেহে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী ও খিলক্ষেত এলাকা থেকে চারজনকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ। সাখাওয়াত কবির, রবিউল ইসলাম, আনোয়ার হোসেন ও নজরুল ইসলাম নামের আটক ওই চার ব্যক্তির একজন বাংলাদেশ আইএস শাখার প্রধান সমন্বয়ক বলে দাবি করে ডিবি। বাকি তিনজন তাঁর সহকারী বলে জানায় ডিবি।
২৫ মে রাজধানীর উত্তরা ও মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে দুজনকে আটক করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। আটক আমিনুল বেগ ও সাকিব বিন কামাল আইএসের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন বলেও দাবি করে ডিবি পুলিশ। ডিবি জানায়, আমিনুল বেগ পুলিশের কাছে স্বীকার করেছেন, নিষিদ্ধ ঘোষিত জেএমবির ২০ তরুণকে ইসলামী শাসনব্যবস্থা কায়েমের উদ্দেশ্যে প্রস্তুত করতে তিনি কাজ করছিলেন।
৩১ মে পুলিশ আবদুল্লাহ আল গালিব নামের এক ব্যক্তিকে সাংবাদিকদের সামনে হাজির করে এবং দাবি করে তিনি আইএসের একজন নিয়োগকর্তা। ডিবি জানায় গালিবকে রাজধানীর বারিধারা ডিওএইচএস এলাকা থেকে আটক করা হয়েছে।
৯ জুন ফিদা মুনতাসির নামের এক ব্যক্তিকে আটকের কথা জানায় পুলিশ। পুলিশ দাবি করে, মুনতাসির স্বীকার করেছেন ইন্টারনেটের মাধ্যমে তিনি আইএসে নিয়োগ দেন। একই মাসের ২১ তারিখ পুলিশ দাবি করে ফাইয়াজ খান নামের এক আইএস কর্মী আটক হয়েছেন।
ভারতই সর্বপ্রথম জানায়
বাংলাদেশের নাগরিকদের সঙ্গে আইএসের সংশ্লিষ্টতা আছে এ বিষয়টি প্রথম জানায় ভারত। টাইমস অব ইন্ডিয়াসহ দেশটির বিভিন্ন গণমাধ্যম গত বছর ৬ সেপ্টেম্বর জানায়, ভারতের হায়দ্রাবাদ থেকে বাংলাদেশে আসার পথে আইএসের চার সমর্থককে আটক করেছে কলকাতা পুলিশ। পুলিশ জানায় আটক ওই চার যুবক আইএসে যোগ দিতে বাংলাদেশ হয়ে মধ্যপ্রাচ্যে যেতে চেয়েছিলেন।