‘আমগো গরুগুলারে বাঁচান বাজান’

‘কাল রাইতে গরু লইয়া ট্রাকে উঠছি। রাস্তায় আসার সময় দুইবার বৃষ্টি হইছে, আমরা তো ভিজে গেছিই, সাথে গরুগুলোও সব ভিজে গেছিল। সারা রাস্তা ভাঙাচুরা। ঝাঁকুনি খাইয়া গরুগুলার অবস্থা খারাপ। ঢাকায় আসার পর কয়টা গরু গাড়ি থাইকা নামাইছি আর এখনো ট্রাকের ওপরে বাকি গরুগুলো আছে। হাটে নামাইতে দিচ্ছে না, বান্ধি রাখার জায়গাও দিচ্ছে না। একটা গরু সকালে মইরা গেছে, আরগুলা অসুস্থ হইছে। আমগো গরুগুলারে বাঁচান বাজান।’
এভাবেই আজ শনিবার বেলা ১১টার দিকে গাবতলীর পশুর হাটের হাসিল অফিসের পাশে দাঁড়িয়ে এনটিভি অনলাইনকে কথাগুলো বলছিলেন বয়োবৃদ্ধ গরু বিক্রেতা মো. মাসুদ রানা। আর তাঁর পাশেই দাঁড়িয়ে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন হাটে গরু নিয়ে আসা আরো কয়েকজন ব্যবসায়ী।
মো. মাসুদ রানা জানান, গতকাল রাতে তারা কয়েকজন ব্যবসায়ী মিলে কুষ্টিয়া থেকে ২২টি গরু নিয়ে ঢাকায় এসেছেন। আর আসার পথে রাস্তায় গাড়ির ঝাঁকুনি এবং বেশ কয়েকবার বৃষ্টিতে গরুগুলো অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ঢাকায় নিয়ে আসার পর গরুগুলোর খাবার ও বিশ্রামের দরকার ছিল। কিন্তু ভোরবেলা গাবতলী পৌঁছানোর পর গরুগুলোকে গাড়ি থেকে নামাতে পারেননি তাঁরা।
গাবতলী গরুর হাটে গরু নামাতে গেলে কয়েকজন ব্যক্তি এসে তাঁদের কাছে ৩০ হাজার টাকা দাবি করেন। তাই কয়েকটি গরু ট্রাক থেকে নামিয়ে রাস্তার পাশে একটি স্থানে রাখতে পারলেও বাকি গরুগুলো বেলা ১১টায় রোদের মধ্যে ট্রাকের ওপরেই ছিল।
এই অবস্থাতেই মো. মাসুদ রানার একটি গরু মারা যায়। মারা যাওয়া গরুটির দাম প্রায় এক লাখ ৩০ হাজার টাকা বলে এনটিভি অনলাইনকে জানিয়েছেন এই গরু ব্যবসায়ী।
কুষ্টিয়া থেকে আসা ওই ব্যবসায়ী জানান, একটি গরু মারা যাওয়ার পর আরেক ব্যবসায়ীর পরামর্শে তাঁরা পুলিশের কাছে সাহায্য চান। তখন ঘটনাস্থলে উপস্থিত পুলিশ সদস্যরা ৩০ হাজার টাকা দাবি করা ব্যক্তিতে খুঁজতে থাকেন।
পরে স্থানীয়রা বিষয়টি গাবতলী গবাদি পশুর হাটের বর্তমান সভাপতি মো. মজিবুর রহমানকে জানান। কিছুক্ষণ পর তিনি নিজেই চলে আসেন হাটে। এরপর ব্যবসায়ীদের কথা শুনে তাঁদের গরু রাখার স্থান নির্দিষ্ট করে দেন।
মো. মজিবুর রহমান এনটিভি অনলাইনকে জানান, প্রতিবছরই হাটের নির্দিষ্ট দিন শুরু হওয়ার আগেই অনেকে পশু নিয়ে চলে আসেন বলে পশু রাখার ব্যবস্থা নিয়ে ঝামেলা তৈরি হয়। তবে চলতি বছর পর্যাপ্ত জায়গা আছে দাবি করে গাবতলী পশুর হাটের বর্তমান সভাপতি জানান, হাটে কোনো পশু রাখতে সমস্যা হলে বা কেউ বাড়তি টাকা দাবি করলে তা সরাসরি হাসিল অফিসে জানাতে অনুরোধ করেছেন।
এদিকে কুষ্টিয়া থেকে আসা ব্যবসায়ী জামাল মিয়া বলেন, ‘এবারের ইনকাম শেষ। এক লাখ ৩০ হাজার টাকার গরুডা মরছে। সব গরু বেইচ্যা কয় টাকাই বা লাভ হইবে। তাই আপনাগো কাছে অনুরোধ, এই গরুগুলারে বাঁচানের ব্যবস্থা কইরা দেন।’
এদিকে রাজধানীর পশুর হাট গাবতলীতে গিয়ে দেখা গেছে, আসন্ন ঈদুল আজহা উপলক্ষে সারা দেশ থেকে পশু আসতে শুরু করেছে। দেশের অন্যতম বড় এই পশুর হাটকে সাজিয়ে গুছিয়ে তুলছে কর্তৃপক্ষও। প্রস্তুতির কাজ এরই মধ্যে অনেকটা শেষ। খোলা আকাশের নিচে সামিয়ানা টাঙিয়ে নিচে সারিবদ্ধভাবে বাঁশ দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে গরু বেঁধে রাখার স্থান। হাটের ফটকও সাজানো হয়েছে সুন্দরভাবে।
কিন্তু হাটে আশানুরূপ পশু এলেও দেশের অন্যতম বৃহত্তম এই পশুর হাট এখনো ক্রেতাশূন্য। এক বিক্রেতা জানালেন, এই হাটে সাধারণত কোরবানির ঈদের তিনদিন আগে থেকে বেচাকেনা শুরু হয়। আর সিটি করপোরেশনের নিয়ম অনুযায়ী ঈদের তিনদিন আগে থেকে রাজধানীর পশুর হাটগুলোতে পশু কেনাবেচা শুরু হবে। তাই এখনো জমে ওঠেনি এই পশুর হাট।
তবে গাবতলীতে যেহেতু নিয়মিত হাট বসে, তাই এখন থেকেই পশু বেচাকেনা চলছে। আজ শনিবার গাবতলীর পশুর হাটে গিয়ে এই চিত্র দেখা গেছে।
গরু বেঁধে নিয়ে যাওয়ার জন্য দড়ি ও গরুকে সাজানোর জন্য নানা রকমের কাগজের ফুলের দোকানও বসেছে গাবতলীর এই হাটে।
হাটের নিরাপত্তার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে থেকে বিভিন্ন স্থানে বসানো হয়েছে ওয়াচ টাওয়ার। এ ছাড়া র্যাব ও পুলিশের পক্ষ থেকে বসানো হয়েছে দুটি অস্থায়ী কন্ট্রোলরুমও। গাবতলী পশুর হাটের সভাপতি মজিবুর রহমান এনটিভি অনলাইনকে জানান, হাটের ক্রেতা-বিক্রেতা কেউই যেন কোনো প্রতারণার শিকার না হন, সে কারণেই এসব নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
যশোর থেকে গাবতলীর হাটে গরু নিয়ে আসা জামাল উদ্দিন নামের এক ব্যবসায়ী এনটিভি অনলাইনকে জানান, গতকাল শুক্রবার বিকেলে কয়েকজন মিলে ১৬টি গরু নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন। রাত ৩টার দিকে হাটে পৌঁছেছেন। সকালে ট্রাক থেকে গরু নামিয়ে রেখে তাঁরা সকাল থেকে বিশ্রাম নিচ্ছেন এবং গরুগুলোকেও বিশ্রাম নেওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আজ তাঁরা গরু বিক্রি করবেন না, কারণ এখনো হাটে আশানুরূপ ক্রেতা দেখছেন না। সে কারণে গরুগুলোকে বিশ্রামে রেখে তরতাজা করে তুলছেন বিক্রেতারা।
ওই ব্যবসায়ী আরো জানান, বেশ কয়েক বছর ধরে কোরবানির ঈদের সময় ঢাকায় গরু বিক্রি করতে আসেন তাঁরা। অধিকাংশ সময় কোরবানির আগের দু-একদিনে বেশি গরু বিক্রি হওয়ায় ঈদের আগমুহূর্ত পর্যন্ত তাঁদের হাটে অবস্থান করতে হবে। এ জন্য তাঁরা হাঁড়ি-পাতিল, চাল-ডাল ইত্যাদি নিয়ে এসেছেন।
গাবতলী হাটের ভেতরে হাসিলঘরের পাশে বেশ কয়েকটি দেশি জাতের ছাগল নিয়ে এক ব্যক্তিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। কথা হয় তাঁর সঙ্গে। জানালেন তাঁর নাম শরীফ হোসেন, বাড়ি ফরিদপুরে। নিজের বাড়িতেই তাঁর ছোট একটি ছাগলের খামার রয়েছে। প্রতিবছরই ঈদের সময় নিজের খামারের ছাগল নিয়ে ঢাকায় আসেন বিক্রির জন্য। এ বছর হাটে নয়টি ছাগল নিয়ে এসেছেন।
শরীফ হোসেন জানান, প্রতিবছর গাবতলীর পশুর হাটে বিক্রেতা আসার পর পশু রাখার জায়গা নির্ধারিত হয়। এ বছর ঈদের হাটে পশু রাখার জায়গা এখন পর্যন্ত নির্ধারণ হয়নি। এ কারণে ছাগল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। আর তাঁর ছেলে গিয়েছে হাট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে ছাগল রাখার ব্যবস্থা করতে।
গাবতলীর পশুর হাটের মূল ফটকের পাশেই বিভিন্ন ধরনের ঘাস, খড় বিক্রি করা হচ্ছে। ঘাস বিক্রি করতে আসা হামেদ আলী নামের এক ব্যক্তি এনটিভি অনলাইনকে জানান, এই হাটে সারা বছরই ঘাস বিক্রি করেন তিনি। তবে কোরবানির ঈদে হাটে গরু-ছাগল বেশি আসে, তাই তাঁর বিক্রিও বেশ ভালো হয়। এক আঁটি ঘাস পাঁচ টাকায় বিক্রি করছেন তিনি। তবে হাট পুরোদমে শুরু হলে এই ঘাসের চাহিদা বেড়ে যাবে। তখন ১০ টাকায় বিক্রি করবেন এক আঁটি ঘাস।
সিটি করপোরেশনের নিয়ম অনুযায়ী ঈদের তিনদিন আগে থেকে রাজধানীর পশুর হাটগুলোতে পশু কেনাবেচা শুরু হবে। তবে গাবতলীতে যেহেতু নিয়মিত হাট বসে, তাই এখন থেকেই পশু বেচাকেনা চলছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে গাবতলী পশুর হাট কার্যালয়ের এক কর্মচারী জানান, ঈদের হাটের নির্ধারিত দিনের আগে এখানে যে পশুগুলো কেনাবেচা হবে, তা হাটের বর্তমান ইজারাদারের আওতাভুক্ত।
গাবতলী পশুর হাটের সভাপতি মজিবুর রহমান এনটিভি অনলাইনকে বলেন, সিটি করপোরেশনের বেঁধে দেওয়া সময় ঈদের তিনদিন আগে কোরবানির পশুর হাট বসবে। হাটের কার্যক্রমকে সফল করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও হাট কর্তৃপক্ষ নিরলস কাজ করে চলছে।
এবারের ঈদ উপলক্ষে রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় ২২টি পশুর হাট বসার কথা রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ১৩টি এবং উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় নয়টি।