টানা ১৪৬ কিলোমিটার সাঁতার কাটলেন মুক্তিযোদ্ধা

সাঁতারে নতুন রেকর্ড গড়লেন নেত্রকোনার মদন উপজেলার বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা ক্ষিতিন্দ্র চন্দ্র বৈশ্য। ৬৬ বছর বয়সে আবারও সাঁতারে নেমে ১৪৬ কিলোমিটার নদীপথ বিরামহীনভাবে পাড়ি দিলেন তিনি। এই পথ পাড়ি দিতে তিনি সময় নেন ৪৩ ঘণ্টা।
এই সাঁতার আয়োজন করে মদন নাগরিক কমিটি ও ফুলপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ। গত শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা ৫০ মিনিটে ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার ঠাকুর বাঘাইঘাটের সরচাপুর সেতুর পাশে কংস নদ থেকে সাঁতার শুরু করেন। বিরামহীন একক সাঁতার কেটে করে দুই দিন দুই রাত পর আজ রোববার দুপুর ২টা ১ মিনিটে তিনি নেত্রকোনার মদন উপজেলা সদরের দেওয়ান বাজারের ঘাটে মগড়া নদী থেকে উঠে আসেন ডাঙ্গায়। এ সময় নদীর দুই তীরে হাজারো মানুষ কৃতী এই সাঁতারুকে দেখার জন্য ভিড় জমান। ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনার মাধ্যমে উৎসুক জনতা তাঁকে অভিবাদন জানান।
এ সময় মদন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. রফিকুল ইসলাম আকন্দ, পৌরসভার মেয়র আব্দুল হান্নান তালুকদার শামীম, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ওয়ালী উল হাসান, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল কদ্দুছ, সাধারণ সম্পাদক আবুল বাশার খান এখলাছ মুক্তিযোদ্ধা সাঁতারুকে বরণ করে নেন।
পরে পানি থেকে তুলে ক্ষিতিন্দ্র চন্দ্র বৈশ্যকে দায়িত্বপ্রাপ্ত উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. খান মোহাম্মদ ফজলুল বারী ইভানের নেতৃত্বে অ্যাম্বুলেন্সে করে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে শ্বাস প্রশ্বাসে কিছুটা সমস্যা হলে অক্সিজেন দিয়ে রাখা হয়। পরে তিনি উপজেলা সদরের বৈশ্যপাড়ায় নিজ বাড়িতে ফিরেন।
ইউএনও ওয়ালী উল হাসান বলেন, ক্ষিতিন্দ্র চন্দ্র বৈশ্য আগেও এভাবে বিরামহীন সাঁতার কেটেছেন। এবার তাঁকে সহযোগিতার করার জন্য সঙ্গে সব সময় দুটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা ছিল এবং সাঁতার চলার সময় তাঁকে তরল জাতীয় সামান্য খাবার দেওয়া হতো।
ক্ষিতিন্দ্র চন্দ্র বৈশ্য এ যাবৎকালে দেশে এবং বিদেশে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে সম্মাননা অর্জন করেন। এ ছাড়া তিনি বিভিন্ন সাঁতারে রেকর্ড গড়েছেন। সাঁতার প্রদর্শনী ও রেকর্ড সৃষ্টির স্বীকৃতি হিসেবে অসংখ্য পুরস্কার-সম্মাননা পেয়েছেন ।
ক্ষিতিন্দ্র চন্দ্র বৈশ্য নেত্রকোনার মদন উপজেলার জাহাঙ্গীরপুর গ্রামের ক্ষিতিশ চন্দ্র বৈশ্যর ছেলে। তিনি বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের অ্যারোড্রাম কর্মকর্তা হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।
ক্ষিতিন্দ্রকে সম্মাননা
এই সাঁতারুর এমন কৃতিত্বে মদন উপজেলা প্রশাসন, নাগরিক কমিটি, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতাদের আয়োজনে মগড়া নদীর পাড়ে হাজারো লোকের সমাগম ঘটে। পরে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড ও নাগরিক কমিটি আলাদা আলাদা সম্মাননা স্মারক তুলে দেয়।
মদনের ইউএনও মো. ওয়ালী উল হাসান মদনবাসীর পক্ষ থেকে এই কৃতিত্বকে বিশ্ব রেকর্ডে স্থান দেওয়ার দাবি জানান। করতালি দিয়ে শুরু
সাঁতার শুরু উপলক্ষে কংস নদের তীরে শুক্রবার বিকেলে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ময়মনসিংহ-২ (ফুলপুর-তারাকান্দা) আসনের সংসদ সদস্য শরীফ আহমেদ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। বিশেষ অতিথি ছিলেন ফুলপুরের ইউএনও মোহাম্মদ রাশেদ হোসেন চৌধুরী ও উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান।
ফুলপুর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার এমএ হাকিম সরকারেরর সভাপতিত্বে ও ব্যবসায়ী গোলাম মুর্তুজা তালুকদারের পরিচালনায় অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন মদন উপজেলা নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক দেওয়ান মোদাচ্ছের হোসেন, ফুলপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম ও সাবেক চেয়ারম্যান রিয়াজ উদ্দিন তালুকদারসহ বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা, সাংবাদিক ও মদন উপজেলার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ।
বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্ষিতিন্দ্র চন্দ্র বৈশ্য যখন সন্ধ্যা ৬টা ৫০ মিনিটে পানিতে নামলেন তখন হাজারো মানুষ করতালি দিয়ে উৎসাহ জোগান।
১৯৭০ সাল থেকে শুরু
সাঁতারু ক্ষিতিন্দ্র চন্দ্র বৈশ্য ১৯৭০ সালে সিলেটের ধুপাদীঘি পুকুরে অরুণ কুমার নন্দীর বিরামহীন ৩০ ঘণ্টার সাঁতার প্রদর্শনী দেখে উদ্বুদ্ধ হন। পরে একই বছর মদনের জাহাঙ্গীরপুর উন্নয়ন কেন্দ্রের পুকুরে তিনি ১৫ ঘণ্টার সাঁতার প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করে আলোচিত হন। এটিই তাঁর প্রথম সাঁতার প্রদর্শনী। পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে সিলেটের রামকৃষ্ণ মিশন পুকুরে ৩৪ ঘণ্টা, সুনামগঞ্জের সরকারি হাইস্কুলের পুকুরে ৪৩ ঘণ্টা, ১৯৭৩ সালে ছাতক হাইস্কুলের পুকুরে ৬০ ঘণ্টা, সিলেটের এমসি কলেজের পুকুরে ৮২ ঘণ্টা এবং ১৯৭৪ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথহলের পুকুরে ৯৩ ঘণ্টা ১১ মিনিট বিরামহীন সাঁতার প্রদর্শন করে জাতীয় রেকর্ড সৃষ্টি করেন। জাতীয় রেকর্ড সৃষ্টি করায় ওই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ক্লাস বন্ধ ঘোষণা করা হয় এবং ডাকসুর উদ্যোগে ক্যাম্পাসে বিজয় মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭৬ সালে তিনি জগন্নাথ হলের পুকুরে ১০৮ ঘণ্টা ৫ মিনিট সাঁতার প্রদর্শন করে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেন। এর স্বীকৃতি হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জগন্নাথ হলের পুকুর পাড়ে একটি স্মারক ফলক নির্মাণ করে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে ঢাকা স্টেডিয়ামের সুইমিং পুল, মদন উপজেলা পরিষদের পুকুর এবং নেত্রকোনা পৌরসভার পুকুরে তাঁর একাধিক সাঁতার প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। ভারতেরও দূরপাল্লার সাঁতার প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন তিনি। ১৯৮০ সালে মাত্র ১২ ঘণ্টা ২৮ মিনিটে মুর্শিদাবাদের ভাগিরথী নদীর জঙ্গীপুর ঘাট থেকে গোদাবরী ঘাট পর্যন্ত ৭৪ কিলোমিটার নদীপথ পাড়ি দেন। সাঁতার প্রদর্শনী ও রেকর্ড সৃষ্টির স্বীকৃতি হিসেবে অসংখ্য পুরস্কার-সম্মাননা পেয়েছেন তিনি।
সাঁতার শুরুর আগে শুক্রবার ক্ষিতিন্দ্র চন্দ্র বৈশ্য বলেছিলেন, ‘সিলেট অরুন নন্দীর একক সাঁতার দেখে আমি সাঁতার প্রদর্শনীতে উদ্দীপনা পেয়েছি। শেরপুরের নালিতাবাড়ী থেকে সাঁতার দেওয়ার কথা থাকলেও নানা প্রতিকূলতায় ফুলপুর সরচাপুর কংস থেকে সাঁতার শুরু করছি। জীবনে অনেক সাঁতার কেটেছি, এটাই হবে হয়তো আমার শেষ সাঁতার। মদন নাগরিক কমিটি ও ফুলপুর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ তাঁরা এমন একটি সাঁতারের আয়োজন করার জন্য।’
আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক মদন পৌরসভার সাবেক মেয়র সমাজসেবক দেওয়ান মোদাচ্ছের হোসেন শফিক ও ফুলপুর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মো. আবদুল হেকিম বলেন, ক্ষিতিন্দ্র চন্দ্র বৈশ্যর দীর্ঘ দিনের ইচ্ছে ছিল এমন একটি সাঁতারের আয়োজনের মাধ্যমে তিনি গ্রিনিজ ওয়ার্ল্ড বুকে স্থান পাবেন। তাঁর শেষ ইচ্ছা পূরণ করার জন্যই তাঁরা এই আয়োজন করেন।