‘বাবার অনেক ডলার আছে’ বলে প্রেম, লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ব্যবহার করে নতুন নতুন বন্ধু পাওয়া এখন বেশ সাধারণ ঘটনা। এই মাধ্যম ব্যবহার করে দেশি-বিদেশি মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেন অনেকেই। তেমনি একজন মো. কামরুজ্জামান।
পুলিশ জানায়, কিছুদিন আগে প্রিসকা খলিফা (Prisca Khalifa) নামের প্রোফাইল ব্যবহার করা একজনের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় কামরুজ্জামানের। ওই প্রোফাইলের মালিক নিজেকে ভিনদেশি নারী হিসেবে কামরুজ্জামানের কাছে পরিচয় দেন। বেশ কিছু দিন যোগাযোগের পর দুজনের বন্ধুত্ব ‘প্রেমে’ রূপ নেয়। একদিন প্রিসকা খলিফা প্রোফাইল থেকে ওই কথিত বিদেশি নারী কামরুজ্জামানকে বলেন যে, তাঁর বাবা ড. ডেভিড উইলসন খলিফা (Dr. David Wilson Khalifa) কিছু দিন আগে মারা গেছেন। লন্ডনের একটি ব্যাংকে যার অ্যাকাউন্টে ৩ দশমিক ৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার জমা আছে। এই ডলার অ্যাকাউন্ট থেকে তোলার জন্য একজন বিশ্বস্ত মানুষ এবং কিছু অর্থ প্রয়োজন। ডলারগুলো তোলা হলে তা প্রেমিক কামরুজ্জামানকে পাঠাবেন বলেও জানান তিনি।
পুলিশ আরো জানায়, এ কথা শুনে প্রয়োজনীয় অর্থ দিতে রাজি হন কামরুজ্জামান। এরপর তিনি প্রতারক চক্রের সদস্য লিজা আক্তার এবং মোহসিন নামের দুজনের অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ধাপে ধাপে ২৫ লাখ ৪৪ হাজার ১৪৪ টাকা পাঠান। কিন্তু এরপরও আরো টাকা চাইতে থাকেন ওই নারী। একপর্যায়ে কামরুজ্জামান বুঝতে পারেন যে সম্ভবত তিনি কোনো প্রতারকদের পাল্লায় পড়েছেন।
একইভাবে একই প্রতারক চক্রের পাল্লায় পড়ে ৪০ লাখ ৩৮ হাজার টাকা খুইয়েছেন মো. শাহনুর হোসেন নামের আরেক ব্যক্তি। প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পেরেই তাঁরা শরণাপন্ন হন গোয়েন্দা পুলিশের।
সুনির্দিষ্ট এসব অভিযোগের ভিত্তিতে এ প্রতারকর চক্রটির সাত সদস্যকে গতকাল বুধবার গ্রেপ্তার করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সদস্যরা। এঁদের মধ্যে নাইজেরিয়ার চার নাগরিকও রয়েছেন। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে এঁদের গ্রেপ্তার করা হয়।
গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিরা হলেন- জন আগডি ইউজিও, আফেজ, মাইকেল ইউজিনি ব্রাউন, নামডি কেলভিন, লিজা আক্তার ওরফে অ্যাসতা, মো. মহসিন শেখ, মোছা. তাসমিয়া পারভীন ওরফে সিমু।
আজ বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টায় ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান ডিবির যুগ্ম কমিশনার আবদুল বাতেন।
বাতেন জানান, গ্রেপ্তার প্রতারক চক্রের সদস্যরা প্রথমে নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির সঙ্গে ফেসবুক বা অনলাইনের মধ্যমে যোগাযোগ করে বন্ধুত্ব তৈরি করে। এরপর তাঁর সঙ্গে কিছু দিন কথা বলে প্রেমের সম্পর্ক তৈরি করে। প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হওয়ার পর প্রেমিকা বা প্রেমিককে জানায় যে, তিনি নাইজেরিয়া, মালি বা আফ্রিকায় থাকেন। তাঁর বা তাঁর বাবার ব্যাংকে অনেক টাকা আছে, সে টাকাগুলো বাংলাদেশের প্রেমিকের কাছে পাঠাবেন। তবে এই টাকা পাঠাতে হলে কিছু টাকা খরচ করতে হবে। এ রকম নানা ধরনের কথা বলে প্রেমিক বা প্রেমিকার কাছে থেকে আস্তে আস্তে টাকা নিতে থাকে চক্রের সদস্যরা।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন ধরে গার্মেন্টস ব্যবসার আড়ালে তাঁরা এই ধরনের প্রতারণামূলক কাজ করে বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে টাকা আত্মসাৎ করে আসছেন। এ জন্য তাঁরা ফেসবুক, ই-মেইল, হোয়াটস অ্যাপসসহ নানা রকমের প্রযুক্তি ব্যবহার করেন বলেও জানান বাতেন। তিনি বলেন, এ কাজে তাঁদের সহায়তা করেন কিছু অসাধু মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ী।
গ্রেপ্তার হওয়া সাতজনের বিরুদ্ধে উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি মামলা করা হয়েছে বলে জানান আব্দুল বাতেন।
এ ছাড়া দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষকে লোভ দেখিয়ে বিদেশে পাঠানোর নাম করে টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মো. জামাল হোসেন ও মো. মজিবুর রহমান নামে দুই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের কথাও সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়। গতকাল রাজধানীর পল্টন এলাকায় অভিযান চালিয়ে এদের গ্রেপ্তার করা হয়।
পুলিশ কর্মকর্তা বাতেন জানান, জামাল ও মজিবুর মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত। তাঁরা দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজনকে বিদেশে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে প্রতারণা করে টাকা আত্মসাৎ করত। আবার কাউকে কাউকে ট্যুরিস্ট ভিসার মাধ্যমে বিদেশে পাঠিয়ে দিত। কিন্তু বিদেশে পাঠানোর পর সেই দেশে অবস্থান করা এই চক্রের অন্য সদস্যরা ওই ব্যক্তিকে বিমানবন্দর থেকে নিয়ে গিয়ে সুবিধাজনক স্থানে আটকিয়ে রাখত। পরে দেশে থাকা আটক ব্যক্তির পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে আরো অর্থ আত্মসাৎ করত। এই দুজনের বিরুদ্ধে পল্টন থানায় একটি মামলা করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।