স্বামীর ‘ধাক্কা’য় ছাদ থেকে পড়ে যাওয়া শাহিনূরের গল্প

এক মাসেরও বেশি সময় রাজধানীর জাতীয় জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতালে) একটি বিছানায় শুয়ে আছেন ২০ বছরের শাহিনূর আক্তার পপি। একা একা উঠে বসতে পারেন না। এমনকি বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করতেও আরেকজনের সাহায্য লাগে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শাহিনূরের বাবা মো. শরীফ মিয়া দিনমজুর। তারপরও অনেক কষ্ট করে মেয়েকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত লেখাপড়া করিয়েছেন। মেয়ের ইচ্ছে ছিল আরো লেখাপড়া করার কিন্তু অসচ্ছলতার কারণে তা আর সম্ভব হয়নি। তাই পারিবারিকভাবে শাহিনূরের বিয়ে দেওয়া হয় নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর থানা এলাকার মো. সোহেল মিয়ার সঙ্গে। বিয়ের সময় যৌতুক হিসেবে সোহেল মিয়াকে নগদ দুই লাখ টাকা, সোনার গহনা, টেলিভিশন, ফ্রিজসহ প্রায় চার লাখ টাকার মালামাল দেন শাহিনূরের বাবা।
আরো জানা যায়, বিয়ের পর যৌতুকের দুই লাখ টাকা পেয়ে সোহেল মিয়া মালয়েশিয়া চলে যান কাজের উদ্দেশে। সেখানে অবস্থান করার সময়ই শ্বশুরবাড়িতে আরো দুই লাখ টাকা দাবি করেন তিনি। টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানানোয় শাহিনূরের ওপর শুরু হয় নানা রকম শারীরিক মানসিক অত্যাচার। কিছু দিনের মধ্যেই দেশে ফিরে আসেন সোহেল মিয়া। এরপর প্রতিনিয়ত যৌতুকের জন্য মারধর করতে থাকেন স্ত্রীকে। এসব বিষয় নিয়ে একাধিকবার স্থানীয় পর্যায়ে শালিস বিচারের মাধ্যমে মীমাংসা করা হয়। তবে সোহেল মিয়ার নির্মম নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে বিয়ের প্রায় দুই বছর পর আদালতে একটি সিআর মামলা করেন শাহিনূর। মামলা দায়েরের পর গত ২০ মে স্থানীয় কলাগাছি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দেলোয়ার প্রধানের কার্যালয়ে আয়োজিত সালিশে স্ত্রীকে আর মারপিট করবেন না বলে অঙ্গীকার করে শাহীনূরকে বাড়িতে নিয়ে যান সোহেল।
কিন্তু এরপর এক সপ্তাহ পার না হতেই গত ২৮ মে সোহেল মিয়া এবং তাঁর পরিবারের সদস্যরা মামলা সংক্রান্ত বিবাদের জেরে আবারও মারধর শুরু করেন শাহিনূরকে। একপর্যায়ে জীবন বাঁচাতে শাহিনূর দৌড়ে বাড়ির ছাদে চলে যান। কিন্তু তবুও রক্ষা পায় না। সোহেল মিয়া দৌড়ে ছাদে গিয়েও শাহিনূরকে মারতে থাকেন। একপর্যায়ে তাঁকে ছাদ থেকে ফেলে দেওয়া হয়।
খবর পেয়ে শাহিনূরের বাবা-মা দ্রুত তাঁকে উদ্ধার করে প্রথমে একটি বেসরকারি হাসপাতালে এবং পরে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পূর্বাসন প্রতিষ্ঠান (পঙ্গু হাসপাতালে) ভর্তি করেন।
ছাদ থেকে পড়ে যাওয়ার কারণে শাহিনুরের মেরুদণ্ডের কয়েকটি হাড় ভেঙে গেছে। বর্তমানে শাহিনুর পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে।
শাহিনূরের কথা
ঘটনা সম্পর্কে শাহিনূর এনটিভি অনলাইনকে বলেন, বিয়ের পর থেকেই তাঁর স্বামী কারণে অকারণে তাকে নানা রকম অত্যাচার করত। বিয়ের সময় প্রায় চার লাখ টাকার জিনিস দেওয়ার পরেও তাঁর বাবার কাছ থেকে আরো টাকা আনতে বলতেন। সব কিছু সহ্য করে চুপচাপ সংসার করে আসছিলেন তিনি। কিন্তু অত্যাচার এবং মারপিটের মাত্রা বেশি হওয়ার কারণে তিনি স্বামীর বাড়ি থেকে বাবার বাড়িতে চলে যান। এরপর তিনি তাঁর স্বামী সোহেল মিয়ার বিরুদ্ধে আদালতে একটি মামলা করেন। কিন্তু স্থানীয় সালিশের মাধ্যমে আপস করে সোহেল মিয়া তাঁকে বাসায় নিয়ে যান।
ঘটনার দিন শাহীনূরের সঙ্গে ঝগড়া শুরু করেন সোহেল মিয়া ও তাঁর বাড়ির অন্যান্য লোকজন। একপর্যায়ে তাঁর বাড়ির লোকজনসহ সোহেল মিয়া তাঁকে পেটাতে শুরু করেন। ওই সময় কেউ তাঁকে বাঁচাতে আসেনি অভিযোগ শাহিনূর বলেন, জীবন বাঁচাতে দৌড়ে ছাদে ওঠেন তিনি। কিন্তু সেখানেও রেহাই মেলেনি। উল্টো মারতে মারতে ছাদ থেকে তাঁকে ফেলে দেন সোহেল।
মাটিতে পড়ে ‘মা মা’ চিৎকার করে জ্ঞান হারান শাহিনূর। যখন জ্ঞান ফেরে নিজেকে হাসপাতালে পান তিনি।
ঘটনা সম্পর্কে শাহিনুরের বাবা মো. শরীফ মিয়া এনটিভি অনলাইনকে বলেন, বিয়ের সময় জামাইয়ের চাহিদামত টাকা ও অনান্য জিনিসপত্র দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কয়েক মাস পার না হতেই আবার টাকা দাবি করে জামাই। আর এ কারণে নানা সময়ে মেয়ের ওপরে অনেক অত্যাচারও চলত।
অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে এক পর্যায়ে তাঁর মেয়ে মামলা করেন। কিন্তু পরে সালিশে মীমাংসা হলে মেয়ের সংসার যেন ভেঙে না যায় সে কারণে আবার তাঁকে শ্বশুরবাড়িতে পাঠান তাঁরা। গত ২৮ মে ইফতারের সময় লোক মারফতে জানতে পারেন, তাঁর মেয়ে রাস্তায় পড়ে আছে। এরপর দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে মেয়েকে উদ্ধার করে ঢাকার ক্রিসেন্ট হাসপাতল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে যান। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
এই ঘটনার পর গত ২ জুন নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানায় নিজেই বাদী হয়ে একটি মামলা করেছেন বলে জানালেন শরীফ মিয়া।
শাহিনুরের মা জানান, তাঁর মেয়ে বিছানা থেকে উঠে বসতে পারে না। একা একা এপাশ-ওপাশও করতে পারে না। মেয়ের অবর্ণনীয় কষ্টের কথা বলার সময় কেঁদে ফেলেন এই মা।
মামলার এজাহারে যা আছে
এই ঘটনায় দায়ের করা মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, মো. শরিফ মিয়া অভিযোগ করেছেন যে তাঁর মেয়ে শাহিনুরকে বিয়ের পর থেকেই নানা ভাবে অত্যাচার করত তাঁর জামাইসহ শশুরবাড়ির লোকজন। এ নিয়ে একাধিক বার সালিশ মীমাংসা করা হয়েছে এবং আদালতে একটি মামলাও করা হয়েছে। কিন্তু সেই মামলায় জামিন পেয়ে আসার পর ২৮ মে সন্ধ্যা ৭ টা ৩০ মিনিটে সোহেল মিয়া তাঁর সহযোগী সাজ্জাত হোসেন (৩৮), মো. স্বপন মিয়া (৪০), মো. বাচ্চু মিয়া (৪৪) এবং ময়না বেগমসহ শাহিনূরকে মারপিট করে। এ সময় তাঁর মেয়ে নিজেকে রক্ষার জন্য বসত বাড়ির ছাদে ওঠেন। তখন তাকে ছাদ থেকে মারতে মারতে এক পর্যায়ে হত্যার উদ্দেশ্যে ধাক্কা মেরে নিচে ফেলে দেওয়া হয়।
আসামিরা কেউ গ্রেপ্তার হয়নি
মামলা করার পর পেরিয়ে গেছে এক মাসের বেশি সময়। তবে এখনো গ্রেপ্তার হয়নি কোনো আসামি।
শাহিনূরের বাবা জানান, সর্বশেষ তিনি গত ৩ জুলাই থানায় গিয়ে এই ব্যাপারে খোঁজ নেন। সেখানে জানতে পারেন, আসামিরা আগাম জামিন পেয়েছেন।
হুমকির অভিযোগ
শাহিনুরের মা এবং বাবা এনটিভি অনলাইনের কাছে অভিযোগ করে বলেন, গত ২ জুলাই সাজ্জাদ হোসেনসহ দুই আসামি পঙ্গু হাসপাতালে এসে তাঁদের মামলা তুলে নিতে হুমকি দিয়ে গেছেন। এ সময় প্রধান আসামি সোহেল মিয়াও হাসপাতালে এসেছিলেন বলে জানান শাহিনূরের মা-বাবা। তবে তিনি সরাসরি শাহিনূরের সামনে যাননি।
এক মাস পার হলেও হচ্ছে না অস্ত্রোপচার
শাহিনূর আক্তার পপিকে গত ২৯ মে পঙ্গু হাসপাতালের প্যারা ওয়ার্ডের ৩৮ নাম্বার বেডে ভর্তি করা হয়। সেসময় ডাক্তাররা জানান, তাঁর মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে গেছে সে কারণে অস্ত্রোপচার করতে হবে। কিন্তু ৩৯ দিন পার হওয়ার পরেও বেশ কয়েকবার অস্ত্রোপচারের তারিখ দেওয়ার পরেও শাহিনূরের অস্ত্রোপচার করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন তাঁর বাবা-মা।
শাহিনুরের মা এনটিভি অনলাইনকে বলেন, হাসপাতালে ভর্তির এক সপ্তাহ পর ডাক্তার বলে অস্ত্রোপচার করতে হবে, এ জন্য অনেক পরীক্ষা করাতে দেন। পরীক্ষা করার পর থেকে বারবার তারিখ দেওয়া হলেও অস্ত্রোপচার করা হয়নি। সর্বশেষ গতকাল শনিবারও অস্ত্রোপচারের তারিখ ছিল। কিন্তু তাও করা হয়নি।
এ বিষয়ে পঙ্গু হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক এবং পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তাদের কারো কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
পুলিশের বক্তব্য
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে বন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কালাম এনটিভি অনলাইনকে জানান, এই মামলার আসামিরা সবাই এখন জামিনে আছেন। তাঁরা এখনো মেডিকেল প্রতিবেদন হাতে পাননি। প্রতিবেদন পেলে দ্রুত অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।
ওসি আরো বলেন, মারধরের ঘটনা ঘটেছে। তার প্রাথমিক প্রামাণ মিলেছে। তবে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এই বিষয়ে সব তথ্য জানাতে পারবেন।
এরপর মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নারায়ণগঞ্জ বন্দর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মোখলেছুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, আসামিরা আদালত থেকে জামিন নিয়েছেন। সংসার করতে চান স্বামী। কিন্তু ওই নারী আর চাচ্ছেন না। সংসারে অনেক দিন ধরে নানা ঝামেলা চলছে, এ নিয়ে অনেক বার গ্রামে সালিশ বিচারও হয়েছে। এই ঘটনার পর ওই মেয়ের মেডিকেল রিপোর্ট এখনো হাতে পাই নাই, তদন্ত চলছে, তদন্ত শেষে বিস্তারিত বলা যাবে।