সংবিধানের মৌলিক কাঠামোতে কেউ হাত দিতে পারে না

বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছ থেকে সংসদের হাতে নিয়ে যে সংশোধনী আনা হয়েছে, তা সংবিধানের পরিপন্থী বলে মত দিয়েছেন সংবিধান-প্রণেতা ড. কামাল হোসেন।
ষোড়শ সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল শুনানিতে আদালত-বন্ধু (অ্যামিকাস কিউরি) হিসেবে নিজের বক্তব্য উপস্থাপন করে লিখিত বক্তব্য দেন ড. কামাল। তাঁর হাতে তৈরি বাহাত্তরের সংবিধানে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে থাকলেও এখন কেন তিনি এর বিরোধিতা করছেন তারও ব্যাখ্যা দিয়েছেন প্রবীণ এই আইনজীবী।
আজ সোমবার ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে শুনানির নবম দিনে আদালত-বন্ধু হিসেবে বক্তব্য দেন এম আই ফারুকী, ওয়াদুদ ভূইয়া, ড. কামাল হোসেন ও এএফ হাসান আরিফ। আর আজমালুল হোসেন কিউসির আংশিক বক্তব্যের পর মঙ্গলবার পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করা হয়।
আদালতে বক্তব্য দিয়ে বাইরে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেন। ষোড়শ সংশোধনী সুপ্রিম কোর্টের মর্যাদাকে খাটো করেছে উল্লেখ করে ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘কার কী ক্ষমতা তা সংবিধানে নির্ধারণ করা আছে। সংবিধানের মৌলিক কাঠামোতে কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। ষোড়শ সংশোধনী হাইকোর্ট বিভাগ অলরেডি অবৈধ ঘোষণা করে দিয়েছে।’
‘এটা খুব সহজ ব্যাপার একদিকে হলো সংবিধান, আর একটা হলো সংশোধনী। তার সঙ্গে যদি পরিপন্থী হয়- কোনটা প্রাধান্য পাবে? সংবিধান। এটাই হাইকোর্ট বলেছে।
ষোড়শ সংশোধনী এই কারণে মৌলিক কাঠামোয় আঘাত করেছে। এটা বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে খর্ব করেছে’, যোগ করেন ড. কামাল।
ষোড়শ সংশোধনী সংবিধানের পরিপন্থী হয়েছে কি না—জানতে চাইলে প্রবীণ এ আইনজীবী বলেন, ‘পরিপন্থী হয়েছে। আমি এই সাবমিশন রেখেছিলাম, সেইগুলো হাইকোর্ট মেনে নিয়েছে। আজ আমি সেইগুলো বললাম। অবশ্যই পরিপন্থী।’
বিচারক অপসারণে কী বিধান থাকা উচিত- এর জবাবে ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘যেটা ছিল সেটাই সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল। ষোড়শ সংশোধনী না থাকলে আমাদের যেটা ছিল সেটাই থাকবে। সেটার ওপর সর্বোচ্চ আদালতের রায়ও আছে।’
‘মৌলিক কাঠামোয় কেউ হাত দিতে পারে না’
ড. কামাল হোসেন বলেছেন, ‘বিষয়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মৌলিক মূলনীতিটা খুব ক্লিয়ার। সংবিধান হলো দেশের সর্বোচ্চ আইন। সেখানে কার কী ক্ষমতা তা নির্ধারণ করা আছে। নির্বাহী বিভাগ কী করতে পারে, আইন বিভাগ কী করতে পারে। আর বিচার বিভাগ, এর দায়িত্ব হলো সবাই নিজে নিজের সীমারেখার মধ্যে তারা থাকছে কি না, যদি সীমা লঙ্ঘন করে থাকে, তখন বিচার বিভাগ বলে যে, না এখানে সীমা লঙ্ঘিত হয়েছে। এখানে সংবিধানের সবচেয়ে মৌলিক দিক, যদি সংবিধানের সীমা নির্ধারণ না করা হয়। যদি রাষ্ট্রের অঙ্গ মনে করে যে, তার ক্ষমতার কোনো সীমা নাই, তখন সাংবিধানিক শাসন আর থাকে না।’
‘আইন বিভাগ যদি মনে করে যে, যেকোনো আইন আমি পাস করে নিতে পারি, সেটা সংবিধানের যে সীমাগুলো আছে, যদি তা লঙ্ঘন করে তখন সে আলটিমেটলি পাওয়ার হয়ে যায়, সে বিভাগের ধ্বংস করতে পারে; মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো থেকে বঞ্চিত করতে পারে; সংবিধানের মৌলিক কাঠামোতে তারা হাত দিতে পারে। আমাদের দেশে তো সেটেল হয়েই গেছে, যেখানে সাংবিধানিক শাসন আছে, লিখিত সংবিধান আছে, মৌলিক কাঠামো স্বীকৃত।’
‘সংবিধানের মৌলিক কাঠামোতে কেউ হাত দিতে পারে না’ উল্লেখ করে ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘এটাই হলো সাংবিধানিক শাসনের বৈশিষ্ট্য। অনেকগুলো জিনিস আছে যেখানে কেউ হাত দিতে পারে না। বিশেষ করে লেজিসলেটিভ, তাঁরা বলে যে, আমরা তো নির্বাচিত। কিন্তু আইন প্রণয়ন করার যে দায়িত্ব আছে, এটা কিন্তু সীমার মধ্যে সীমিত। তারা এ কথা বলতে পারে না যে, আমরা নির্বাচিত হয়ে এসেছি, আমরা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোতে হাত দিতে পারি। সেখানে সীমারেখাগুলো ছিল, বিশেষ করে যা মৌলিক, আমরা হাত দিতে পারি না।’
‘ইন্ডিয়া-ইংল্যান্ড দেখে নিয়েছিলাম’
বাহাত্তরের সংবিধানে বিচারপতি অপসারণে ক্ষমতা কী কারণে সংসদের হাতে দিয়েছিলেন, তখন কী চিন্তা করেছিলেন, আর এখনই বা কী চিন্তা করছেন- সাংবাদিকরা একপর্যায়ে সংবিধান-প্রণেতাদের অন্যতম ড. কামাল হোসেনকে এই প্রশ্ন করেন।
জবাবে কামাল হোসেন বলেন, ‘তখন ইন্ডিয়া, ইংল্যান্ড দেখে ভেবেছিলাম যে এটা আমরা করতে পারি। ওরা যেহেতু করেছে, তাঁরাও যে ধারণা থেকে করেছে, এখানে একটা বিচারকের অভিযোগ থাকলে তার পরে রায় দিতে হবে। তখন তারাও ভেবেছিল। এটা শুধু আমার চিন্তা না, আমরা এখন বলছি যে, তখন আমরা ভেবেছিলাম, ক্ষমতাটা এখানে দেওয়া যায়।’
‘এরাও বিচারক হিসেবে নিরপেক্ষ হবে। কোনো রকমে রাজনৈতিক অথবা দলীয় বিবেচনায় না গিয়ে তারা এই বিচারটা করতে পারে। এখন দেখা গেছে অন্যান্য দেশে, আমার ৪৬ বছরের অভিজ্ঞতা, হাইকোর্টে যখন ছিলাম তখন ৪৩ বছরের। অন্যান্য দেশে পরিষ্কার বলেছে যে, আমেরিকায়, যে কোনো রাজনৈতিক বিষয় এখানে না এনে একটা বিচার নিরপেক্ষভাবে সিনেট করতে পারে। এখন আমরা এটা মনে করি না। এখন ওখানে আলোচনা হচ্ছে যে…’
ড. কামাল এ প্রসঙ্গে আরো বলেন, ‘এটা বুঝা যায় যে, কোনো বিচার করতে গিয়ে কোনো প্রভাব বিচারকের ওপর গিয়ে পড়ে। বিচারক আদেশিত হচ্ছে। এটা তো আর বিচার হবে না। সেই কারণে তারা বলেছে যে, আমরা ভেবেছিলাম যে, সিনেটও যা করবে তা রাজনৈতিক প্রভাব থেকে করবে না, কোনোভাবে আদেশিত হয়ে করবে না। এখন রাজনৈতিক প্রভাব এখানে দেখা যাচ্ছে।’
তাহলে বিচার বিভাগ যদি কখনো অপথে চলে যায়, তখন কী হবে? জবাবে ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘তাহলে সংবিধান তো আছেই। সংবিধানের পরিপন্থী যদি তারা কিছু করে, তাহলে কয়েকটা জিনিস আছে, তারা যদি অগ্রহণযোগ্য যদি কিছু করে তাহলে সামাজিক একটা বিষয় আছে। তারা কোর্টে আসবে।’
‘আমরা ফিরে যেতে চাই’
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার কথা। এ বিষয়ে কী বলবেন জানতে চাইলে ড. কামাল হোসেন বলেন, ইন্ডিয়াতে বড় একটা ঘটনা ঘটল। ওখানে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। রামাসাম সুপ্রিম কোর্টের একজন জজ ছিলেন। ৭০ বছর হলো একটা ইমপিচমেন্টের কেস গিয়েছিল। ইমপিচমেন্টে যখন গেল তখন কংগ্রেস থেকে আদেশ দিয়ে দেওয়া হলো, কংগ্রেসের মেম্বাররা রামাসামের পক্ষে থাকবে। তো রামাসামকে সরানো গেল না। ফল কী হলো জজ সাহেবরা বলল যে, রাজনৈতিকভাবে এটা হয়েছে। আমরাও তার সঙ্গে বসবই না। তখন রামাসামকে রিজাইন করতে হলো। অর্থাৎ পলিটিক্যালি তাঁকে বাঁচানোর চেষ্টা করেও বাঁচানো গেল না। এরপর বিষয়টি নিয়ে ইন্ডিয়াতে আলোচনা হয়েছে। এটা রাজনীতি থেকে মুক্ত থাকতে হবে। এই অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা মনে করি যে, আমরা ফিরে যেতে চাই। আমাদের এই অভিজ্ঞতাগুলোকে উপেক্ষা করা সমীচীন নয়।