‘বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বলছি’ জানিয়ে বিকাশের টাকা লুট!

দুপুর ২টা ৩৭ মিনিটে মোবাইলে একটি রবি নম্বর থেকে ফোন আসে। ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে বলা হয়, ‘আমি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বলছি। আপনার এই নম্বর তো বিকাশের এজেন্ট নম্বর? বিকাশের কার্যক্রম বাড়ানোর জন্য এর মেনুতে একটি নতুন মেনু যোগ করা হচ্ছে। বিকাশের মূল মেনুতে এখন ছয়টি অপশন আছে। এখন থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আরো একটি নতুন মেনু যোগ করা হচ্ছে। অর্থাৎ এখন সাতটি অপশন থাকবে সবার বিকাশ অ্যাকাউন্টে। এর জন্য আপনাকে নির্দিষ্ট কিছু সংখ্যা চাপতে হবে আপনার মোবাইলে।’
এরপর কথামতো তাঁর দেওয়া নির্দিষ্ট কিছু সংখ্যা চাপলেন শরীফ হোসেন পাটোয়ারী। পরে তিনি বুঝতে পারলেন, তাঁর বিকাশ অ্যাকাউন্ট থেকে সব টাকা উধাও হয়ে গেছে!
এভাবেই নিজের টাকা হারানোর অভিজ্ঞতার কথা এনটিভি অনলাইনকে জানান শরীফ। তিনি বিকাশের একজন এজেন্ট। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে তাঁর একটি চায়ের দোকানও আছে। গতকাল বৃহস্পতিবারই ওই ঘটনা ঘটে।
শরীফ জানালেন, সকাল থেকে দোকান ঠিকমতো চলছিল কিন্তু দুপুরেই ঘটল বিপত্তি।
শরীফ হোসেন জানান, তিনি ফোনের ওপাশে থাকা ব্যক্তির কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ‘নতুন মেনু’ কিসের জন্য? তখন ওই ব্যক্তি জানান, ‘বিদেশ থেকে টাকা লেনদেন করার জন্য এটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ মেনু। আপনি যদি এইটা চালু না করেন তবে আপনার বিকাশ এজেন্টশিপ ছয় মাসের জন্য বাতিল হয়ে যাবে এবং আপনার পিন নম্বর পরিবর্তন হয়ে যাবে।’
এরপর ওই ব্যক্তির কথামতো নির্দিষ্ট কিছু সংখ্যা চাপেন শরীফ হোসেন। তখন ওপাশ থেকে বলা হয়, ‘আপনার ব্যালেন্সের সমস্যা আছে, আপনি আপনার নম্বরে ১০ হাজার টাকা বিকাশ করুন। শরীফ হোসেন অন্য দোকানে গিয়ে নিজের নম্বরে ১০ হাজার টাকা বিকাশ করেন। কিন্তু ওই ব্যক্তি আবারও ১০ হাজার টাকা নিজের (শরীফ) নম্বরে বিকাশ করতে বলেন। শরীফ হোসেন যখন আবার ১০ হাজার টাকা নিজের মোবাইলে ঢোকাতে যান, তখন তাঁর ছোট ভাই সোহাগের সঙ্গে দেখা হয়। সব শুনে সোহাগ তাঁকে শরীফকে জানান, তিনি (শরীফ) প্রতারণার শিকার হয়েছেন।
এরপর বারবার নিজের বিকাশ অ্যাকাউন্ট চেক করার জন্য চেষ্টা করেন শরীফ হোসেন। কিন্তু ঢুকতে পারেননি। শুধু একটি মেসেজ দেখায়, তাঁর মোবাইলে Number of invalid password… অর্থাৎ তাঁর পাসওয়ার্ড (গোপন পিন নম্বর) পরিবর্তন করা হয়েছে।
এরপর শরীফ হোসেন বিকাশের কর্মকর্তা মো. আবুল কালামকে বিষয়টি জানান। তিনি ওই দোকানে এসে সব কিছু পরীক্ষা করে শরীফকে বলেন, ‘আপনাদের আগে থেকেই বলা হয়েছে, বিকাশ এজেন্ট নাম্বারে অপরিচিত কোনো নাম্বার থেকে কল আসলে রিসিভ করবেন না।’ এরপর তিনি মেসেজ পরীক্ষা করে জানান, ০১৮৫১৩৬৬৫৯১ নম্বরে ১৪ হাজার ৯৭৭ টাকা, ০১৮৫১৭৫৪১৮৫ নম্বরে ১৪ হাজার ৯৯৭ টাকা এবং ০১৭৭৯০৩৫১৬৯ নম্বরে নয় হাজার ৮০০ টাকাসহ মোট ৩৯ হাজার ৮৯৪ টাকা চলে গেছে।
এই ঘটনার বিষয়ে আবুল কালাম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘সব সময়ই আমরা বিকাশের এজেন্টদের সতর্ক করে দেই এমন অপরিচিত কোনো নম্বর থেকে কল আসলে রিসিভ করবেন না। না বুঝেশুনে অন্যের কথামতো নিজের মোবাইলে কোনো নম্বর চাপবেন না। তার পরও এমন নানা রকমের প্রতারণার ঘটনা ঘটছে। শরীফ হোসেন ঘটনা আমাকে জানানোর পরই আমি তাঁর দোকানে গিয়েছিলাম। সব কিছু দেখে বুঝলাম যে তিনি প্রতারিত হয়েছেন। বিষয়টি অফিসে জানানো হয়েছে, এখন অফিস প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’
শরীফের ছোট ভাই সোহাগ পাটোয়ারী জানান, এখন এই ক্ষতি কীভাবে পূরণ হবে তা নিয়ে তাঁরা দুই ভাই অনেক বেশি দুশ্চিন্তায় রয়েছেন।
এই ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) বিশেষ পুলিশ সুপার মির্জা আবদুল্লাহেল বাকী এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘এর আগেও বিকাশের মাধ্যমে প্রতারণা করে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে বেশ কিছু চক্রকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। প্রতারিত ব্যক্তি থানায় মামলা দায়ের করলে সে মামলাটি আমরা তদন্ত করব। এই প্রতারণার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তার করার চেষ্টা করব।’
এর আগে, গত ৬ মার্চ রাজধানীর মালিবাগে অবস্থিত সিআইডির প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মির্জা আবদুল্লাহেল বাকী জানিয়েছিলেন, বিকাশের মাধ্যমে প্রতারণা করে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দুই তরুণকে আটক করেছে সিআইডি।
আটক দুই যুবকের নাম মোমিন মৃধা (১৯) ও হাসিবুল হাসান ফাহিম (১৯)। তাঁরা দুজনই দীর্ঘদিন ধরে মুঠোফোনের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতারণা করে আসছেন বলে জানিয়েছে সিআইডি। আটক ব্যক্তিদের কাছ থেকে পাঁচটি মুঠোফোন, ১৩টি সিমকার্ড, তিনটি ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র এবং বিভিন্ন নামের চারটি জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি পাওয়া যায়।
বিকাশের মাধ্যমে প্রতারিত এক ছাত্রীর ঘটনার বর্ণনা দিয়ে মির্জা আবদুল্লাহেল বাকী জানিয়েছিলেন, গত ১০ জানুয়ারি মেডিকেল কলেজের এক ছাত্রীর কাছে বিকাশের মাধ্যমে কিছু টাকা আসে। এর কিছুক্ষণ পর তাঁর মুঠোফোনে বিকাশের ‘ক্যাশ ইন’ নামে একটি ভুয়া মেসেজ আসে। সেটি বিকাশ থেকে পাঠানো মেসেজের মতোই ছিল। কিছুক্ষণ পর প্রতারকচক্রের সদস্য ওই ছাত্রীকে ফোন করে জানায়, ভুলবশত তাঁর মুঠোফোনে বেশি টাকা পাঠানো হয়েছে। এরপর টাকা ফেরত পাঠাতে বলা হয়। প্রতারকদের কথা বিশ্বাস করে টাকা ফেরত পাঠান ওই ছাত্রী। পরে বিকাশ অ্যাকাউন্ট চেক করে দেখেন, তাঁর অ্যাকাউন্ট থেকে সব টাকা চলে গেছে।
এভাবে আসামিরা মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা আত্মসাৎ করে আসছিল বলে জানান ওই সিআইডি কর্মকর্তা।