ছাত্র পড়াতে ডেকে ডেকে ছিনতাই

ইশরাফুল আলম। বাড়ি কুষ্টিয়ার শেখপাড়ায়। পড়ছেন মিরপুরের বিইউবিটি ইউনিভার্সিটির অর্থনীতি বিভাগে। বাবা নেই, তাই টিউশনির টাকায় পড়াশুনার করেন।
তিন মাস ধরে ইশরাফুলের কোনো টিউশনি ছিল না। অর্থকষ্টে সময় কাটাচ্ছিলেন। তাই চলতি মাসে ‘প্রাইভেট পড়াতে চাই’ লিখে মিরপুরে বিভিন্ন স্থানে বিজ্ঞাপন টানিয়ে দেন। নিচে দেন নিজের মুঠোফোন নম্বর।
সেই বিজ্ঞাপন দেখেই ইশরাফুলকে ফোন করে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার পরিচয়ধারী এক ব্যক্তি। টিউশনি দেওয়ার কথা বলে ইশরাফুলকে সে ডেকে নেয় বোটানিক্যাল গার্ডেনে। সেখানে আরো দুজন যুক্ত হয়। পরে অস্ত্রের মুখে ইশরাফুলের মুঠোফোনসহ টাকা কেড়ে নেয় তারা।
শুধু ইশরাফুল আলম নয়, মিরপুরের আরো শিক্ষার্থী টিউশনি করাতে গিয়ে হারিয়েছেন মুঠোফোন ও টাকা। বাড়িতে পড়াতে ডেকে ওই শিক্ষার্থীদের সবকিছু ছিনতাই করা হয়। তবে এসব বিষয়ে ছিনতাইয়ের শিকার শিক্ষার্থীরা পুলিশের কাছে গিয়েও কোনো ব্যবস্থা পাননি। সব কিছু হারিয়ে শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ যাচ্ছেন র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) কাছে।
শিক্ষার্থী ইশরাফুল আলম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, গত জানুয়ারি থেকে তাঁর কোনো টিউশনি ছিল না। তাই টিউশনি পড়াতে চেয়ে মিরপুরের বিভিন্ন স্থানে পোস্টার লাগিয়ে দেন। ওই পোস্টার লাগানোর পর গত ১৫ এপ্রিল তাঁর কাছে একটি ফোন আসে। ফোনে এক ব্যক্তি নিজেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে পরিচয় দেন। তাঁর ভগ্নিপতি বিমানবাহিনীতে চাকরি করেন জানিয়ে ওই ব্যক্তি বলেন, তাঁর ভাগ্নে-ভাগ্নিকে পড়াতে হবে।
মুঠোফোনের ওপারের ব্যক্তি ইশরাফুলকে টিউশনি করাতে চাইলে সন্ধ্যায় তাঁদের বাসায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। এ জন্য ইশরাফুলকে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বলেন। তবে দেখা করার আগে ইশরাফুলকে একটি শর্ত দেওয়া হয়। বলা হয়, তাঁদের বাসায় অনেক বেশি নিরাপত্তা, তাই একটি ভিডিও মোবাইল সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে। আর বাসায় প্রবেশের সময় সেই ফোন থেকে ভিডিও কল দিতে হবে। এটা করলেই কেবল ইশরাফুল ওই বাসায় প্রবেশের অনুমতি পাবেন।
ইশরাফুল আলম বলেন, মুঠোফোনের ওই ব্যক্তির কথা মতো তিনি এক বন্ধুর কাছ থেকে একটি স্মার্টফোন সংগ্রহ করেন। এরপর সন্ধ্যায় তিনি ওই ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করতে যান। ওই ব্যক্তির সঙ্গে দেখা হওয়ার পর তাঁকে বোটানিক্যাল গার্ডেনের পাশে একটি বাসা দেখিয়ে বলা হয়, ওই বাসায় গিয়ে প্রাইভেট পড়াতে হবে। এরপর তাঁকে কৌশলে একটি নির্জন স্থানে নিয়ে যান ওই অপরিচিত ব্যক্তি। সেখানে নিয়ে ওই ব্যক্তিসহ আরো তিনজন তাঁকে ছুরি দেখিয়ে কাছে থাকা দুটি মুঠোফোন ও মানিব্যাগে থাকা টাকা কেড়ে নেয়। এরপর তাঁকে বোটানিক্যাল গার্ডেনের ভেতর দিয়ে যেতে বলে। তখন নিরুপায় ইশরাফুল সব হারিয়ে বাড়িতে চলে যান।
ছিনতাইকারীকে পরিচয় সম্পর্কে জানতে চাইলে ইশরাফুল বলেন, ‘তারা সবাই অপরিচিত। তবে যে ব্যক্তি আমাকে ফোন করে ডেকে নিয়েছিল, তার নাম মামুন বলে সে আমাকে জানিয়েছে। তার বয়স ৩৫-৪০ বছর হবে। আমার বন্ধুর ফোনটি ছিনতাই হওয়ায় তাঁকে ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছে। ওই টাকা সংগ্রহ করতে গিয়ে আমাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে।’
একই মামুন আরেক ঘটনা
মিরপুর এলাকার অন্য এক শিক্ষার্থীও ‘প্রাইভেট পড়াতে চাই’ বিজ্ঞাপন দিয়ে ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন। তিনি ওই এলাকায় বিবিএ দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছেন। পরিচয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রকাশ না করার শর্তে ওই শিক্ষার্থী এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেন।
ওই শিক্ষার্থী গত ২ এপ্রিল মিরপুরের রূপনগর এলাকায় বিভিন্ন স্থানে বিজ্ঞাপন টাঙান। এর পরের দিন সন্ধ্যায় এক ব্যক্তি নিজেকে মামুন পরিচয় দিয়ে তাঁকে ফোন করে। ফোন করে সে নিজের ভাগ্নে-ভাগ্নিকে প্রাইভেট পড়াতে বলে।
মামুন পরিচয়ধারী ওই ব্যক্তি শিক্ষার্থীকে জানায়, তাঁর ভাগ্নে-ভাগ্নি ষষ্ঠ শ্রেণিতে মনিপুর স্কুলে পড়ে। তাদের বাসা বোটানিক্যাল গার্ডেনের পেছনে। তাঁর ভগ্নিপতি বিমানবাহিনীর একজন কর্মকর্তা। পরের দিনই প্রাইভেট প্রত্যাশী শিক্ষার্থীকে মামুন নামের ওই ব্যক্তি দেখা করতে বলে। পরের দিনও ফোন করে মামুন পরিচয়ধারী ওই ব্যক্তি। এরপর প্রাইভেট প্রত্যাশী ওই শিক্ষার্থী রাজধানীর রূপনগরের শিয়ালবাড়ি নামক স্থানে মামুন নামের সেই ব্যক্তির সঙ্গে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় দেখা করেন।
সেখানে গিয়ে মামুন পরিচয়ধারী ব্যক্তির সঙ্গে দেখা হওয়ার পর সে একটা সিএনজিতে করে প্রাইভেট প্রত্যাশী শিক্ষার্থীকে একটি স্থানে নিয়ে যায়। সিএনজিতে করে তাঁকে বোটানিক্যাল গার্ডেনের কাছে একটি ভবন দেখিয়ে মামুন পরিচয়ধারী ওই ব্যক্তি বলে, ওই বাসায় প্রাইভেট পড়াতে হবে। এরপর গল্প করতে করতে ওই শিক্ষার্থীকে বোটানিক্যাল গার্ডেনের পেছনে নিয়ে যায়। সেখানে যাওয়ার পর আরো দুজন তার সঙ্গে যুক্ত হয়।
বোটানিক্যাল গার্ডেনে ওই ব্যক্তিরা শিক্ষার্থীকে চাকু দেখিয়ে বলে, ‘কত টাকা নিয়ে আসছিস?’ তখন ওই শিক্ষার্থী নিজের মানিব্যাগটা বের করে দেন এবং তাঁর সঙ্গে থাকা দুটি মাইক্রোসফট মুঠোফোন তারা কেড়ে নেয়। এরপর সেখান থেকে ওই শিক্ষার্থীকে চলে যেতে বলে ওই চক্রটি।
প্রাইভেট প্রত্যাশী ওই শিক্ষার্থী বলেন, ‘ছিনতাইকারী চক্রটি যে মোবাইল ফোন নম্বর থেকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল, আমি বাসায় এসে ওই নাম্বারে ফোন দিয়ে দেখি, নম্বর খোলা আছে। কিন্তু ফোন বার বার কেটে দেয়।’
এমন ছিনতাই আরো হয়েছে
সরেজমিনে মিরপুর এলাকার রূপনগর থানা, শাহ আলী থানা, দারুস সালাম থানা এলাকার বেড়িবাঁধ, বোটানিক্যাল গার্ডেন, চিড়িয়াখানার আশপাশের এলাকাগুলোতে গিয়ে ছিনতাইয়ের কথা জানা গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক ব্যক্তি জানান, কিছু দিন আগে তিনি এক ছেলেকে কাঁদতে কাঁদতে গার্ডেনের ভেতর থেকে বের হয়ে আসতে দেখে এর কারণ জিজ্ঞেস করেন। তখন সেই ছেলে তাঁকে বলেন, ‘আমাকে টিউশনি দেওয়ার কথা বলে ডেকে নিয়ে এসে সব কিছু ছিনতাই করে নিয়েছে।’ তাঁর কাছে বাসায় ফেরার মতো টাকাও ছিল না। পরে ওই ব্যক্তি তাঁকে রিকশা ভাড়া দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দেন।
থানায় অভিযোগ দিয়েও কিছু হয়নি
মিরপুরের শিক্ষার্থী ইশরাফুল আলম ছিনতাই হওয়ার পর গত ১৭ এপ্রিল রাজধানীর শাহ আলী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। কিন্তু জিডি করার পরও পুলিশ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। ইশরাফুলের মতো ওই এলাকার আরেক শিক্ষার্থী একইভাবে ছিনতাইয়ের শিকার হলেও ব্যবস্থা পাননি।
একইভাবে চলতি মাসে ছিনতাইয়ের শিকার প্রাইভেট প্রত্যাশী বিবিএর ওই শিক্ষার্থী জানান, ছিনতাই হওয়ার পর তিনি শাহ আলী থানায় অভিযোগ দিতে যান। কিন্তু তাঁকে পুলিশ জানায়, এই অভিযোগ রূপনগর থানায় দিতে হবে। এরপর ওই শিক্ষার্থী রূপনগর থানায় গিয়ে লিখিত অভিযোগ করেন।
থানায় লিখিত অভিযোগ দেওয়ার পর একজন উপপরিদর্শক (এসআই) ওই শিক্ষার্থীকে ঘটনাস্থলে নিয়ে যান। সেখানে গিয়ে কাউকে না পেয়ে থানায় চলে যান। এরপর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিলেও পুলিশ কিছুই জানায়নি।
বাধ্য হয়ে র্যাবের কাছে
প্রাইভেট প্রত্যাশী ওই শিক্ষার্থী পুলিশের থেকে কোনো সহযোগিতা পাননি। তাঁর ফোনে লোকেশন ট্রাক (অবস্থান নির্দেশক) করার ব্যবস্থা আগে থেকেই চালু করে রেখেছিলেন তিনি। তাই তাঁর ছিনতাই হওয়া মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট চালু করার সঙ্গে সঙ্গে ফোনের অবস্থান তিনি জানতে পারেন।
ওই শিক্ষার্থী বলেন, ফোনে ইন্টারনেট চালু করার পর ছিনতাই হওয়া ফোন দুটিতে কোন নম্বর ব্যবহার করা হচ্ছে তাও জানা যায়। এরপর ৬ এপ্রিল রাতে তাঁর ফোনের লোকেশন পাওয়া যায় আনসার ক্যাম্প এলাকায়, যে নম্বর ব্যবহার করা হচ্ছে তাও পাওয়ায় যায়। এসব তথ্য নিয়ে তিনি থানায় যান। কিন্তু সেখান থেকে সহযোগিতা না পেয়ে র্যাব ৪-এর কার্যালয়ে যান।
র্যারের কাছে অভিযোগ করার পর গত ৭ এপ্রিল একটি ফোন উদ্ধার করা হয়। যার কাছে থেকে ফোনটি উদ্ধার করা হয়, ওই ব্যক্তি র্যাবকে জানান, অনেক হাত বদল হয়ে ফোনটি তাঁর কাছে গিয়েছিল। তিনি এই ঘটনার বিষয়ে কিছুই জানেন না।
পুলিশ যা বলল
ছিনতাইয়ের বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের রূপনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শহিদ আলম এনটিভি অনলাইনকে জানান, বেশ কিছু দিন আগে এমন একটি অভিযোগ তাঁরা পেয়েছিলেন। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। কিন্তু গ্রেপ্তারের পর অভিযোগকারী মামলার বাদী হতে রাজি হননি। পরে পুলিশ নিজে থেকে বাদী হয়ে তাদের আদালতে পাঠিয়েছে। তবে সম্প্রতি এমন কোনো অভিযোগ তিনি পাননি। ছিনতাইয়ের অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান ওসি।
ঢাকা মহানগর পুলিশের শাহ আলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনোয়ার হোসেন এনটিভি অনলাইনকে জানান, ছিনতাইয়ের এমন কোনো ঘটনা সম্পর্কে তাঁর জানা নেই। তবে অভিযোগ পেলে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি।
ইশরাফুল আলম নামের শিক্ষার্থীর জিডির বিষয়ে ওসি বলেন, এই ঘটনায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।