নেত্রকোনায় বাঁধ ভেঙে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি

অতি বৃষ্টি, বৈরী আবহাওয়া ও পাহাড়ি ঢলে নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। আগাম বন্যায় হাওরের পরিস্থিতি এখনো অপরিবর্তিত রয়েছে।
আজ রোববার জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলার তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের বড় পাইকুড়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে বন্যা দুর্গতদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব-১ সাজ্জাদুল হাসান, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক মো. রিয়াজ আহমেদসহ অনেকেই।
নেত্রকোনার মদন, মোহনগঞ্জ, খালিয়াজুরি, কলমাকান্দা, বারহাট্টা ও আটপাড়া উপজেলাসহ জেলার সবকটি উপজেলার নিম্নাঞ্চল ও হাওরাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। গতকাল শনিবার নতুন করে খালিয়াজুরী উপজেলার গছিখাই হাওর এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
নেত্রকোনায় অব্যাহত বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বাঁধ ভেঙে একের পর এক হাওরে পানি ঢুকে বিস্তীর্ণ হাওরাঞ্চলের বোরো ফসল তলিয়ে গেছে। এতে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন জেলার শত শত কৃষক। কয়েকটি উপজেলার বাঁধ ভেঙে এ পর্যন্ত প্রায় ৪০ হাজার হেক্টর জমির ফসল বিনষ্ট হয়ে গেছে বলে জানান জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিলাস চন্দ্র পাল।
প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে মোহনগঞ্জের চর-হাইজদা বাঁধ ভেঙে জেলার সবচেয়ে বড় হাওর ডিঙ্গাপোতা ও দুদিনের ব্যবধানে কীর্ত্তণখোলা বাঁধ ভেঙে পাঙ্গাসিয়া হাওরসহ জেলার বিভিন্ন হাওরে বিস্তীর্ণ জমির ফসল তলিয়ে গেছে। মোহনগঞ্জ, খালিয়াজুরী, মদন, বারহাট্টা, কলমাকান্দা, আটপাড়া ও কেন্দুয়া উপজেলার বিভিন্ন হাওরে উজানের ঢলের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এদিকে নেত্রকোনার হাওরাঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ করা ১১ লাখ টাকা ও ১৫১ মেট্টিকটন চাল বিতরণের কার্যক্রম চলছে। গত শুক্রবার থেকে সরকারের পক্ষ থেকে ত্রাণ বিতরণ শুরু হয়।
জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলায় শনিবার বিকেলে বিভিন্ন দুর্গত এলাকা পরিদর্শন এবং অর্থ চাল বিতরণ করেন প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব-১ সাজ্জাদুল হাসান। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সমস্যা দূর করতে সরকারের পক্ষ থেকে সম্ভাব্য সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন তিনি। এ সময় উপস্থিত ছিলেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) মহাপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর কবীর, হাওর উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক মো. মজিবর রহমান, ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক আনোয়ার হোসাইন আকন্দ ও কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক বিলাস চন্দ্র পাল।
এর আগে গতকাল নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনের হলরুমে সম্প্রতি আগাম বন্যায় হাওরাঞ্চলে ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে ক্ষতি বর্তমান করণীয় সম্পর্কে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়।
ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক আনোয়ার হোসেন আকন্দের সভাপতিত্বে মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব-১ সাজ্জাদুল হাসান, পাউবোর মহাপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর কবীর, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান প্রশান্ত কুমার রায়, পুলিশ সুপার জয়দেব চৌধুরী, আটপাড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হাজি খায়রুল ইসলাম, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপকমিটির সাবেক সহসম্পাদক শামছুর রহমান ভিপি লিটন, মোহনগঞ্জ পৌরসভার মেয়র অ্যাডভোকেট লতিফুর রহমান রতন, মোহনগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শহীদ ইকবালসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সরকারি কর্মকর্তা, কৃষকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।
এ সময় বক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হাওরে ইজারা বাতিল, তালিকা করে কৃষকদের ক্ষতিপূরণ, বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) থেকে নেওয়া ঋণের কিস্তি স্থগিতসহ বিভিন্ন দাবি তুলে ধরেন।
এ ছাড়া গত শুক্র ও শনিবার জেলার বারহাট্রা ও সদর উপজেলার বিভিন্ন ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেন যুব ও ক্রীড়া উপমন্ত্রী আরিফ খান জয়। এ সময় তিনি ছিরাম, নৈহাটি, মনাস ও সদর উপজেলার কালিয়ারা-গাবরাগাতী এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত পাঁচ শতাধিক মানুষের মধ্যে অর্থ ও চাল বিতরণ করেন।
এদিকে সময় মতো সঠিকভাবে বাঁধ নির্মাণ না করায় অতি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে আগাম বন্যাকবলিত নেত্রকোনার হাওরাঞ্চলকে দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবিতে গতকাল মানববন্ধন করেছে নেত্রকোনা উন্নয়নে নাগরিক আন্দোলন।
বেলা ১১টা থেকে ১২টা পর্যন্ত পৌরসভার মোড়ে মানববন্ধন কর্মসূচিতে নাগরিক আন্দোলনের নেতারা ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নেয়। মানববন্ধন চলাকালে হাওরাঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের দুর্দশার চিত্র তুলে ধরে বক্তব্য দেন নেত্রকোনা উন্নয়নে নাগরিক আন্দোলনের সভাপতি সাবেক এমএনএ প্রবীণ রাজনীতিবিদ অ্যাডভোকেট সাদির উদ্দিন আহমেদ, কার্যকরী সভাপতি অ্যাডভোকেট আমিনুল ইসলাম ভূঁইয়া, নাগরিক আন্দোলনের প্রধান উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) আবদুন নূর খান, জেলা জাতীয় পার্টির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট লিয়াকত আলী খান, জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার হায়দার জাহান চৌধুরী, জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট নূরুজ্জামান নুরু, জেলা সিপিবির সাবেক সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার আনিছুর রহমান, নাগরিক আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক খানে আলম খান, সাংগঠিক সম্পাদক তানভীর জাহান চৌধুরী, জেলা মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবা রহমান শেফালী, জেলা মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক তাহেজা বেগম, মহিলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদ সৈয়দা সামছুন্নাহার বিউটি, ক্ষেত মজুর সমিতির সাবেক সভাপতি ব্রজ গোপাল সরকার প্রমুখ।
মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, হাওরের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ক্ষতিপূরণ, কৃষি ও এনজিও ঋণ মওকুফ, ধনু নদীর উৎস থেকে মেঘনার মোহনা পর্যন্ত খনন করে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ, পর্যাপ্ত ত্রাণ প্রদান ও রেশনিং ব্যবস্থা চালু, নতুন করে কৃষকদের সুদমুক্ত কৃষি ঋণ বিতরণ, সব সার্টিফিকেট মামলা প্রত্যাহার, পাউবোর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের বিচারের আওতায় আনা, জলমহাল ইজারামুক্ত করে ভাসান পানিতে মাছ ধরার অধিকারের জোর দাবি জানানো হয়।