রাখাইনে সেনা সমাবেশ, সীমান্তবর্তী বাংলাদেশিদের মধ্যে উৎকণ্ঠা

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের উত্তর রাখাইনে আবারও সেনা সমাবেশ ঘটিয়েছে সে দেশের সেনাবাহিনী। এক সপ্তাহ ধরে রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় নতুন করে সেনা সদস্য মোতায়েন করা হচ্ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাখাইনের বিভিন্ন জায়গায় সেনা তৎপরতা লক্ষ করা গেছে বলে সীমান্ত থেকে পাওয়া খবরে জানা গেছে।
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সমুদ্র সীমান্তে মাছ ধরার ট্রলারে করে মিয়ানমারের সেনাদের টহল এবং রাখাইনে তাদের সরব উপস্থিতির বিষয়ে উদ্বেগ ও প্রতিবাদ জানাতে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছে ঢাকা। গত রোববার বিকেলে রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে নিয়ে মৌখিক প্রতিবাদ জানানো ছাড়াও তাঁর হাতে একটি প্রতিবাদপত্র ধরিয়ে দেওয়া হয়।
রাখাইন রাজ্যের মংডু জেলার বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী সাহেব বাজার, ফকিরাবাজার, বলিবাজার, তুমব্রু সাউথসহ বিভিন্ন জায়গায় সেনা সমাবেশের খবর পাওয়া গেছে। গত সপ্তাহে মিয়ানমারের আকিয়াব থেকে সমুদ্র পথে বড় ট্রলারে করে এসব সেনা সদস্য প্রথমে রাখাইনের সীমান্ত জেলা মংডু টাউনশিপে এনে রাখা হয়। পরে সড়ক পথে এসব সেনা সদস্যদের বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি ওইসব জায়গায় মোতায়েন করা হয় বলে বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে।
জানা যায়, আগে থেকেই মিয়ানমার সেনাবাহিনীর একাধিক সেনা ক্যাম্প রয়েছে এসব জায়গায়। মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন আরাকান আর্মির সঙ্গে উত্তর রাখাইনে দেড় বছর ধরে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরোধ সংঘর্ষ চলে আসছে।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) কক্সবাজার ৩৪ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আলী হায়দার আজাদ বলেন, ‘উত্তর রাখাইনের মংডু জেলার তুমব্রু নর্থ এবং সাউথে নতুন করে সেনা সমাবেশ করেছে মিয়ানমার। আমরা বিষয়টি বিভিন্ন সূত্রে জানতে পেরেছি। যেখানে তারা সেনা সদস্যদের এনে মোতায়েন করে রেখেছে তা বাংলাদেশ সীমান্তের একেবারে কাছাকাছি।’
এমন তৎপরতাকে উদ্বেগজনক মন্তব্য করে বিজিবি কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘সীমান্তে আমাদের বিজিবির সদস্যদের সতর্কতা অবলম্বন করে টহল করতে বলে রেখেছি। বিজিবি সদস্যরা এমনিতেই নিয়মিত টহল দেয়। মিয়ানমারের সেনা সমাবেশের কারণে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হচ্ছে। তবে ওপারে বিচ্ছিন্নতাবাদী বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ লেগেই আছে। এসব কারণেও নতুন করে সেনাসমাবেশ করতে পারে তারা।’
রাখাইনের সীমান্তবর্তী এলাকায় সেনা সমাবেশের খবরে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যেও উদ্বেগ উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে।
কক্সবাজার জেলার সীমান্তবর্তী ইউনিয়ন পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা আমাদের জন্য অশনি সংকেতের মতো। ২০১৭ সালের আগস্ট মাসের শুরুতেও এরকম সেনা সমাবেশ ঘটিয়েছিল। তারপর সন্ত্রাস দমনের নামে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশে লাখ লাখ রোহিঙ্গাদের ঠেলে দেয়। শুধু উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নেই ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর পাঁচ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে।’
বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী গ্রাম ঘুমধুমের বাসিন্দা গণমাধ্যম কর্মী আজিজুল হক জানান, কয়েকদিন ধরে মিয়ানমারের তুমব্রু এলাকায় বড় বড় ট্রাকে করে মিয়ানমারের সেন সদস্য আসা যাওয়া করতে দেখা যাচ্ছে। মিয়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) সদস্যদের তৎপরতাও বেড়ে গেছে।
কক্সবাজারে বিজিবি অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আলী হায়দার আজাদ গতকাল সোমবার সকালে কক্সবাজার ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার সীমান্ত এলাকায় পরিদর্শনে গিয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী বালুখালী, আনজুমানপাড়া, ঘুমধুম তুমব্রুসহ বিভিন্ন সীমান্ত চৌকির বিজিবি সদস্যদের সঙ্গে মিলিত হয়েছেন।
গত শুক্রবার হাজার খানেক সেনা টেকনাফ সীমান্তে তিনটি পয়েন্টে টহল দিয়ে উত্তেজনাপূর্ণ রাখাইনে প্রবেশ করে। সেনাদের সন্দেহজনক ওই চলাফেরা শান্ত সীমান্তকে অশান্ত করা এবং রাখাইনকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে ঢাকা। কর্মকর্তারা বলছেন, বিনা উসকানিতে এভাবে সীমান্তের কাছে নতুন করে সেনা সমাবেশের প্রতিবাদে ঢাকায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত অং কিউ মোয়েকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে আনা হয়। সীমান্তে বর্মী বাহিনীর অপতৎপরতা বন্ধ এবং সব ধরণের ভুল–বোঝাবুঝি অবসানে মিয়ানমারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে বলেছে বাংলাদেশ। রাতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মিয়ানমার সেলের মহাপরিচালক মো. দেলোয়ার হোসেন রাষ্ট্রদূতের তলব এবং প্রতিবাদপত্র ধরিয়ে দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। মিয়ানমার ও ঢাকার কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, সন্দেহজনক গতিবিধির মাধ্যমে বর্মী সেনাসমাবেশ দুই দেশের মধ্যে ভুল–বোঝাবুঝি সৃষ্টির সুযোগ তৈরি করতে পারে।
পাশাপাশি ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনে গণহত্যা শুরুর প্রাথমিক পর্বে এভাবেই সেখানে সৈন্যদের জড়ো করেছিল মিয়ানমার সেনাবাহিনী। ফলে ১১ তারিখ ভোরে শুরু হওয়া সেনা সমাবেশের কারণে রাখাইনে এখন যেসব রোহিঙ্গা রয়েছেন, তাদের মধ্যে নতুন করে ভীতি ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। অনাকাঙ্ক্ষিত যে কোনো পরিস্থিতি এড়াতেই ঢাকার আগাম ওই পদক্ষেপ।
২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে গণহত্যা ধর্ষণ নির্যাতন অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞ শুরু হলে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। তারও আগে থেকে আসা রোহিঙ্গা মিলিয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার ৩৪ ক্যাম্পে বর্তমানে ১২ লাখের কাছাকাছি রোহিঙ্গা শরণার্থী আছে। জাতিসংঘের হিসাব মতে, মিয়ানমারের রাখাইনে এখনো ১০ লাখের কাছাকাছি রোহিঙ্গা বসবাস করছে।