ওয়ার্ড কমিশনার থেকে নগরপিতা বদর উদ্দিন আহমদ কামরান

সরকারি চাকরিজীবী বাবার আপত্তি ছিল ছেলের রাজনীতিতে। তবে ছেলের প্রতি মানুষের ভালোবাসা আর বিশ্বাস দেখে সেই আপত্তি আর টেকেনি। তাই তো মাত্র ২২ বছর বয়সে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ার সময় হয়েছিলেন এলাকার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি।
বলছিলাম আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের কথা।
রোববার দিবাগত রাত ৩টায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন বদর উদ্দিন আহমদ কামরান। তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৯ বছর।
কামরানের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। শোকবার্তায় রাষ্ট্রপতি বলেন, প্রথম নির্বাচিত মেয়র হিসেবে সিলেটের উন্নয়নে তিনি যে অবদান রেখেছেন সেজন্য মানুষ তাঁকে সব সময় মনে রাখবে। তাঁর মৃত্যুতে দেশ একজন নিবেদিত প্রাণ নেতা হারাল।
কামরানের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী শোকবার্তায় বলেন, স্বীয় কর্মের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নেতা কামরান গণমানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন।
১৯৫১ সালের ১ জানুয়ারি সিলেট শহরে জন্মগ্রহণ করেন কামরান। শিক্ষাজীবনের শুরু হয় শহরের জিন্দাবাজারের দুর্গাকুমার পাঠশালায়। এরপর সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক এবং এমসি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করেন। তিনি যখন এমসি কলেজে বিএ ক্লাসে যান তখনই তিনি একজন পৌর কমিশনার। ক্লাস করতে গেলে ছাত্র-শিক্ষক সবাই তাঁকে আলাদা চোখে দেখতেন। শিক্ষকদের মধ্যে অনেকে রসিকতা করে ‘কমিশনার সাব’ বলে ডাকতেন।
তবে এমসি কলেজে সে সময় উপস্থিতির ক্ষেত্রে খু্ব কড়াকড়ি ছিল। আর জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব সামলে সব সময় ক্লাস করা কামরানের পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। বাধ্য হয়ে তাই কামরানকে কলেজ পরিবর্তন করতে হয়। মদন মোহন কলেজ থেকে ১৯৭৬ সালে স্নাতক ডিগ্রি পাস করেন তিনি।
কামরান এলাকায় মানুষের সুখ-দুঃখে পাশে দাঁড়াতে শুরু করেছিলেন কৈশোরেই। তাদের সমর্থনেই উচ্চ মাধ্যমিকে পড়া অবস্থায় পৌরসভার ভোটে দাঁড়ান তিনি।
১৯৭৩ সালের সেই নির্বাচনে ৬৪২ ভোট পেয়ে সিলেট পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার নির্বাচিত হন কামরান। সে সময় তিনিই ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ জনপ্রতিনিধি। ১৫ বছর পৌর কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এরপর কিছু দিন তিনি বিদেশে ছিলেন। বিদেশ থেকে ফিরে এসে ১৯৯৫ সালে তিনি সিলেট পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
২০০২ সালে সিলেট পৌরসভা সিটি করপোরেশনে উন্নীত হওয়ার পর কামরান মেয়র মনোনীত হন। পরের বছর সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনে জিতে মেয়র পদ ধরে রাখেন তিনি।
২০০৭-০৮ সালে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দুই দফা গ্রেপ্তার হয়ে ১৮ মাস কারাবন্দি ছিলেন কামরান। সে সময় জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা এই আওয়ামী লীগ নেতা কারাগারে থেকে নির্বাচন করেও বিপুল ভোটে জয়ী হন।
২০১৩ সালের নির্বাচনে বিএনপির আরিফুল হক চৌধুরীর কাছে হেরে গিয়ে মেয়র পদ হারান কামরান। এরপর ২০১৮ সালের নির্বাচনেও তিনি লড়েছিলেন, কিন্তু জয়ী হতে পারেননি।
১৯৮৯ সাল থেকে সিলেট শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর ২০০২ সালে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি হন কামরান। সেই দায়িত্ব তিনি সামলেছেন প্রায় দেড় যুগ। ২০১৬ সালে আওয়ামী লীগের সম্মেলনে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য পদ পাওয়া কামরান বর্তমান কমিটিতেও একই পদে ছিলেন। ২০১৯ সালে নতুন কমিটি গঠিত হলে মহানগরের সভাপতি পদে নতুন মুখ আসে। তবে কামরান রাজনীতি থেকে দূরে সরে যাননি। দলের প্রতিটি কর্মসূচিতে কর্মীদের সঙ্গে তাঁকে দেখা গেছে।
তবে সবসময়ই সিলেটবাসীর সুখ-দুঃখের সাথী হয়ে থেকে হয়ে উঠেছিলেন গণমানুষের নেতা।
দুই ছেলে ও এক মেয়ের বাবা কামরান সিলেটের সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও পৃষ্ঠপোষকতা করে গেছেন। শিশু কিশোর সংগঠন চাঁদের হাটের সদস্য ছিলেন বদর উদ্দিন আহমদ কামরান।
রাজনৈতিক সহকর্মীরা বলছেন, মানুষের যে ভালোবাসা কামরানের জন্য ছিল, তা কখনোো ফুরিয়ে যাবে না।