গুন্টার গ্রাসের মৃত্যুদিন
টিন ড্রামের বাদ্যকর

যুদ্ধোত্তর কালের কথাসাহিত্যিক গুন্টার ভিলহেলম গ্রাস। জন্ম ১৬ অক্টোবর, ১৯২৭ ডানজিগ শহরে, যা বর্তমানে পোল্যান্ডের অন্তর্ভুক্ত। পারিবারিক সূত্রে তিনি ছিলেন কাশুবিয়ান আদিবাসী। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আট বছর পরে জন্মেছিলেন তিনি। প্রত্যক্ষভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ স্মৃতি তার অবচেতনে না থাকলেও, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-৪৫) ভয়াবহতা ও হিটলারের নাৎসি বাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতন তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন।
১৯৪৫ সালের মে মাস। ভাপেন এসএস-এ কিশোর সৈনিক হিসেবে সংক্ষিপ্ত পরিষেবা দেওয়ার ফলে মার্কিন বাহিনী তাকে বন্দি করে নিয়ে যায়। বন্দিজীবন থেকে ১৯৪৬ সালের এপ্রিল মাসে মুক্তি পান তিনি। একজন স্টোনম্যাসন এবং ভাস্কর হিসেবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তির পর, ১৯৫০-এর দশকে তিনি শুরু করেন লেখালেখি। গ্রাসের কথাসাহিত্যে বারবার উল্লেখ রয়েছে তার শৈশবের ডানজিগ শহরের।
যে 'ম্যাজিক রিয়েলিজম' বা জাদুবাস্তবতাবাদ নিয়ে আজ বিশ্ব সরব, তা আসলে ১৯৬১ সালে প্রথম আবিষ্কার করা যায় গুন্টার গ্রাসের লেখায়। আরো কয়েকটি বিষয় তার উপন্যাসে লক্ষ্যণীয়, তা হলো প্রাণী ও জীবজন্তুর ব্যবহার। উপন্যাসের শিরোনামে শুধু নয়; চরিত্রের অনুষঙ্গ হিসেবেও মাছ, বিড়াল, ইঁদুর বারবার এসেছে তার লেখায়। অবশ্যই প্রতীক হিসেবে এদের নতুন ব্যঞ্জনা দিতে চেষ্টা করেছেন তিনি। তার অন্য অনেক অগ্রজ লেখক বিশেষ করে আলবেয়ার কাম্যু, টমাস মান, হেইনরিখ বোলের সার্থক উত্তরসূরি হিসেবে তিনি সবার নমস্য। তিনি ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, কবি, নাট্যকার, ভাস্কর ও গ্রাফিক ডিজাইনার।
১৯৫৯ সালে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস 'টিন ড্রাম'-এর জন্য বিপুল খ্যাতি অর্জন করেন গুন্টার গ্রাস। ইউরোপীয় জাদুবাস্তবতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখনী এবং ট্রিলজির প্রথম অংশ যাতে ক্যাট অ্যান্ড মাউস ও ডগ ইয়ার্স অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। জার্মানির ডানজিগ শহরের পটভূমিতে লেখা, যে শহরটিতে জন্মেছেন ও বেড়ে উঠেছেন লেখক। স্মরণ করিয়ে দেয় 'ডাবলিনার' গল্পগ্রন্থের স্রষ্টা জেমস জয়েসকে, যিনি তাঁর প্রিয় জন্ম-শহর ডাবলিনারকে তার গল্পে রেখেছেন অমর করে।
গুন্টার গ্রাসের টিন ড্রাম চলচ্চিত্রায়িত হয়ে পৌঁছে গেছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এবং পেয়েছে বিপুল দর্শকপ্রিয়তা ও একাডেমি অ্যাওয়ার্ড। 'ক্যাট অ্যান্ড মাউস' তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস, যা বিশ্বখ্যাত প্রকাশক পেঙ্গুইন থেকে প্রকাশিত হয়। ১৩৭ পৃষ্ঠার ক্ষীণকায় এ উপন্যাস অনুবাদ করেছিলেন রাল্ফ ম্যানহেইস। ঈশপের গল্প বলার ভঙ্গি, অনেকটা সাবলীল ও স্বচ্ছন্দ এক আঙ্গিক বেছে নিতে ভালোবাসেন গ্রাস। ১৯৬১ সালে প্রকাশিত 'ক্যাট অ্যান্ড মাউস' উপন্যাসে তীক্ষ্ম ও অনুপুঙ্খ বর্ণনা আছে। অসম্ভব পর্যবেক্ষণশক্তির অধিকারী গ্রাসের আছে কটাক্ষ অভিযোগ আর অতীতের কথাচিত্র। জার্মানির যুদ্ধ-পরবর্তী বাস্তবতাকে এঁকেছেন তিনি। এই যে চূড়ান্ত বাস্তবতা, এটা জার্মান সাহিত্যধারার বাস্তবতাবাদ। কিন্তু যে জাদুবাস্তবতাবাদ ইদানীং উচ্চারিত হচ্ছে, যা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, তা নতুন কোনো বিষয় নয়।
গ্রাসের প্রায় প্রতিটি উপন্যাসে মাছ কিংবা প্রাণিজগতের সদস্যরা বিশেষ ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছে। মূলত শিল্পী ও স্থপতি আবার একই সঙ্গে কবি ও নাট্যকার ছিলেন তিনি। যার অতীত স্মৃতিময়, নাৎসিদের ব্যাখ্যাতীত নিষ্ঠুরতায় বিপর্যস্ত সেই ছেলেবেলা। বাবা ছিলেন ছোট মাপের মানুষ, স্বল্প আয়ের সামান্য এক মুদি দোকানের মালিক। মা ভিন্ন সম্প্রদয়ের এক গৃহবধূ। প্রিয় শহর ডানজিগে জন্ম ও বেড়ে ওঠা। 'টিন ড্রাম' ও 'ক্যাট অ্যান্ড মাউস' উপন্যাসে গভীর বেদনা ও গর্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এ শহর।
অন্য এক উপন্যাস 'দ্য ফ্লাউন্ডার'-এ তাঁর সময়ের সামাজিক-রাজনৈতিক বিশ্লেষণ করেছেন তিনি। নারী-পুরুষের চিরকালীন দ্বন্দ্ব-বিরহকে ঘটনার মুখোমুখি এক নাজুক প্রেক্ষাপটে রেখে রস ও ব্যঙ্গাত্মক ভাষায় প্রশ্ন করা হয়েছে মানবসভ্যতার এই মানবজমিন নির্মাণে নারী-পুরুষের যে ঐতিহাসিক ভূমিকা রয়েছে, তা কতটা কার্যকর, যদি কার্যকর না হয়, কোথায় তার অপূর্ণতা।
নিঃসন্দেহে এ রকম প্রশ্ন কেউ এর আগে উত্থাপন করেননি। এ কারণে সুইডিশ একাডেমি ১৯৯৯ সালে গ্রাসকে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার সময় এ রকম একটা বক্তব্য দিয়েছেন: ভুলে যাওয়া অতীতকে পুনরুদ্ধারের এক অপূর্ব ক্ষমতা তাঁর (গুন্টার গ্রাস) লেখায় মূর্ত হয়ে উঠেছে। একজন লেখক তাঁর দেওয়া সাক্ষাৎকার, চিঠিপত্র, ডায়েরি ও স্মৃতিকথায় নিজেকে উন্মোচন করেন। আমরা গ্রাসকেও তাঁর স্মৃতিকথা, ডায়েরি এবং মৃত্যুর কিছুকাল আগে প্রকাশিত আত্মজীবনীতে পরিপূর্ণভাবে খুঁজে পাই। একজন মানবতাবাদী লেখক যিনি যুদ্ধক্লান্ত জার্মানিতে ঘৃণা উৎখাতে সচেষ্ট, যে লেখক ঢাকা-কলকাতা ভ্রমণ শেষে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা তীক্ষ্ম ভাষায় লিপিবদ্ধ করেন।
তিন খণ্ডের আত্মজৈবনিক গ্রন্থ 'পাইলিং দ্য ওনিয়ন'-এ তাঁর শৈশব, যৌবন, শিক্ষাজীবন, প্রেম ও বিয়ে, রাজনীতি, দেশ ও সমাজ নিয়ে তার ভাবনা খুব সরাসরি ব্যক্ত করেছেন তিনি খোলামেলাভাবে।
রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত এই লেখকের সাহিত্যচর্চা ছিল প্রথম প্রেম, প্রথম প্রণয়ের মতো। ছবিও আঁকতেন। তাঁর বইয়ের প্রচ্ছদ তিনি নিজেই করতেন। গ্রাফিক্স ডিজাইনেও ছিল তাঁর চমৎকার হাত। একই সঙ্গে স্থপতিও ছিলেন। ২০০৬ সালে প্রকাশিত 'পাইলিং দ্য ওনিয়ন' আত্মজীবনীর ট্রিলজি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনূদিত হয়ে পাঠকপ্রিয়তা পেতে থাকে। কিন্তু একই সঙ্গে আত্মজীবনী প্রকাশিত হওয়ার পর তার অতীতের কিছু বিষয় নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। এক সাক্ষাৎকারে তাঁকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমার ওপর ভারবাহী হয়ে ছিল অতীতের যেসব বিষয়, সেসব ঘটনা লিখতে পেরে আমি নিজেকে দায়মুক্ত মনে করছি।’ যুদ্ধ-পরবর্তী প্রজন্মদের নিয়ে জার্মান জাতিকে পুনর্গঠনের বেশকিছু দিকনির্দেশনা এ ট্রিলজিতে ব্যক্ত করেছেন গুন্টার।
লেখালেখির ব্যাপারে গুন্টার ছিলেন সব সময়ই নিরীক্ষামূলক। তাঁর গদ্য তীক্ষ্ম, সাবলীল ও দৃঢ়। তাঁর উপন্যাসে সময়কে গভীর বিশ্লেষণে চিত্রিত করা হয়েছে। যেহেতু তিনি রাজনীতিসচেতন লেখক, তিনি সমাজ ও সময়কে আন্তরিকভাবে তাঁর লেখায় মূর্ত করে তুলেছেন। তাঁর লেখায় দ্বন্দ্ব আছে, কিন্তু কোনো ফাঁকফোকর নেই।
স্মৃতিময়তা গুন্টার লেখার আরেকটি উল্লেখযোগ্য প্রবণতা। তার বেশির ভাগ উপন্যাসে ডানজিগ শহর ঘুরেফিরে বারবার এসেছে, কখনো স্মৃতিচিত্র হয়ে কখনো আত্মজৈবনিক বিশ্লেষণে ভাস্বর হয়ে।
একজন লেখককেও যে সামাজিক ও রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করতে হয়, এ কথাটি গুন্টার স্মরণ করিয়ে দেন আমাদের। আফগানিস্তানে জার্মানি সৈন্য পাঠানোর প্রশ্নে তিনি দ্বিমত পোষণ করেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধেরও বিরোধিতা করেছিলেন তিনি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ঐতিহাসিক ভূমিকা আজও আমরা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি।
২০১৫ সালের ১৩ এপ্রিল জার্মানির লুবেক শহরে ৮৭ বছর বয়সে ফুসফুসের সংক্রমণ জনিত কারণে মারা যান সব্যসাচী লেখক গুন্টার গ্রাস। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শেষ হয় জার্মান সাহিত্যের তথা বিশ্বসাহিত্যের একটি অধ্যায়।