চতুর্থ পর্ব
রবির জীবনে মৃত্যুশোক

রেণুকা দেবী
রবীন্দ্রনাথের মেজো মেয়ে।
মৃত্যু : ২৮ ভাদ্র ১৩১০ বঙ্গাব্দ, ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দ, সোমবার।
প্রথম অবস্থায় রেণুকা দেবীর যক্ষ্মার লক্ষণ খুসখুসে কাশিকে সম্ভবত গলার অসুখ বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল। সে কারণেই প্রথম দিকে সাধারণ চিকিৎসা দেওয়ার পর হাওয়া বদলের জন্য তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় মধুপুরে ও হাজারিবাগে। কিন্তু তাতে বিশেষ কোনো উপকার হয় না। যার ফলে বছরের শুরুতে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় আলমোরা পাহাড়ে। রেণুকার চিকিৎসায় প্রথমে হোমিওপ্যাথি অতঃপর অ্যালোপ্যাথি শুরু করা হয়। চলে কবিরাজি ওষুধের ব্যবস্থাও। বিশ শতকের শুরুতে যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসায় ওজোন গ্যাস উপকারী বলে ধারণা করা হতো বলে রেণুকাকে ওই চিকিৎসাও প্রদান করা হয়। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। রবীন্দ্রনাথের জোড়াসাঁকোর লালবাড়িতে রেণুকার মৃত্যু হয়।
রবীন্দ্র-জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় তাঁর বইয়ে এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘বৈশাখের ১৩১০ খ্রিষ্টাব্দ শেষ দিকে হাজারিবাগ হইতে রবীন্দ্রনাথ রুগণা কন্যাকে লইয়া আলমোরা রওনা হইলেন। সেই ঠেলাগাড়ি-পুসপুসে দীর্ঘ পথ বাহিয়া গিরিডিতে প্রত্যাবর্তন, সেই পুরাতন ডাকবাংলোয় অবস্থান। রেলের গাড়ি রিজার্ভেশন পাইবার জন্য উদবেগপূর্ণ প্রতীক্ষায় তিন দিন অতিবাহন। বহু চেষ্টায় রিজার্ভ গাড়ি পাওয়া গেল বটে, তবে উহা মেল গাড়িতে জুড়িয়া দিবার ব্যবস্থা না হওয়ায় তাঁহাদের দুঃখের অবধি থাকিল না। কবি আলমোরা হইতে গিরিডির সুধাংশুবিকাশ রায়কে লিখিতেছেন, ‘যে সময়ে বেরিলি পৌঁছিবার কথা তাহার বারো ঘণ্টা পরে পৌঁছিলাম। সেখানে একদিনও অপেক্ষা না করিয়া সেইদিনই কাঠগোদামে আসিতে হইল। সেখানে না পাইলাম থাকিবার জায়গা, না পাইলাম আলমোরা যাইবারকুলি, সেই দ্বিপ্রহর রৌদ্রে অনাহারে রেণুকাকে লইয়া এক্কায় চড়িয়া রানীবাগ নামক এক জায়গায় ডাকবাংলায় গিয়া কোনোমতে অপরাহ্ণে আহারাদি করা গেল... কোনোপ্রকারে গম্য স্থানে আসিয়া পৌঁছিয়াছি।... আলমোরায় পৌঁছিয়া মোহিতচন্দ্রকে লিখিলেন, (২৫ বৈশাখ ১৩১০ বঙ্গাব্দ) আলমোরায় পৌঁছিলাম। অতি দুর্গম পথ। অনেক কষ্ট দিয়াছে। সৌভাগ্যক্রমে পথে রেণুকা ভাল ছিল।... জায়গাটি ভালো, বাতাসটি বেশ, বাড়িটি আরামের। চারি দিকে ফল-ফুলের বাগান, ফলে ফুলে পরিপূর্ণ।’
৯ আষাঢ় ১৩১০ বঙ্গাব্দ রবীন্দ্রনাথ কলকাতা থেকে আলমোরার উদ্দেশে রওনা হন। ১৫ আষাঢ় ১৩১০ বঙ্গাব্দ তিনি জগদীশচন্দ্রকে লেখেন : ‘রেণুকার সংশয়াপন্ন অবস্থার টেলিগ্রাফ পাইয়া আমাকে ছুটিয়া আসিতে হইয়াছে। তাহাকে জীবিত দেখিব এরূপ আশামাত্র ছিল না। ডাক্তাররা তাহাকে কেবলই Strychnine ব্রাণ্ডি প্রভৃতি খাওয়াইয়া কোন মতে কৃত্রিম জীবনে সজীব রাখিবার চেষ্টায় ছিল। আমি যেদিন আসিয়া পৌঁছিলাম সেদিন তাহারা রোগীর জীবনের আশা পরিত্যাগ করিয়াছিল। আমি আসিয়াই সমস্ত Stimulants বন্ধ করিয়া দিয়া হোমিয়োপ্যাথি চিকিৎসা করিতেছি। রক্ত ওঠা বন্ধ হইয়া গেছে, কাশি কম, জ্বর কম, পেটের অসুখ কম, বিকারের প্রলাপ বন্ধ হইয়া গেছে, বুকের ব্যথা নাই, বেশ সহজ ভাবে কথাবার্ত্তা কহিতেছে, অনেকটা সবল হইয়াছে, আশা করিতেছি এই ধাক্কাটি কাটিয়া গেল।’
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় আরো উল্লেখ করেন, ‘আলমোরায় মাসখানেক থাকিবার পর, রেণুকাকে একটু ভালো দেখিয়া, কবি কলিকাতায় আসিলেন; দীর্ঘকাল বাংলাদেশ হইতে বিচ্ছিন্ন থাকা তাঁহার পক্ষে সম্ভব নহে। ছেলেমেয়েরা নানা স্থানে বিচ্ছিন্ন, বিদ্যালয় নানা ঘাত-প্রতিঘাতে বিপর্যস্ত, জমিদারির কাজ তদারকের অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, সময়মত তাগিদের অভাবে কাব্যগ্রন্থের মুদ্রণকার্য স্তব্ধ। এইরূপ নানা কাজে, নানা বন্ধনে তিনি বন্ধী। তাই শ্যালক নগেন্দ্রনাথের উপর কন্যার ভার দিয়া কলিকাতায় ফিরিলেন। আষাঢ় মাসটা কলিকাতায় বোলপুরে শিলাইদহে ঘুরিতে ঘুরিতে কাটিয়া গেল। কলিকাতায় আসিবার অন্যতম কারণ হইতেছে সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিবাহ (১৪ আষাঢ় ১৩১০ বঙ্গাব্দ)।... এমন সময়ে আলমোরা হইতে টেলিগ্রাম পাইলেন যে, রেণুকার ব্যাধি বৃদ্ধি পাইতেছে; কবিকে তখনি কলিকাতা ছাড়িতে হইল। যাহাই হউক আলমোরায় পৌঁছিয়া দেখেন বিপদের প্রথম ধাক্কা কাটিয়া গিয়াছে; সুতরাং পর্বত হইতে প্রান্তরে নামিয়া আসিবার প্রয়োজন সাময়িকভাবে মুলতবি থাকিল। তা ছাড়া জামাতা সত্যেন্দ্র আসায় তিনি কিয়ৎপরিমাণে নিশ্চিন্ত হইলেন। ৭ই ভাদ্র [১৩১০ বঙ্গাব্দ] রেণুকাকে লইয়া আলমোরা ত্যাগ করিলেন। কবির ইচ্ছা ছিল যে আরো কিছুকাল তাহাকে লইয়া সেখানে থাকেন, কিন্তু রেণুকা যেন বুঝিতে পারিয়াছিল যে, এই পৃথিবীতে তাহার আয়ুকাল সংকীর্ণ হইয়া আসিতেছে; তাই সে অনাত্মীয় বিদেশে মরিবে না। অত্যন্ত জিদ ধরায় কবিকে পাহাড় হইতে নামিতে হইল। নামিবার সময়ও যথেষ্ট কষ্ট পাইয়াছিলেন। কলিকাতায় পৌঁছিবার কয়েক দিনের মধ্যে রেণুকার মৃত্যু হয় (১৩১০ ভাদ্রের শেষে)। কবিজায়ার মৃত্যুর নয় মাসের মধ্যে কন্যার মৃত্যু হইল, ইহাই কবির প্রথম সন্তানশোক।’
সতীশচন্দ্র রায়
অধ্যাপক, ব্রহ্মচর্যাশ্রম বিদ্যালয়।
মৃত্যু : ১৮ মাঘ ১৩১০ বঙ্গাব্দ, ১ ফেব্রুয়ারি ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দ, সোমবার, মাঘী পূর্ণিমার দিনে। বসন্ত রোগে। তাঁর বসন্ত রোগটি গুটিবসন্ত বলে জানা যায়।
ব্রহ্মচর্যাশ্রম বিদ্যালয়ে মাত্র এক বছর শিক্ষকতার পর মৃত্যুবরণ করেন সতীশচন্দ্র রায়। এই শিক্ষকটি রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত প্রিয়ভাজন ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর মোহিতচন্দ্র সেনকে লেখা এক দীর্ঘ চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর এ প্রিয় মানুষটির জন্য অত্যন্ত শোক অনুভব করেন। সেই চিঠির এক জায়গায় তিনি বলেন : ‘সতীশের মৃত্যুতে আমার জীবন ও কর্ম্মের মধ্যে আর খানিকটা শূন্যতা বৃদ্ধি হইল।’
অজিতকুমার চক্রবর্তীকে এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘সতীশের জীবনটুকু আমাদের বিদ্যালয় এবং আমাদের সাধনার সঙ্গে জড়িত হয়ে গেছে। সে আমাদের বিদ্যালয়কে শক্তিও দিয়েছে, সৌন্দর্যও দিয়েছে... তার সেই জীবনের দানটি ক্রমেই আমাদের কাছে সত্য হয়ে উঠতে থাকবে।... তার নির্মল জীবনের তীর্থসলিল একেবারে নিঃশেষ ঢেলে দিয়ে সে আমাদের বিদ্যালয়ের অভিষেক করে গেছে।’
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথের বাবা।
মৃত্যু : ৬ মাঘ ১৩১১ বঙ্গাব্দ, ১৯ জানুয়ারি ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দ, বৃহস্পতিবার, দুপুর ১.৫৫ মিনিটে। ৮৮ বছর ৮ মাস বয়সে।
দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন ঠাকুরবাড়ির সার্বভৌম অভিভাবক। তাঁর কথাকেই চূড়ান্ত বলে গণ্য করা হতো সব সময়। তাঁর মৃত্যুতে ঠাকুর পরিবারে তো বটেই, বাংলায় ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনে এক বিশাল শূন্যতার সৃষ্টি হয়।
দেবেন্দ্রনাথের মৃত্যু প্রসঙ্গে প্রশান্তকুমার পাল বলেন, “মাঘোৎসবের মাত্র পাঁচ দিন আগে মহর্ষির মৃত্যু হওয়ায় ১১ মাঘ ১৩১১ বঙ্গাব্দ [মঙ্গলবার, ২৪ জানুয়ারি ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দ] আদি ব্রাহ্মসমাজের পঞ্চসপ্ততিতম সাম্বৎসরিক অনুষ্ঠিত হবে না বলে প্রচারিত হলেও শেষ মুহূর্তে এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তিত হয়। ব্রহ্মোৎসব বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত কেন পরিবর্তন করা হল তার ব্যাখ্যা করে রবীন্দ্রনাথ বললেন : ‘যিনি এ গৃহের স্বামী ছিলেন, তাঁহার মৃত্যুতে এই গৃহের কর্মপ্রবাহ সহসা স্তব্ধ হইতে পারে, সংসারযাত্রায় সমস্ত রথচক্র সহসা অবরুদ্ধ হইতে পারে, পরিজনবর্গের উৎসাহ উল্লাস সহসা ম্লান হইতে পারে, কিন্তু এই গৃহস্বামী যাঁহাকে তাঁহার চিরজীবনের স্বামী বলিয়া বরণ করিয়াছিলেন, তাঁহার উৎসব তো লেশমাত্র ক্ষুণ্ণ হইতে পারে না। ‘ঈশাবাস্যমিদং সর্বং’ এই শ্লোকটি মহর্ষির জীবনে যে পরিবর্তন এনেছিল তা বর্ণনা করে তিনি বললেন: ‘এই ক্ষুদ্র শ্লোকটি যে দেবেন্দ্রনাথের নিকট তাঁহার সমস্ত ভোগৈশ্বর্যের অপেক্ষা বৃহৎ হইয়া উঠিয়াছিল, তাঁহার জীবনের সেই ঘটনাটি এখন হইতে চিরদিন আমাদের সম্মুখে মুক্তির পথ নির্দেশ করিয়া দিবে, মানুষের ভোগের বন্ধন শিথিল ও তাহার স্বার্থসুখকে লঘু করিতে থাকিবে, ইহা মনুষ্যত্বের ভাণ্ডারে চিরদিনের জন্য সঞ্চিত হইয়া রহিল।”
রবীন্দ্রনাথ তাঁর পিতার দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর তাঁর প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মসমাজের হাল তিনি ধরেন। পিতার মৃত্যুর পরে রবীন্দ্রনাথ যে উপাসনাটি পাঠ করেন তা ‘তত্ত্ববোধনী’ পত্রিকা ছাড়াও ‘বঙ্গদর্শন’-এর ফাল্গুন সংখ্যা এবং ‘সমালোচনী’র চৈত্র সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।
সেই প্রবন্ধের মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর পিতার জীবনসাধনার বৈশিষ্ট্যটিকে সবার কাছে স্পষ্টতর করার প্রয়াস করেছেন। রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘ঘোর সংকটের সময় একদিন তাঁহার সম্মুখে একই কালে শ্রেয়ের পথ ও প্রেমের পথ উদ্ঘাটিত হইয়াছিল। তখন সর্বস্ব হারাইবার সম্ভাবনা তাঁহার সম্মুখে ছিল তাঁহার স্ত্রী পুত্র ছিল, তাঁহার মানসম্ভ্রম ছিল, তৎসত্ত্বেও যেদিন তিনি শ্রেয়ের পথ নির্বাচন করিয়া লইলেন সেই মহাদিনের কথা আজ যেন আমরা একবার স্মরণ করিবার চেষ্টা করি। তাহা হইলে আমাদের বিষয়লালসার তীব্রতা শান্ত হইয়া আসিবে এবং সন্তোষের অমৃতে আমাদের হৃদয় অভিষিক্ত হইবে। অর্জনের দ্বারা তিনি যাহা আমাদিগকে দিয়াছেন তাহা আমরা গ্রহণ করিয়াছি; বর্জনের দ্বারা তিনি যাহা আমাদিগকে দিয়াছেন তাহাও যেন গৌরবের সহিত গ্রহণ করিবার যোগ্য আমরা হইতে পারি। দেবেন্দ্রনাথ মানুষ হিসেবে কতখানি উদার ছিলেন তা রবীন্দ্রনাথ ব্যক্ত করেন তাঁর এ প্রবন্ধের মধ্য দিয়ে। ব্যক্তিজীবনে ধর্মবিশ্বাস ও ব্রাহ্মধর্ম পালনের পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর পিতার ভূমিকা সম্পর্কে বলেন : ...তিনি কোনো বিশেষ মতকে অভ্যাস বা অনুশাসনের দ্বারা আমাদের উপর স্থাপন করিতে চান নাই, ঈশ্বরকে ধর্মকে স্বাধীনভাবে সন্ধান করিবার পথ তিনি আমাদের সম্মুখে মুক্ত করিয়া দিয়াছেন।... এই পরিবারের মধ্য দিয়া যিনি অচেতন সমাজকে ধর্মজিজ্ঞাসায় সজীব করিয়া দিয়াছেন, যিনি নূতন ইংরেজি শিক্ষার ঔদ্ধত্যের দিনে শিশুবঙ্গভাষাকে বহুযত্নে কৈশোরে উত্তীর্ণ করিয়া দিয়াছেন। যিনি দেশকে তাহার প্রবীণ ঐশ্বর্যের ভাণ্ডার উদ্ঘাটিত করিতে প্রবৃত্ত করিয়াছেন, যিনি তাঁহার তপঃ পরায়ণ একলক্ষ্য জীবনের দ্বারা আধুনিক বিষয়লুব্ধসমাজে ব্রহ্মনিষ্ঠ গৃহস্থের আদর্শ পুনঃস্থাপিত করিয়া গিয়াছেন, তিনি এই পরিবারকে সমস্ত মনুষ্য-পরিবারের সহিত সংযুক্ত করিয়া দিয়া, ইহার সর্বোচ্চ লাভকে সমস্ত মনুষ্যের লাভ করিয়া দিয়া, ইহার পরম ক্ষতিকে সমস্ত মনুষ্যের ক্ষতি করিয়া দিয়া, আমাদিগকে যে গৌরব দান করিয়াছেন, অন্য সমস্ত ক্ষুদ্র মানমর্যাদা বিস্মৃত হইয়া অদ্য আমরা তাহাই স্মরণ করিব ও একান্ত ভক্তির সহিত তাঁহার নিকট আপনাকে প্রণত করিয়া দিব।’
(চলবে)