‘থ্রি ইডিয়টস’ খ্যাত সোনম ওয়াংচুক
ভারতীয় বীর থেকে ‘দেশদ্রোহী’ হওয়ার গল্প

২০১৯ সালের ৫ আগস্টের রাতে জম্মু ও কাশ্মীরে ভারতের নিরাপত্তা বাহিনীর কঠোর অভিযানে শত শত কাশ্মীরিকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই অভিযানের আগে ভারত সরকার অঞ্চলটির বিশেষ মর্যাদা ও রাজ্যের অধিকার প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়।
এমন সিদ্ধান্তে লাদাখের বিশিষ্ট পরিবেশবিদ ও সমাজকর্মী সোনম ওয়াংচুক প্রকাশ্যে আনন্দ প্রকাশ করেছিলেন এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন।
তিনি এক্সে লিখেছিলেন, “ধন্যবাদ প্রধানমন্ত্রী, লাদাখের বহুদিনের স্বপ্ন পূরণের জন্য।”
ভারতের অন্যতম বিখ্যাত উদ্ভাবক ও শিক্ষাবিদ হিসেবে পরিচিত ওয়াংচুক তখন বলেছিলেন, লাদাখের বহু পুরনো দাবি—জম্মু ও কাশ্মীর থেকে আলাদা একটি প্রশাসনিক অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি—অবশেষে বাস্তবায়িত হয়েছে। আগে লাদাখ ছিল জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের অংশ। ২০১৯ সালের আগস্টে মোদি সরকার সেটিকে আলাদা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করে।
তবে যেখানে জম্মু ও কাশ্মীরকে একটি নির্বাচিত আইনসভা রাখার অনুমতি দেওয়া হয়, লাদাখকে তা থেকে বঞ্চিত করা হয়। নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সিদ্ধান্তের কোনো ক্ষমতা না থাকায় পরবর্তী ছয় বছরে লাদাখে ধীরে ধীরে ক্ষোভ জমতে থাকে। আর সেই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন একসময়ের মোদি-সমর্থক—সোনম ওয়াংচুক। খবর আল জাজিরার।
গ্রেপ্তার ও অভিযোগ
চলতি বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর ওয়াংচুককে গ্রেপ্তার করে রাজস্থানের জোধপুর জেলে পাঠানো হয়। তার বিরুদ্ধে “রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ” ও “সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রের” অভিযোগ আনা হয়েছে। কারণ, তার নেতৃত্বাধীন শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের একটি অংশ সহিংস হয়ে ওঠে এবং লাদাখে বিজেপির কার্যালয় আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এ সময় নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে চারজন নিহত হন।
যে বিজেপি একসময় ওয়াংচুককে প্রচারণায় ব্যবহার করেছিল, আজ সেই দলই তাকে ‘দেশদ্রোহী’ বলছে।
তার স্ত্রী গীতাঞ্জলি আংমো বলেন, “এক মাস আগেও যে সরকার তাকে সম্মান দিচ্ছিল, আজ সেই সরকারই তাকে দেশবিরোধী বলছে। কারণ একটাই—তাকে তারা কিনতে পারেনি, তাই ভয় দেখাচ্ছে।”
‘লেহ-তে শোক’
সেপ্টেম্বরে ওয়াংচুকের নেতৃত্বে লাদাখে শান্তিপূর্ণ অনশন শুরু হয়। তারা দাবি করছিলেন ভারতের সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের অধীনে সাংবিধানিক সুরক্ষা—যা আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোকে প্রশাসনিক স্বায়ত্তশাসন দেয়। লাদাখের ৯০ শতাংশ মানুষই আদিবাসী সম্প্রদায়ের।
১৫তম দিনে আন্দোলনকারীর একটি দল লেহ শহরে বিজেপি অফিসে আগুন লাগায়। নিরাপত্তা বাহিনী গুলি চালায়—চারজন নিহত হন, অনেকে আহত হন। এরপর ব্যাপক দমন অভিযান শুরু হয়, ৮০ জনের বেশি মানুষ গ্রেপ্তার হন, যার মধ্যে ওয়াংচুকও ছিলেন।

তিনি গ্রেপ্তার হন ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট (এনএসএ) আইনে—যা বিচার ছাড়াই এক বছর পর্যন্ত আটক রাখার সুযোগ দেয়।
এই দমন অভিযানকে লাদাখের ইতিহাসে সবচেয়ে কঠোর দমননীতি বলা হচ্ছে।
এই ঘটনার পরপরই আন্দোলনে অংশ নেওয়া এক ব্যবসায়ী স্তানজিন দর্জে আত্মহত্যা করেন। লাদাখ বৌদ্ধ সমিতির সভাপতি ত্সেরিং দর্জে বলেন, “সে সোনমের অনুরাগী ছিল। সারাক্ষণ তার নাম বলত। এখন আমরা সবাই লেহ শহরে শোক করছি—আমাদের জনগণ হয় নিহত, নয় কারাগারে।”
একজন জাতীয় বীর থেকে অভিযুক্ত
১৯৬৬ সালে উলেতকপো গ্রামে জন্ম নেওয়া ওয়াংচুক প্রথমে মায়ের কাছেই শিক্ষালাভ করেন। পরে শ্রীনগর ও দিল্লিতে পড়াশোনা করে ১৯৮৮ সালে প্রকৌশল ডিগ্রি অর্জন করেন।
তিনি এসইসিএমওএল (লাদাখের ছাত্রদের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন) প্রতিষ্ঠা করেন—যেখানে স্থানীয় শিক্ষার্থীদের মাতৃভাষায় শিক্ষা ও হাতে-কলমে শেখার সুযোগ দেওয়া হয়। তার প্রচেষ্টায় শিক্ষার্থীদের পাশের হার ৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৭৫ শতাংশে পৌঁছায়।

তিনি বরফ-স্তূপ ও সৌর তাঁবুর মতো উদ্ভাবনের জন্য বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেন। ২০১৮ সালে রামন মাগসাইসাই পুরস্কার পান তিনি, যা এশিয়ার নোবেল হিসেবে পরিচিত।
বলিউডের বিখ্যাত চলচ্চিত্র থ্রি ইডিয়টস-এর “ফুন্সুখ ওয়াংরু” চরিত্রটি তার জীবন থেকে অনুপ্রাণিত।
‘দেশবিরোধী’ তকমা ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগ
এখন লাদাখ পুলিশ বলছে, ওয়াংচুকের পাকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগের প্রমাণ রয়েছে—এক পাকিস্তানি গুপ্তচর তার আন্দোলনের ভিডিও শেয়ার করেছিল বলে দাবি। তারা আরও বলছে, ওয়াংচুক একবার পাকিস্তানে জাতিসংঘ-সহায়তাপ্রাপ্ত একটি জলবায়ু সম্মেলনে গিয়েছিলেন। তবে সেখানে তিনি মোদির জলবায়ু উদ্যোগের প্রশংসাই করেছিলেন।
তার গ্রেপ্তারের পর আন্দোলনকারীরা সরকারের সঙ্গে আলোচনাও স্থগিত করে দিয়েছে এবং নিহতদের ক্ষতিপূরণ ও সব বন্দির মুক্তির দাবি জানিয়েছে।

‘আগুন থেকে আগুনে’
২০১৯ সালে সংবিধান পরিবর্তনে খুশি হওয়া ওয়াংচুক পরে বলেন, “আমরা আগুন থেকে আগুনেই পড়েছি।”
তিনি বলেন, “লাদাখে এখন কোনো গণতান্ত্রিক প্ল্যাটফর্মই অবশিষ্ট নেই।”
গবেষক মানশি আশের বলেন, “কেন্দ্রীভূত সিদ্ধান্ত ও কর্পোরেট স্বার্থের কারণে পরিবেশ ও স্থানীয় জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে—সেখানেই টেকসই উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের দাবি এক হয়ে গেছে।”
‘রাজনীতির কবলে পড়তেই হবে’
কারগিল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্সের নেতা সাজাদ কারগিলি বলেন, “রাজনীতি থেকে পালানো যায় না। সোনম ওয়াংচুকের উদ্ভাবনী জীবনও শেষ পর্যন্ত রাজনীতির কবলে পড়েছে।”
তিনি সতর্ক করে বলেন, “লাদাখ সীমান্ত অঞ্চল, এখানে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করলে বড় বিপদ হবে।”

‘বিস্ফোরণের পথে লাদাখ’
ওয়াংচুকের স্ত্রী আংমো বলেন, তার স্বামীকে লক্ষ্য করে সরকারের “কুৎসিত শিকার” চলছে—তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর অনুদান বাতিল, তদন্ত সংস্থার হুমকি, দাতাদের ভয় দেখানো—সবই এই প্রচেষ্টার অংশ।
তিনি বলেন, “তারা লাদাখকেও কাশ্মীরে পরিণত করতে চাইছে।”
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ইতোমধ্যে মোদি সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে, ওয়াংচুকের গ্রেপ্তারের কারণ তার স্ত্রীকে জানাতে। আগামী ১৪ অক্টোবর মামলার শুনানি হবে।
আংমো বলেন, “আমি জানি না ওর অবস্থা কেমন, ওষুধ পাচ্ছে কিনা। আমাদের ভয় দেখানো হচ্ছে যেন আমরা সত্য না বলি। এ দেশে এখন আর গণতন্ত্র নয়।”