সমুদ্রের গ্রাসে এখন ভুতুড়ে পানামার ‘সুগডুব দ্বীপ’

এক বছর আগে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ পরিণতিতে সমুদ্রগর্ভে বিলীন হওয়ার আশঙ্কায় পানামার সুগডুব দ্বীপ থেকে প্রায় এক হাজার ২০০ বাসিন্দাকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। সেই দ্বীপটি আজ নীরব, জনমানবশূন্য এবং শিশুর কোলাহলহীন এক ভূতুড়ে স্থানে পরিণত হয়েছে। লাতিন আমেরিকায় জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট প্রথম দিকের ‘জলবায়ু উদ্বাস্তু’ তৈরির এই পরিকল্পিত স্থানান্তর আন্তর্জাতিক মহলে এক নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। খবর এএফপির।
‘দ্বীপটা যেন মৃত’
দ্বীপের ছোট্ট জাদুঘরের দেখভালের দায়িত্বে থাকা স্থানীয় অধিবাসী ডেলফিনো ডেভিস এএফপিকে তার অনুভূতি ব্যক্ত করে বলেন, ‘এখানে এখন আর কোনো বন্ধু নেই, নেই কোনো শিশুর খেলাধুলা—এই দ্বীপটা যেন মৃত।’ পাঁচটি ফুটবল মাঠের সমান আয়তনের এই দ্বীপটিতে এখন শুধুই তালাবদ্ধ ঘর আর পরিত্যক্ত ক্লাসরুম চোখে পড়ে।
৪৭ বছর বয়সী মাইকা তেজাদা এখনো দ্বীপে রয়ে গেছেন। তিনি ছোট একটি দোকান চালান, যেখানে তিনি কলা, কুমড়া, জামা-কাপড়, খেলনা ও খাতা-কলম বিক্রি করেন। তিনি বলেন, এখানে আর কেউ থাকে না। অনেক সময় একা একা থাকতে থাকতে মন খারাপ হয়ে যায়।
তেজাদাসহ শতাধিক মানুষ এখনো দ্বীপে অবস্থান করলেও তার মা ও দুই সন্তান মূল ভূখণ্ডে গড়ে ওঠা নতুন আবাসন ‘ইসবার ইয়ালা’য় (গুনা ভাষায় যার অর্থ ‘লকাটের দেশ’) চলে গেছেন। দ্বীপ থেকে নৌকায় মাত্র ১৫ মিনিটের দূরত্বে অবস্থিত এই নতুন পাড়াটিতে পানামা সরকার ৩০০টি বাড়ি নির্মাণ করে দিয়েছে।
গুনা ইয়ালা দ্বীপপুঞ্জের ভবিষ্যৎ উদ্বেগ
গারদি সুগডুব ছিল গুনা ইয়ালা দ্বীপপুঞ্জের ৪৯টি বসতিপূর্ণ দ্বীপের একটি। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, এই দ্বীপপুঞ্জ বর্তমান শতকের শেষ নাগাদ সম্পূর্ণরূপে সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে যেতে পারে।
৬২ বছর বয়সী লুসিয়ানা পেরেস তার ওষধি গাছের গন্ধে ভরা কাঁচা মেঝের বাড়িতে দোলনায় বসে দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, ‘আমি গারদি দ্বীপেই জন্মেছি, এখানেই মরব। কিছুই তলিয়ে যাচ্ছে না। বিজ্ঞানীরা কিছু জানে না— কেবল খোদাই সব জানেন।’ তিনি যোগ করেন, শৈশব থেকেই তিনি বড় বড় ঢেউ এবং জোয়ারে তাদের ঘর-বাড়ি প্লাবিত হতে দেখে আসছেন।

তবে বিজ্ঞানীরা ভিন্ন কথা বলছেন। পানামার স্মিথসোনিয়ান ট্রপিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী স্টিভেন পেটন উল্লেখ করেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৮০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে। অথচ গুনা ইয়ালা দ্বীপগুলোর গড় উচ্চতা মাত্র ৫০ সেন্টিমিটার, যা তাদের জন্য ভয়াবহ পরিণতির ইঙ্গিত দেয়।
জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলন কপ৩০-এর প্রধান নির্বাহী আনা টনি এই সমষ্টিগত স্থানান্তরকে ‘জলবায়ু সংকট বাস্তব, ও আমরা এখনই তার মুখোমুখি’—এর প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
সুগডুব দ্বীপে নতুন জীবনের ছোঁয়া : পাকা রাস্তা, টয়লেট-বিদ্যুৎ
গারদি সুগডুব দ্বীপে বর্তমানে বর্ষা আসায় কাঁচা রাস্তাগুলো কাদায় ভরে গেছে। অন্যদিকে, মূল ভূখণ্ডে গড়ে ওঠা ইসবার ইয়ালায় বাসিন্দারা আধুনিক সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন। সেখানে পাকা রাস্তা, পাকা ঘর, ফুটপাত ও প্রতিটি ৫০ বর্গমিটার আয়তনের কংক্রিটের বাড়ির সঙ্গে একটি করে জমির টুকরো রয়েছে।
৭৫ বছর বয়সী অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা মাগদালেনা মার্টিনেজ বলেন, আগে সবাই মিলে গাদাগাদি করে থাকতে হতো। নদী থেকে নৌকায় করে পানি আনতাম। এখন সকালে এক ঘণ্টা পানির সংযোগ পাই, তবে বিদ্যুৎ থাকে ২৪ ঘণ্টাই।
তেজাদার দুই সন্তানও দ্বীপ ছেড়ে নতুন জায়গায় যাওয়ায় খুশি। তেজাদা বলেন, আমি ওদের মিস করি। কিন্তু ওরা ওখানে খুশি। ফুটবল খেলার জায়গা পেয়েছে, হাঁটাহাঁটি করতে পারে।
দ্বীপের স্কুলটি সরিয়ে নেওয়া হলেও একটি জরাজীর্ণ চিকিৎসাকেন্দ্র এখনো সেখানে রয়েছে। ৪৬ বছর বয়সী চিকিৎসক জন স্মিথ জানান, আগে মানুষ পায়ে হেঁটে আসত। এখন আসতে হয় সড়ক আর নদী পাড়ি দিয়ে।

অনেক বাসিন্দা কেবল বাড়ির খোঁজখবর নিতে দ্বীপে আসেন, আবার কেউ কেউ দু'জায়গায় ভাগ করে সময় কাটান। ইসবার ইয়ালার প্রথম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে এই সপ্তাহে দ্বীপে কিছুটা সরবতা ফিরবে—উৎসবের জন্য সাত কলস চিচা (গাঁজন করা ভুট্টার পানীয়) প্রস্তুত করা হয়েছে।
তবে নতুন জীবন এবং আধুনিক সুযোগ-সুবিধার মধ্যেও অনেকে এই দ্বীপটির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একটি অনিবার্য আশঙ্কা করছেন। মার্টিনেজ বলেন, ‘হয়তো আমি দেখে যেতে পারব না, কিন্তু দ্বীপগুলো একদিন হারিয়ে যাবে। কারণ সমুদ্র নিজের জায়গা ফেরত নেবে।’