থাকেন ভারতে, কাজ করেন বাংলাদেশে

মানচিত্রে তাঁরা ভারতের বাসিন্দা। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনযাপনের পুরোটাই নির্ভর করতে হয় বাংলাদেশের ওপর। এভাবেই নিজ দেশে থেকেও কার্যত পরনির্ভরশীল হয়ে বছরের পর বছর পার হয়ে যাচ্ছে।
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী নো-ম্যানস ল্যান্ডের বাসিন্দা ওই লোকজন।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম হরিদাসপুর। সেখান থেকেই ইছামতী নদী পেরিয়ে যেতে হয় ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে অবস্থিত সেই নো-ম্যানস ল্যান্ডে।
নদীর বুকে ছোট্ট দুটি দ্বীপের নাম দোঘরা আর তেরোঘরা। ওই দ্বীপ দুটির তিন দিকে বাংলাদেশ আর একদিকে ভারত। দেশ ভাগের সময় সহায়সম্বলহীন কিছু মানুষ গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন সেখানে। কিন্তু তার পর থেকে তাদের জীবনের আঁধার কাটেনি।
পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁ শহর থেকে হরিদাসপুর সীমান্ত হয়ে নওডাঙ্গা নদী ও বালিখাল পেরিয়ে পৌঁছাতে হয় এই দ্বীপে। ইছামতীর ছোট্ট একটি শাখা নদী এই নওডাঙ্গা। খুব বেশি চওড়া নয়। নৌকায় করে পার হতে সময় লাগে মিনিট সাতেক।
এই নদী পেরিয়ে ‘নো-ম্যানস ল্যান্ডে’ পা রাখার আগে সুনির্দিষ্ট পরিচয়পত্র দেখিয়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের কাছ থেকে নিতে হয় ছাড়পত্র।
নওডাঙ্গা নদী পার হলেই নো-ম্যানস ল্যান্ডের বুকে প্রথমেই পড়ে দোঘরা। দেশভাগের সময় এখানে আশ্রয় নিয়েছিল মাত্র দুটি পরিবার, যা এখন বেড়ে হয়েছে পাঁচটির মতো।
দোঘরা থেকে কিছুটা পূর্বে এগোলেই পড়বে বালিখাল। এই খাল বেয়ে নৌকায় মিনিট পনেরো এগোলেই পড়বে তেরোঘরা। এই দ্বীপে পা রাখলেই চোখে পড়বে দুই পাড়ে প্রশাসনের কঠোর নিরাপত্তার ছবি। সারি দিয়ে একদিকে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিজিবি, অন্যদিকে রয়েছে বিএসএফ।
তেরোঘরা দ্বীপের ডান দিকে বাংলাদেশের দৌলতপুর ও বাঁ দিকে জ্ঞাতিপাড়া। এই তেরোঘরা দ্বীপে স্বাধীনতার সময় আশ্রয় নিয়েছিল ১৩টি পরিবার। এখন সেই পরিবারের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে সাতটির মতো। বাকি পরিবারগুলো রুটি-রুজির টানে অন্যত্র চলে গেছে।
বর্তমানে দোঘরা ও তেরোঘরা দ্বীপ মিলিয়ে সর্বসাকল্যে লোকসংখ্যা আনুমানিক ৭৫ থেকে ৮০ জন। উন্নয়নের ছাপ বলতে যা বোঝায়, তা সেই অর্থে এখানে নেই।
কার্যত মানচিত্রে থাকা ছাড়া ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপ দুটি। নেই বিদ্যুৎ, নেই উন্নত পাকা রাস্তা, নেই স্বাস্থ্যসম্মত পানি, নেই সেই অর্থে সরকারি সাহায্য। বঞ্চনা আর অবহেলাই এখানকার বাসিন্দাদের নিত্যসঙ্গী।
তেরোঘরা দ্বীপের এক বাসিন্দা বলেন, ‘দ্বীপের মধ্যে আবাদ করেই নিজেদের খাবার নিজেরাই জোগাড় করি। কোনো সরকারই তাকিয়ে দেখেনি আমাদের দিকে।’
দ্বীপের কয়েকজন বাসিন্দা জানান, নৌকায় করে ভারতে যেতে তাঁদের যে সময় লাগে, তার মধ্যে দশবার বাংলাদেশে যাওয়া যায়।
শুধু জন্ম-মৃত্যুর নিবন্ধন ছাড়া প্রায় সবকিছুতেই বাংলাদেশের ওপর নির্ভরশীল হতে হয় দুই দ্বীপের বাসিন্দাদের। বাজার-ঘাট থেকে জরুরি ওষুধ—সবই নিয়ে আসেন বাংলাদেশ থেকে। রাতবিরাতে সুবিধা-অসুবিধাতেই নির্ভর করতে হয় বাংলাদেশের ওপরই। আর এখানকার এই আজব জীবনধারণের সঙ্গী হওয়া মানুষগুলোকে চেনেন বিজিবি কিংবা বিএসএফের স্থানীয় জওয়ানরাও। তাই যাতায়াতে সেই অর্থে তাদের অসুবিধা হয় না বলেই জানিয়ে দিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা।