একটি মামলা ঘিরে ৪৬ ‘অপমৃত্যু’

ভারতের মধ্যপ্রদেশের মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার জন্য রাজ্য সরকারের ব্যবস্থাপক সংস্থা ‘ব্যবসায়িক পরীক্ষা মণ্ডল’ (ব্যাপম) কেলেঙ্কারির ঘটনায় রহস্য ক্রমে ঘনীভূত হচ্ছে। টাইমস অব ইন্ডিয়া ও এনডিটিভির সূত্রমতে, এ ঘটনায় মামলা দায়েরের পর ঘটনার সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে সংশ্লিষ্ট ৪৬ জনের ‘অপমৃত্যু’ হয়েছে। যদিও মধ্যপ্রদেশ পুলিশ এত জনের মৃত্যুর ঘটনাকে হয় ‘স্বাভাবিক’, নয়তো ‘আত্মহত্যার’ ঘটনা বলে চালিয়ে দিতে চেষ্টা করছে।
হিন্দুস্তান টাইমসের খবরে বলা হয়েছে, কয়েকশ কোটি রুপির ব্যাপম কেলেঙ্কারির সন্দেহের তালিকায় আছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্যপাল থেকে শুরু করে হাইপ্রোফাইল নেতা-আমলারা। আর এই দুর্নীতি প্রকাশ্য আসার পর থেকেই পরপর সাক্ষী ও অন্যদের রহস্যজনক মৃত্যু ঘটেই চলছে। সে রহস্যই এবার আরো দানা বাঁধল সাংবাদিক অক্ষয় সিং এবং মেডিকেল কলেজ ডিন অরুণ শর্মার মৃত্যুতে।
রহস্যময় যত মৃত্যু
গতকাল রোববার ভোরে রাজ্যের মেডিকেল কলেজগুলোতে ভর্তি পরীক্ষায় দুর্নীতির অন্যতম অভিযোগকারী জব্বলপুর মেডিকেল কলেজের ডিন ডা. অরুণ শর্মাকে দিল্লির একটি হোটেলে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। এর মাত্র একদিন আগেই গত শনিবার এই কেলেঙ্কারির অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করতে গিয়ে হঠাৎ মুখে গ্যাঁজলা উঠে মারা গেছেন সর্বভারতীয় টিভি চ্যানেল ও পত্রিকা ‘আজতক’-এর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক অক্ষয় সিং।
ব্যাপম দুর্নীতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরির জন্য তদন্ত করতে গত শনিবার অক্ষয় গিয়েছিলেন মধ্যপ্রদেশের ঝাবুয়া গ্রামের মেঘনগর এলাকায়। ২০১২ সালে এই গ্রামেরই এক পরীক্ষার্থী নম্রতা দামোর বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়েছিলেন। ২০১০ সালে ডাক্তারি পরীক্ষায় কারচুপি করে পাস করার অভিযোগ উঠেছিল তাঁর বিরুদ্ধে। পরে বাড়ি থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে উজ্জয়নীর কাটিয়া গ্রামে রেললাইনের পাশে নম্রতার মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল। ঝাবুয়ায় নম্রতার পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু কাগজ কপি করানোর সময় হঠাৎ নাকে-মুখে গ্যাঁজলা উঠে অচেতন হয়ে যান অক্ষয়। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।
জব্বলপুর মেডিকেল কলেজের ডিন ডা. অরুণ শর্মার মৃত্যু আরো রহস্যজনক। দুর্নীতির তদন্তে গঠিত বিশেষ টাস্কফোর্সকে সাহায্য করছিলেন তিনি। গতকাল দিল্লির একটি হোটেলে ডা. অরুণের মৃতদেহ পাওয়ার পর পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, বিকেলে অরুণ হুট করেই দিল্লি চলে যান। পরদিন সকালে পুলিশ তাঁদের জানায়, মারা গেছেন অরুণ।
দিল্লি পুলিশ জানিয়েছে, তাঁর বিছানার কাছে হুইস্কির বোতল ও ওষুধপত্র পাওয়া গেছে। পুলিশের অনুমান, প্রচুর পরিমাণে মদপান করেছিলেন তিনি। ঘরে বমির চিহ্নও পাওয়া গেছে। ময়নাতদন্তের পরই বোঝা যাবে, কীভাবে তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
চলতি বছরেই ওই দুর্নীতির মামলার সঙ্গে জড়িত নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু মেডিকেল কলেজের অপর এক ডিনের রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছিল। গত ৪ জুন ডিন ড. ডি কে সাক্কালের দগ্ধ দেহ উদ্ধার করা হয়েছিল। ব্যাপম কেলেঙ্কারিতে মেডিকেল কলেজে ভুয়া ভর্তির বিষয়টি খতিয়ে দেখার ভার ডা. অরুণ শর্মার আগে তাঁর কাছেই ছিল।
অভিযুক্ত ও সাক্ষী মিলিয়ে গত দুই বছরে এই দুর্নীতি মামলার সঙ্গে যুক্ত ২৫ জনের মৃত্যুর কথা স্বীকার করেছে পুলিশ প্রশাসনই। যদিও সংবাদমাধ্যমের দাবি, অস্বাভাবিকভাবে মারা গেছেন মোট ৪৬ জন।
ব্যাপম কেলেঙ্কারির ইতিকথা
টাইমস অব ইন্ডিয়া সূত্রে জানা যায়, মূলত চাকরি ও অন্যান্য পরীক্ষা নেওয়ার জন্য মধ্যপ্রদেশে ব্যবসায়িক পরীক্ষা মণ্ডল (ব্যাপম) তৈরি করা হয়েছিল। ২০০৫ সাল থেকে মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ভর্তি পরীক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয় ব্যাপমকে। ২০০৭ সালে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে টাকার বিনিময়ে বেআইনিভাবে বহু প্রার্থীকে পরীক্ষায় পাস করিয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। একই বছর এ নিয়ে রাজ্যের বিভিন্ন থানায় অভিযোগ দায়ের শুরু হয়।
অভিযোগ আছে, কেবল ইঞ্জিনিয়ারিং ও মেডিকেল নয়, সরকারি ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চাকরির পরীক্ষায়ও প্রভাব বিস্তার করেছে এই চক্র। বহু প্রভাবশালী নেতা ও আমলা এই কেলেঙ্কারিতে যুক্ত বলেও অভিযোগ। এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১২ সালে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা চলার সময়ে ১৭৪ ভুয়া পরীক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। অন্যের হয়ে পরীক্ষা দিচ্ছিল তারা।
এ ঘটনার তদন্তে নেমেই কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসে। দেখা যায়, এই ভুয়া পরীক্ষা চক্রের সঙ্গে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক সংস্থা ব্যাপমের পরিচালক থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদরাও জড়িত। ২০১২-১৩ সালের এ ঘটনা ভারতজুড়ে আলোড়ন তুলেছিল।
২০০৭ সাল থেকে শুরু হলেও ব্যাপম কেলেঙ্কারির প্রকৃত ছবি সামনে এসেছিল ২০১৩ সালে, ইন্দোরের চিকিৎসক আনন্দ রাই ও গোয়ালিয়রের সমাজকর্মী আশিস চতুর্বেদীর চেষ্টায়। সংবাদমাধ্যমে এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর ক্রমে গ্রেপ্তার হন রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী লক্ষ্মীকান্ত শর্মাসহ বেশ কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি। কেলেঙ্কারিতে নাম জড়িয়ে পড়ে রাজ্যপাল রামনরেশ যাদব ও তাঁর ছেলে শৈলেশেরও। এর ফলে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন রাজ্যপাল রামনরেশ।
এর পর ২০১৩ সালের শেষ ভাগে এই দুর্নীতি মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয় পুলিশ। আর এরপরই শুরু হয় একের পর এক হত্যার ঘটনা। প্রথমে মারা যেতে থাকেন ঘটনার অভিযুক্তরা। ২০১৪ সালে এ ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত রাজ্যপাল রামনরেশ যাদবের ছেলে শৈলেশ যাদবকেও মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল।
কংগ্রেসের দাবি সিবিআই তদন্ত
ব্যাপম দুর্নীতি নিয়ে দেশব্যাপী আলোড়নের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালতের নির্দেশে বিশেষ তদন্তকারী দলের নজরদারিতে বিশেষ টাস্কফোর্স (এসটিএফ) দুর্নীতির তদন্তে নামে। তবে কংগ্রেসের দাবি, এসটিএফ কিছুই তদন্ত করতে পারেনি। তাই অবিলম্বে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হোক। সিবিআই তদন্তের দাবি তুলেছে আম আদমি পার্টিও।
কিন্তু এই দাবি মানতে নারাজ বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ চৌহান। গতকাল রোববার শিবরাজ জানিয়েছেন, হাইকোর্টের গড়া বিশেষ তদন্ত দল এই তদন্ত করছে। তাঁর প্রতিশ্রুতি, তদন্ত যাতে নিরপেক্ষ হয়, তা দেখবে সরকার। এই প্রতিশ্রুতি কতটা কাজ দেবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
গতকাল দিল্লিতে আজতক টিভির জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক অক্ষয়ের শেষকৃত্যে উপস্থিত ছিলেন কংগ্রেসের ভাইস প্রেসিডেন্ট রাহুল গান্ধী, দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল, উপমুখ্যমন্ত্রী মনীষ সিসোদিয়া, দিল্লি প্রদেশ কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট অজয় মাকেনসহ বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি।
সেখানে কংগ্রেস নেতা দিগ্বিজয় সিং বলেছেন, ‘কীভাবে সাংবাদিক অক্ষয় সিংয়ের মতো সুস্থ ব্যক্তি হঠাৎ করে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়লেন? তাঁর হৃদযন্ত্রজনিত কোনো সমস্যা ছিল না।’ শোক প্রকাশ করে তদন্ত দাবি করেছেন কংগ্রেসের সিনিয়র এই নেতা।
আম আদমি পার্টির নেতা সঞ্জয় সিং মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহানকে শিবরাজের বদলে যমরাজ বলে কটাক্ষ করেছেন। তিনি বলেন, ‘ব্যাপম কেলেঙ্কারিতে মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে গভর্নর পর্যন্ত সবাই সন্দেহের তালিকায় রয়েছেন।’
মধ্যপ্রদেশের বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান এ ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে বিশেষ তদন্ত কমিটি গঠন করার আশ্বাস দিয়েছেন। বিজেপির সিনিয়র নেতা ও ভারতের অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি সাংবাদিক অক্ষয় সিংয়ের অকালমৃত্যুতে রোববার সকালে টুইট করে শোক প্রকাশ করেছেন।