মাইক্রোসফট আনল লুমিয়া৫৪০

স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদের মধ্যে জনপ্রিয়তার দিক থেকে আইওস আর অ্যানড্রয়েডের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় খানিকটা পিছিয়েই রয়েছে উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম। এই দূরত্ব কমিয়ে আনতে উইন্ডোজের প্রায় প্রতিটি প্রচেষ্টাই মুখ থুবড়ে পড়েছে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে।
গত বছর লুমিয়া৫৩৫ বের হওয়ার পর অনেকেই ভেবেছিল, মাইক্রোসফট বুঝি এবার একটি সমাধান খুঁজে পেল। কিন্তু প্রথম দিকের সেটগুলোর টাচস্ক্রিন এবং হার্ডওয়্যারে কিছু ঝামেলা ধরা পড়ায় আশানুরূপ সাড়া মেলেনি তাতে।
যদিও পরের দিকে এসে সমস্যাগুলো কিছুটা দূর করতে সফল হয়েছিল তারা। তবু মাইক্রোসফট তাদের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারেনি লুমিয়া৫৩৫ দিয়ে। তাই ৫৩৫-এর দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে এবার তারা বাজারে এনেছে লুমিয়া৫৪০।
উইন্ডোজ ফোন বিশেষজ্ঞরা এরই মধ্যে এই সেটের ফিচার দেখে সন্তুষ্ট। যদিও সেটটির পারফরম্যান্স সম্পর্কে এখনো স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়নি। তাই অন্য কিছুর সঙ্গে তেমন তুলনা না দিয়ে দেখে আসা যাক উইন্ডোজ ফোন হিসেবে নতুন আসা এই সেটটির সফল হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু।
ডিজাইন
লুমিয়া ফোনের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ডিজাইনে তাদের এক ধরনের আলাদা স্টাইল। অনেকে বৈচিত্র্য নেই বলে ভ্রূ কুঁচকালেও বেশির ভাগ লুমিয়া ব্যবহারকারীর কাছে স্টাইলটি বেশ জনপ্রিয়। আবার এই ডিজাইনের মাঝেই নিজস্বতা ঠিক রেখে নতুন নতুন কারুকাজ সংযোজন করছে মাইক্রোসফট। বরাবরের মতো এবারও এর কাভার তৈরিতে মূল উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে পলিকার্বনেট। ওপরে চকচকে ম্যাট ফিনিশিং সেটটিকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। আর পছন্দ অনুযায়ী বিভিন্ন ফ্রুটি কালার তো আছেই।
এ ছাড়া সেটটির ব্যাক কাভারে এবার একটি স্বচ্ছ স্তর দেওয়া হয়েছে, যেটি এর ডিজাইনে যোগ করেছে নতুনত্ব। স্তরটি থাকায় মাঝেমধ্যে সেটের ডিজাইনে একটি থ্রিডি অনুভূতি পাওয়া যায়, যা সেটটির প্রতি ব্যবহারকারীদের আকর্ষণ বাড়িয়ে দেবে বলে আশা করা হচ্ছে।
তুলনামূলকভাবে কিছুটা পুরু (৯ দশমকি ৪ মিমি) হলেও সেটটি মুঠোর মধ্যে বেশ ভালোভাবে এঁটে যায়। সেটটির ওজন ১৫২ গ্রাম। কিন্তু সেটটি বহন করা এবং হাতে রেখে ব্যবহার করা খুবই আরামদায়ক। তবে খুব বেশি পরিমাণে খুঁতখুঁতে হলে সেটের চারপাশে প্লাস্টিকের প্রান্তগুলো আপনার স্বস্তির পরিমাণ কিছুটা কমাতে পারে। অবশ্য এটি লুমিয়াতে সব সময়ই ছিল।
ডিসপ্লে
লুমিয়া৫৩৫-এর অন্যতম বড় একটি সমস্যা ছিল এর কিউএইচডি ডিসপ্লে। তাই মাইক্রোসফট সেই সমস্যা দূর করতে ভোলেনি এবার। ৫ ইঞ্চি বড় স্ক্রিনে এবার রয়েছে ৭২০ পিক্সেলের আইপিএস ডিসপ্লে।
আইপিএস ডিসপ্লের কারণে যেকোনো দিক থেকেই জীবন্ত ছবি দেখা যাবে স্ক্রিনে। এমনকি পাশে গিয়ে কোনাকুনিভাবে তাকালেও অন্যান্য সেটের মতো এখানে খুব একটা রং পরিবর্তন হতে দেখা যায় না। ছবির উজ্জ্বলতাও আপনাকে মুগ্ধ করবে। সূর্যের আলোর নিচে গেলেও খুব একটা সমস্যায় পড়তে হবে না উজ্জ্বলতা আর রং নিয়ে।
গেম খেলা, বই পড়া কিংবা ভিডিও দেখা—প্রায় সব কাজই খুব স্বস্তির সঙ্গে করার জন্য ডিসপ্লেটি তৈরি হয়েছে। তাই অন্তত এদিক থেকে চোখ বুজে বিশ্বাস রাখতে পারেন লুমিয়া৫৪০-এর ওপর।
ক্যামেরা
যদি লক্ষ করে থাকেন, তাহলে সব সময়ই দেখবেন, মাইক্রোসফট তাদের সেটগুলোর ক্যামেরা নিয়ে বেশ প্রচার চালিয়ে থাকে। এর পেছনে অবশ্য শক্ত যুক্তিও আছে তাদের। লুমিয়ার অপারেটিং সিস্টেম নিয়ে অনেকের অনেক আপত্তি থাকতে পারে। কিন্তু তাদের ক্যামেরার পারফরম্যান্স সব সময়ই প্রশ্নাতীত। লুমিয়া৫৩৫ সেটে সামনে ও পেছনে ৫ মেগাপিক্সেল ক্যামেরা যোগ করে সেলফি আর ছবিপ্রেমীদের হৃদয় জয় করতে পেরেছিল। এবার আরো একধাপ এগিয়ে রয়েছে লুমিয়া৫৪০। ফ্রন্ট ক্যামেরা ৫ মেগাপিক্সেল থাকলেও রিয়ার ক্যামেরা এবার ৮ মেগাপিক্সেলের।
রিয়ার ক্যামেরায় ন্যাচারাল আলোতে ছবির কন্ট্রাস্ট, খুঁটিনাটি বিভিন্ন দিক আর রং একদম নির্ভুলভাবে ধরা পড়ে। তাই ছবি হয়ে ওঠে অনেক বেশি প্রাণবন্ত। আর লুমিয়া ক্যামেরা অ্যাপ এই সেটের ফটোগ্রাফিতে যোগ দিয়েছে নতুন এক মাত্রা। ম্যানুয়েল সেটিংসে গিয়ে এবার নিজের ইচ্ছামতো ছবিগুলো তৈরি করা যাবে। ফোকাস করার ব্যবস্থা থাকায় চাইলে পেছনে ঝাপসা ব্যাকগ্রাউন্ড রেখেও ছবি তুলতে পারবেন। ছবি দেখে হয়তো অনেকে প্রাইম লেন্সের কাজ ভেবে ভুল করতে পারে!
আলোর বাইরে এসেও ক্যামেরার পারফরম্যান্স ভালো। এমনকি সাবজেক্টগুলোকে আরো বেশি উজ্জ্বল লাগবে আলো থেকে। তাই এই টাকায় এর চেয়ে ভালো ক্যামেরা পারফরম্যান্স আর কোথাও পাওয়ার সম্ভাবনা কম।
৫ মেগাপিক্সেলের ফ্রন্ট ক্যামেরাও যেন কম যায় না। কোনো ফ্ল্যাশ না থাকলেও এর ঔজ্জ্বল্য আর প্রাণবন্ততা যেকোনো সেলফি-পাগলার মন কাড়বে। সঙ্গে ওয়াইড অ্যাঙ্গেল লেন্স থাকায় এবার সামনের অনেক সাবজেক্টকে ধারণ করা যাবে ফ্রন্ট ক্যামেরায়। তাই চাইলেই এবার যত ইচ্ছা তত বন্ধুদের জায়গা দিতে পারবেন সেলফিতে।
সফটওয়্যার
লুমিয়া৫৪০-এর অপারেটিং সিস্টেমে রয়েছে লুমিয়া৫৩৫-এর মতোই উইন্ডোজ ৮ দশমিক ১। তবে বছর শেষে এটি উইন্ডোজ টেনে আপডেট করা যাবে। মাইক্রোসফট আগে থেকেই বেশ কিছু সফটওয়্যার এবং অ্যাপ লোড করে রেখেছে সেটে। তবে খুশির খবর হচ্ছে, আপনি চাইলে ৮ গিগাবাইট জায়গা থেকে সেগুলো নিজেই মুছে দিতে পারবেন স্টোরেজ থেকে, যা কি না অ্যানড্রয়েডের ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। নতুন অ্যাপগুলোও মাইক্রো এসডি কার্ডে (১২৮ গিগাবাইট পর্যন্ত) ইনস্টল করতে পারবেন। এ ছাড়া মাইক্রোসফট অফিস, স্কাইপে কিংবা ওয়ানড্রাইভ ব্যবহার করাও বেশ আরামদায়ক।
পারফরম্যান্স
সেটের পারফরম্যান্স যে খুব আহামরি, তা বলা যায় না। তবে দামের তুলনায় সেটি যথেষ্ট ভালো বলতেই হবে। এই দামের মধ্যে অন্য বেশির ভাগ অ্যানড্রয়েড সেটের চেয়ে মাইক্রোসফট লুমিয়া৫৪০ ভালো পারফরম্যান্স দেবে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যবহার করলেও সেটটি একদমই সমস্যা করবে না। এতে রয়েছে ১ দশমিক ২ গিগাহার্টজের স্ন্যাপড্রাগন ২০০ কোয়াড-কোর প্রসেসর। র্যাম রয়েছে ১ গিগাবাইটের।
তবে ঝামেলা যে একেবারে নেই, তা নয়। গেম কিংবা বিভিন্ন অ্যাপ লোড হতে মাঝেমধ্যে কিছুটা সময় লেগে যায় বেশি। এক অ্যাপ থেকে আরেকটিতে সুইচ করতেও একই ধরনের সমস্যা পোহাতে হতে পারে।
গেমিং পারফরম্যান্স নিয়ে বেশি কিছু বলার নেই। অ্যাংরি বার্ড কিংবা সাবওয়ে সার্ফারের মতো সাধারণ গেমগুলো অনায়াসে খেলতে পারবেন। কিন্তু অ্যাসফল্ট এইটের মতো হাই-গ্রাফিকসের কোনো গেমস খেলতে গেলে বিপত্তিতে পড়বেন।
তবে সেটের নেটওয়ার্ক পারফরম্যান্স বেশ ভালো বলা যায়। ফোনে কথা একদম স্পষ্ট শোনা যায়। ভালো নেটওয়ার্কে থাকলে কলড্রপ হয় না বললেই চলে। ডুয়েল সিমের সেটটিতে মাইক্রো সিমকার্ড ব্যবহার করা যাবে।
ব্যাটারি লাইফ
লুমিয়া হ্যান্ডসেটের আরেকটি শক্তিশালী জায়গা। এবারের ব্যাটারির শক্তি লুমিয়া৫৩৫-এর চেয়েও বেশি। ২২০০ এমএএইচের ব্যাটারি একবার চার্জ দিলে পুরো একদিন ব্যবহার করা যাবে। মানে ১৬-১৭ ঘণ্টা প্রায়। তাই সকাল ৮টা থেকে দিন শুরু করে আপনি মোটামুটিভাবে ব্যবহার করতে থাকলে সারা দিনে আর চার্জার খুঁজতে হবে না আপনাকে।
কেন কিনবেন?
প্রথমেই ভেবে দেখুন, উইন্ডোজ সেট আপনি কিনবেন নাকি। যদি আপনার অনেক বেশি অ্যাপ ডাউনলোড করার ইচ্ছা না থাকে কিংবা গুগলের সার্ভিসগুলো উপভোগ না করলেও চলবে, তাহলেই শুধু উইন্ডোজ হ্যান্ডসেট কিনুন। কারণ, এই সেটের মূল দুর্বলতা আসলে উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম নিজেই। অ্যানড্রয়েড কিংবা আইওসের থেকে অ্যাপের প্রাচুর্যে অনেক পিছিয়ে আছে উইন্ডোজ সেটগুলো।
তবে ভালো ব্যাপার হচ্ছে প্রয়োজনীয় প্রায় সব অ্যাপই এখন উইন্ডোজে ব্যবহার করা যায়। আর উইন্ডোজ যদি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েই থাকেন, তাহলে লুমিয়া৫৪০ কেনা হবে সঠিক সিদ্ধান্ত। চমৎকার ক্যামেরা, দীর্ঘজীবী ব্যাটারি আর অসাধারণ ডিসপ্লেসমৃদ্ধ সেটটি যে কারো হাতেও দেখতে বেশ লাগে। তাই মাত্র ১৩ হাজার ৯৯৯ টাকা পকেটে গুঁজে আজই চলে যান মাইক্রোসফটের এই আকর্ষণীয় সেটটি ক্রয় করতে।