মালয়েশিয়া থেকে ফেরা হলো না মোয়াজ্জেমের

গুরুতর অসুস্থ মোয়াজ্জেম হোসেন (৩৬) প্রিয় স্বজনদের কাছে ফিরে যাওয়ার ক্ষণ গুনছিলেন। ওই সময় ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তাঁর উদগ্রীব স্ত্রী হোসনে আরা বেগম। ঠিক তখনই জানা গেল মোয়াজ্জেম আর নেই। মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর বিমানবন্দর থেকে বিমানে ওঠার কয়েক ঘণ্টা আগেই ইন্তেকাল করেন তিনি (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
মাত্র তিন মাসের প্রবাস জীবনের সমাপ্তি ঘটল মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরের মোয়াজ্জেমের। ভাগ্য ফেরাতে এসে লাশ হয়ে ফিরতে হচ্ছে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটিকে।
বুধবার রাতে বাংলাদেশ বিমানের রাতের ফ্লাইটে দেশের রওনা দেওয়ার কথা ছিল মোয়াজ্জেমের। সব ঠিক থাকলে সকালেই দেশে পৌঁছাতেন তিনি। স্ত্রী হোসনে আরা সকালের প্রতীক্ষায় হয়তো নির্ঘুম রাত কাটানোর কথা ভাবছিলেন। দুই সন্তান জিহাদ(১১) ও ইশান(৬) তখনো কিছু বুঝে উঠতে পারেনি। বাবা মৃত চান মিয়া ও মা স্বরুফা বেগমের একমাত্র যক্ষের ধন ছিলেন মোয়াজ্জেম। সন্তানের ফিরে আসার প্রতীক্ষায় অধীর আগ্রহে ছিলেন মা। এমন সময় কুয়ালালামপুর থেকে জানানো হলো আজ বিমানে উঠছেন না মোয়াজ্জেম। কফিনবন্দি হয়ে তাঁকে ফিরতে হবে। পরিবারের স্বজনদের কান্নার শব্দে মধ্যরাতের শুনশান নীরবতা ভেঙে মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরের লস্করপুর গ্রামে নেমে আসে শোকের ছায়া।
পরিবারে বৃদ্ধ মা আর স্ত্রী। আছে দু্ই ছেলে যার একজন প্রতিবন্ধী। পুরো পরিবার যার কাঁধে সেই মোয়াজ্জেম হোসেন চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
মোয়াজ্জেমের মৃত্যুতে স্বজনদের মতো ভেঙে পড়েন কুয়ালালামপুরের ব্যবসায়ী ফিরোজ খান। যিনি মৃত্যু পথযাত্রী মোয়াজ্জেমকে দেখেছেন কাছ থেকে। স্বজনদের কাছে ফেরার আকুতি জানানো মোয়াজ্জেমকে দেশে পাঠাতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন তিনি।
কুয়ালালামপুরে ‘আমরা প্রবাসী যুবসংঘে’র সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ খান এই প্রতিবেদককে বলেন, গত ১৯ মার্চ গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা অনুভব করায় কুয়ালালামপুর সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন মোয়াজ্জেম। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই হাসপাতালেই ছিলেন তিনি। অবস্থা খারাপ হওয়ায় সাতদিন আইসিইউতেও রাখা হয় তাঁকে। এতেও কোনো লাভ হয়নি। ধীরে ধীরে আরো খারাপ পরিণতির দিকে গেলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে। দরিদ্র পরিবার দেশ থেকে টাকা পাঠিয়ে হাসপাতালের বিল পরিশোধ করে। মোয়াজ্জেমকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব ছিল না।
অসহায় মোয়াজ্জেম মৃত্যু প্রতীক্ষায় কুয়ালালামপুর হাসপাতালে দিন গুনছিলেন। বিষয়টি বাংলাদেশ হাইকমিশনেও জানায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তবে সহায় সম্বলহীন মোয়াজ্জেমের পাশে কেউ দাঁড়ায়নি। সম্প্রতি জোহর বারুতে কর্মরত মোয়াজ্জেমের প্রতিবেশী জামাল আলীর মাধ্যমে এ বিষয়ে জানতে পেরে হাসপাতালে যান ফিরোজ খান। ব্যক্তি উদ্যোগে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ হাইকমিশন ও বাংলাদেশ বিমানের সঙ্গে কথা বলে সবার সহযোগিতায় মোয়াজ্জেমকে দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন তিনি। বাংলাদেশ হাইকমিশন কর্মকর্তা শাহিদা সুলতানা, বিমানের কান্ট্রি ম্যানেজার সালাহউদ্দিন আহমেদ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাঁকে সহযোগিতা করেছে। তবে নিয়তির কী নির্মম পরিহাস! অ্যাম্বুলেন্স থেকে বিমানবন্দরে নেওয়া হয় মোয়াজ্জেমকে। বিমানে ওঠার আগমুহূর্তে ইন্তেকাল করেন তিনি। মোয়াজ্জেম সম্পর্কে কথাগুলো বলতে গিয়ে নিজের অজান্তেই চোখের কোণে পানি চলে আসে ফিরোজ খানের।
ফিরোজ খান বলেন, ‘আমাদের কষ্টটা স্বার্থক হতো যদি জীবিত অবস্থায় মোয়াজ্জেমকে তাঁর স্বজনদের কাছে ফিরিয়ে দিতে পারতাম। বিমানবন্দরে যাওয়ার পর তাঁর এমন মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না।’
বিমানবন্দরে মৃত্যুর আগে প্রতিবেশী জামাল আলীর সঙ্গে শেষ কথায় মোয়াজ্জেম বলেন, ‘আমি মনে হয় বাঁচব না। তুমি আমার সন্তানদের বলো শত কষ্টেও তারা যেন ভিক্ষা না করে।’
ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য তিন মাস আগে সহায় সম্বল বিক্রি করে মালয়েশিয়া যান মোয়াজ্জেম হোসেন। সেপাং অঞ্চলের নিলাই এলাকায় একটি কনস্ট্রাকশনে কাজ পেয়ে যান। পেটে ব্যথা অনুভব করায় গত মার্চে ভর্তি হন হাসপাতালে।
এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত মোয়াজ্জেম হোসেনের মরদেহ সেরডাংয়ের একটি হাসপাতালে রাখা হয়েছে। আমরা প্রবাসী যুবসংঘের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সব প্রক্রিয়া শেষে শিগগিরই তাঁর মরদেহ দেশে পাঠানো হবে।