প্রতিক্রিয়া
জেলা পরিষদ কি স্থানীয় সরকারের সৎসন্তান?

আইন প্রণয়নের ১৬ বছর পর স্থানীয় সরকারের জেলা পরিষদে নির্বাচন করতে যাচ্ছে সরকার। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, আগামী ২৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এই নির্বাচন। নির্বাচন হচ্ছে, এটা ভালো খবর হলেও অনেকগুলো অসংগতি নিয়েই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এই নির্বাচন, যা স্থানীয় সরকারের অন্যান্য স্তরে যে নির্বাচনগুলো অনুষ্ঠিত হয়েছে, তার সঙ্গে পরিষ্কার অমিল দেখাচ্ছে এবং উদ্রেক করেছে কতগুলো প্রশ্নের।
এক.
সম্প্রতি স্থানীয় সরকারের পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচন সম্পন্ন করেছে নির্বাচন কমিশন। পুরোনো ধারা ভেঙে এবারই প্রথম রাজনৈতিকভাবে দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন মেয়র ও চেয়ারম্যান প্রার্থীরা। স্বাধীনতা-পরবর্তীকাল থেকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন নির্দলীয় হলেও এবারই প্রথা ভেঙেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটি অবশ্য ‘নৌকার’ ইজ্জত রক্ষায় সর্বোচ্চ সক্রিয় থাকছে। আন্তঃকোন্দলে প্রাণ হারিয়েছে স্থানীয় পর্যায়ের বহু নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ। তাহলে এসবই কি দলীয়ভাবে নির্বাচন থেকে সরে আসতে বাধ্য করেছে সরকারকে? নাকি অন্য কিছু! শোনা যাচ্ছে, সংসদ সদস্যরা চান না জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান দলীয়ভাবে হোক। কারণ, এক জেলায় একই প্রতীকে একাধিক এমপি থাকলেও চেয়ারম্যান থাকবেন একজন, যা দলীয় স্বার্থের দ্বন্দ্ব তৈরি করতে পারে। তবে জেলা পরিষদ নির্বাচন দলীয় বিবেচনায় না করার বিষয়ে এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।
দুই.
জেলা পরিষদ নির্বাচনে সাধারণ নাগরিকরা পাচ্ছেন না ভোটাধিকার। স্থানীয় সরকার (জেলা পরিষদ) আইন, ২০০০ অনুযায়ী, ইলেক্টোরাল পদ্ধতির মাধ্যমে অনুষ্ঠিতব্য এই নির্বাচনে স্থানীয় সরকারের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর জনপ্রতিনিধিরা ভোটার হবেন। কিন্তু প্রার্থীদের কোনো ভোটাধিকার থাকবে না। ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, উপজেলা পরিষদ ও সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত মেয়র, চেয়ারম্যান, সদস্য ও সংরক্ষিত আসনের নারী সদস্যরাই নির্বাচিত করবেন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের। এ পদ্ধতি কেন! তারও কোনো ব্যাখ্যা নেই সরকারে দিক থেকে। এ পদ্ধতি কতটা জনসম্পৃক্ত, তা নিয়ে ইতোমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। অতীতের নির্বাচনগুলো সংঘাত সহিংসতার ঘটনা দমনে ব্যর্থ হয়েই কি এই পদ্ধতিতে যাচ্ছে সরকার?
তিন.
ইলেক্টোরাল পদ্ধতি শুধু যে নাগরিকদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করবে, তা নয়। এই পদ্ধতির ফলে একটি হ-য-ব-র-ল পরিবেশ তৈরি হবে স্থানীয় সরকারব্যবস্থায়। এর মূল কারণ, ইতোমধ্যে স্থানীয় সরকারের ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভায় যাঁরা নির্বাচিত হয়ে মেয়র ও চেয়ারম্যানের আসনে বসেছেন, তাঁদের প্রায় প্রত্যেকেই রাজনৈতিক দল কর্তৃক মনোনীত হয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। আবার নির্দলীয়ভাবে নির্বাচিত হয়ে পদে আছেন উপজেলা চেয়ারম্যান ও মেয়ররা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই দলীয় এবং নির্দলীয় জনপ্রতিনিধিরাই যদি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নির্বাচিত করেন, তা কতটা গ্রহণযোগ্য হবে?
এই অসংগতিগুলো দূর না করে নির্বাচন হলে ভবিষ্যতে এগুলো দূর করা যেকোনো সরকারের জন্যই ক্ষতির কারণ হবে। একইভাবে কেন এসব অসংগতি রেখে দেওয়ার পেছনে কী কারণ, তা জানাও নাগরিক অধিকার। তাই সরকারের উচিত, নির্বাচনের ঘোষিত তারিখ বাতিল করে আইনটির প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে নাগরিকদের সরাসরি ভোট দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে একটি কার্যকর ও গতিশীল স্থানীয় সরকার পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করা।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী