আওয়ামী লীগের সম্মেলন
প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসাব মিলবে তো?

১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ৬৭ বছর বয়সী ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে ২২ ও ২৩ অক্টোবর। সম্মেলনে সারা দেশের প্রায় সাত হাজার ডেলিগেট ও কাউন্সিলর ছাড়াও উদ্বোধনী অধিবেশনে জামায়াত ছাড়া দেশের সব রাজনৈতিক দল এবং ভারত, চীন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক নেতাদেরও আমন্ত্রণ জানিয়েছে আওয়ামী লীগ। নেতাদের কথায়, প্রচারণায় ও রমরমা প্রস্তুতির সাজসজ্জা দেখে মনে হচ্ছে, যেন নয়া জমানার দাওয়াত এসেছে, তাই চারপাশে বাজছে দামামা।
এরই মধ্যে দলের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলে দিয়েছেন, ‘আওয়ামী লীগের সম্মেলন সব সময় বিশাল হয়। এটা সারা জাতিকে নাড়া দেয়। এবার আমরা আরো উৎসবমুখর পরিবেশে এই সম্মেলন করার প্রস্তুতি নিচ্ছি।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘সম্মেলনে শক্তিশালী ও দক্ষ নেতৃত্ব নির্বাচিত হবে।’
সৈয়দ আশরাফের সঙ্গে আমরা একমত যে, আওয়ামী লীগের সম্মেলন সত্যি আমাদের নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। আমরা গা ঝাড়া দিয়ে উঠছি। কিন্তু দলের কাজ যোগ্য নেতৃত্ব সৃষ্টি করা এবং নীতি ও আদর্শ প্রতিষ্ঠা করা। তা কি হচ্ছে? কেন্দ্র থেকে বলা হয়েছিল, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় ছাড়া আর কারো নামে স্লোগান দেওয়া যাবে না, ব্যানার-ফেস্টুন তৈরি করা যাবে না। কিন্তু সারা দেশের অলিগলিতে চোখ রাখলেই দেখা যাবে সেই নির্দেশনায় পাত্তা দেওয়ার কথা কারোরই মনে নেই। এই ব্যাপার দলের চেইন অব কমান্ডের নজরে নেওয়া উচিত।
৩৫ বছর ধরে দলটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সম্মেলনের আগে বিভিন্ন আলোচনায় তিনি বলেছেন, আর কত? এবার তাঁকে বাদ দিয়ে নেতা নির্বাচন করলেই তিনি খুশি হবেন। এবারের সম্মেলনে কি তবে সজীব ওয়াজেদ জয়কে নীতিনির্ধারণী কোনো পদে নির্বাচিত হতে দেখা যাবে?
সম্মেলনের পূর্ববর্তী সময়ে আরেকটি বিষয় গণমাধ্যমে এসেছে। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদের সুযোগ্য পুত্র এবং সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রে স্বেচ্ছানির্বাসনে থাকা তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ বাংলাদেশের জনগণের জন্য কাজ করতে চান এবং এ ব্যাপারে অনুসারীদের পরামর্শ চেয়েছেন তিনি। এ নিয়ে নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে একটি পোস্ট দিয়েছেন সোহেল তাজ। সেই পোস্টে সোহেল তাজের ভক্ত-অনুরাগীরা আবারও রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়ে তাঁকে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন। এ অবস্থায় ক্লিন ইমেজের অধিকারী একজন সজ্জন সোহেল তাজ কি আওয়ামী লীগের এই সম্মেলনের মাধ্যমে জনগণের কাঙ্ক্ষিত কোনো পদে নির্বাচিত হবেন?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের হাই কমান্ড থেকে বারবার করে নতুন নেতৃত্বের কথা বলা হচ্ছে। সেই নতুন নেতৃত্বকে প্রস্তুত করতে হলে আপাতত আমাদের দৃষ্টিতে সজীব ওয়াজেদ জয় ও সোহেল তাজের দিকে নীতিনির্ধারক, ডেলিগেট বা কাউন্সিলরদের নজর দেওয়া জরুরি বলেই সমীচীন বোধ করি। দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষা ও সামনের ভোটের বৈতরণী পার হওয়ার ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে আওয়ামী লীগের পক্ষে এ মুহূর্তে শেখ হাসিনার বিকল্প নেই। কিন্তু শেখ হাসিনার অবর্তমানে নৌকার হাল কে ধরবেন, তা নির্ধারণ করার উপযুক্ত সময় এটাই।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী এবং নব্বই-পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে যে আন্দোলন করেছিলেন, তার মূল কথা ছিল ‘ভাত ও ভোটের অধিকার’।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম সম্মেলন সামনে রেখে বলেছেন, ‘২০১৯ সালে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের খুব বেশি সময় নেই। সংবিধান অনুযায়ী এ নির্বাচন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই হবে। সেই নির্বাচনের প্রস্তুতির জন্য দলকে আরো সুসংগঠিত করার লক্ষ্যে এবারের সম্মেলন অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। এর মাধ্যমে আমাদের আগামী নির্বাচনের বিজয়ের পথ সুগম হবে।’
তার মানে ধরেই নেওয়া যায়, সামনের ভোটের মাঠ গোছাতে এই সম্মেলনটাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। আওয়ামী লীগ সম্মেলন উপলক্ষে তাদের নবায়িত ঘোষণাপত্রে লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও মূলনীতির জানান দিতে গিয়ে বলেছে, ‘বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত এবং জ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রাখা এবং ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ ও ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের সমপর্যায়ে পৌঁছানোই হবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একমাত্র লক্ষ্য।’
আওয়ামী লীগের সম্মেলনকে স্বাগত জানিয়েছে বিএনপি। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আশা প্রকাশ করেছেন, দেশের গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে ভূমিকা রাখবে এই সম্মেলন। এর মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতে সব দলের সমান সুযোগের ভিত্তিতে স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার সুযোগ সৃষ্টি হবে, এমনটাও প্রত্যাশা করেন তিনি।
আমরাও চাই, ২০তম সম্মেলনের মাধ্যমে যে নতুন নেতৃত্বের হাতে পড়বে ঐতিহ্যবাহী এই দলটি, সেই নেতারা বাংলাদেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে বহু মত ও পথকে নিয়ে একসঙ্গে চলবেন। যাতে করে আমরা সবাই জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের বহুত্ববাদের চর্চায় অসাম্প্রদায়িক, কল্যাণমুখী, মানবতাবাদী, উদারনৈতিক ও পরমতসহিষ্ণু এক জাতিসত্তায় রূপান্তরিত হয়ে সমস্বরে বাংলা মায়ের জয়গান গাইতে পারি।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন।