বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক
নতুন সিল্ক রোডের স্বপ্ন

চীনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ১৪ ও ১৫ অক্টোবরের ঢাকা সফর একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এই ঐতিহাসিক ঘটনা বাংলাদেশের জন্য দুটি অবস্থানের অবতারণা করেছে। এর একটি হলো ইতিবাচক আর সংগত কারণেই অন্যটি হলো নেতিবাচক। ইতিবাচক অবস্থানগুলো হলো : এক হাজার ৯৮০ কোটি ডলারের দুই দেশের সরকারি পর্যায়ে অবকাঠামো, সড়ক, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ইত্যাদি খাতে আর্থিক সহায়তা প্রকল্প; দেশের সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য খাতে চুক্তি, যা প্রথমত, ১৮ কোটি ৬০ লাখ ডলারের চীনের সাত রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পাট ও পাটজাত পণ্য, চামড়া ও হিমায়িত খাদ্য রপ্তানির জন্য ব্যবসায়িক চুক্তি। দ্বিতীয়ত, চীনের ১৩টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বাংলাদেশের ১১টি বেসরকারি ও দুটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের এক হাজার ৩৬০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ চুক্তি, যা বিদ্যুৎ উৎপাদন ও অবকাঠামো নির্মাণের বিনিয়োগ হবে।
আর নেতিবাচকগুলো হলো : ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের চিত্র যা, তা যেকোনো দিকেই মোড় নিতে পারে। এ সফরের আগ পর্যন্ত ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়েই অধিকতর চমৎকার ও সৌহার্দ্যপূর্ণ আছে বলে ধরে নেওয়া যায়। এরই মধ্যে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এ খবর প্রকাশিত হয়েছে যে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বাংলাদেশের সঙ্গে, ভারতের সঙ্গে করা দুই বিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তির জবাবে ২৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি করেছেন। অর্থাৎ ১২ গুণ বেশি দিয়ে ভারতকে জবাব দিল চীন। নিঃসন্দেহে এটা ভারতের জন্য একটি মানসম্মানের ব্যাপার। অধিকন্তু পত্রপত্রিকায় এমন খবরও চাউর হয়েছে যে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক কমানোর দাবিসহ তিন শর্তে বেড়াজালে আটকে আছে ১৭৬টি প্রকল্প। অর্থায়নের দীর্ঘ অপেক্ষার পর চীনের সাড়া না পাওয়ায় ৪৩টি প্রকল্প ঋণের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এসব হলো গল্পের ভেতরে গল্প। দ্বিতীয় নেতিবাচক অবস্থানটি হলো চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক যুক্তরাষ্ট্র কখনো ভালো চোখে দেখবে না।
এসব বেড়াজালে আটকে থাকলে বাংলাদেশ কখনো ওপরে উঠতে পারবে না। আর তাই বঙ্গবন্ধুর দেওয়া নীতিই শ্রেষ্ঠ নীতি : ‘ফ্রেন্ডশিপ টু অল, মেলাইস টু নান’। আর এ জন্য দরকার পরিপক্ব ও সাহসী রাজনীতি ও কূটনীতি। এসব হাইপ্রোফাইল ধকল সহ্য করার মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আমাদের আছে কি? আশা করি, অভিজ্ঞমহল ভেবে দেখবেন।
এখন আসা যাক সিল্ক রোড নিয়ে। সম্মানিত পাঠক অবশ্যই জানেন, এই সিল্ক রোড একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও স্থাপনা। প্রাচীন সিল্ক রোডের উদ্ভব চীনের হান রাজবংশের যুগে যিশুখ্রিস্টের জন্মের ২০৭ বছর আগে থেকে। তৎকালে চীনে উৎপাদিত সিল্ক বা রেশমজাতীয় শিল্প চীন থেকে পশ্চিমের বিভিন্ন দেশে আমদানির জন্যই মূলত এ প্রাচীন পথের উদ্ভব। পরবর্তীকালে রেশম ছাড়াও অন্যান্য উৎপাদিত দ্রব্য ও কাঁচামালও এ রাস্তা দিয়ে চলাচল করত। নবম শতকে চীনারাই প্রথমে গানপাউডার আবিষ্কার করে, তাও এ রোডের মাধ্যমে পশ্চিমাদের হস্তগত হয়। এই সিল্ক রোডের মাধ্যমেই ধর্ম থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ঘটে যায়। বলা হয়ে থাকে, এর ফলে রোগবালাইও ছড়িয়ে যায় বিভিন্ন লোকালয়ে।
হালের ২০১৬ সালের সিল্ক রোড হবে দুটি, একটি স্থলপথে, অন্যটি জলপথে। চীনারা এর নাম দিয়েছে ‘ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড’, সংক্ষেপে ওবোর (OBOR)। এবারের মডার্ন সিল্ক রোড আবার দুটি অংশে বিভক্ত—১. দ্য সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্ট এবং ২. একবিংশ শতাব্দীর মেরিটাইমস সিল্ক রোড। আর এ ধারণার উদ্ভাবক হলেন বর্তমান চীনের প্রেসিডেন্ট স্বয়ং শি জিনপিং। এবারের এই আধুনিক ধারণার সিল্ক রোডেরও একটিই উদ্দেশ্য, দ্য পিপলস রিপাবলিক অব চায়না এবং পূর্বের ইউরেশিয়ান দেশগুলোর সঙ্গে একাধারে কানেক্টিভিটি, অন্যধারে কো-অপারেশন স্থাপন। এ ক্ষেত্রে চীনের বর্তমান প্রেসিডেন্টের উদ্দেশ্য অত্যন্ত স্বচ্ছ ও সদূরপ্রসারী, আর তা হলো গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্সে চীনের বড় ধরনের ভূমিকা ও প্রভাব স্থাপন।
জিনপিং তাঁর ২০১৩ সালের মধ্যে এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সফরের সময় এ ধারণার কথা প্রথম প্রকাশ করেন। এই ‘সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্ট’-এর ‘বেল্ট’ ধারণায় তিনি প্রাচীন সেই সিল্ক রোডের আশপাশে অবস্থিত মধ্য এশিয়া, পশ্চিম এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের দেশগুলোর কথা বুঝিয়েছেন। তিনি এসব দেশকে নিয়ে একটি ‘সংযোজক অর্থনৈতিক এলাকা’ বা ‘কোহেসিভ ইকোনমিক এরিয়া’ স্থাপন করার চিন্তা করছেন। এই নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক এলাকায় প্রধানত তিনটি কাজ হবে—১. অবকাঠামো উন্নয়ন, ২. সাংস্কৃতিক বিনিময় ও ৩. বাণিজ্য সম্প্রসারণ। তবে এবারের এই আধুনিক সিল্ক রোড অঞ্চল প্রসরিত করে দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকেও অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা আছে। ফলে সংগত কারণেই বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশ এর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে।
লক্ষণীয় বিষয় হলো এখানকার অবকাঠামো উন্নয়নে আর্থিক সহযোগিতা দেবে চীন পরিচালিত এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক, যার সদস্যসংখ্যা ৫৭টি দেশ এবং বাংলাদেশও এর অন্তর্ভুক্ত। এই ব্যাংকে বাংলাদেশের শেয়ার আছে দশমিক ৬৭ শতাংশ। স্থলপথের এই পরিকল্পিত সিল্ক রোড চীনের ঝিয়ান প্রদেশ থেকে শুরু হয়ে মঙ্গোলিয়া ঘেঁষে কাজাখস্তান, উজবেবিস্তান, ইরান, ইরাক, সিরিয়া, তুরস্ক, গ্রিস, রোমানিয়া ও ইউক্রেন হয়ে মস্কো এবং তারপর ইউরোপ, ইতালি, ফ্রান্স ও জার্মানি পর্যন্ত পৌঁছে যাবে।
অন্যদিকে, আধুনিক সিল্ক রোড ধারণার আরেকটি শাখা হলো মেরিটাইম সিল্ক রোড। এটা একটি স্থলপথের আধুনিক সিল্ক রোডের সম্পূরক বা পরিপূরক রুট হিসেবে ব্যবহার করার পরিকল্পনা রয়েছে চীনের। এই মেরিটাইম রোড স্থাপনের উদ্দেশ্য দুটি—১. বিনিয়োগ ও ২. বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতা। এই মেরিটাইম সিল্ক রোড চীনের দক্ষিণাংশের পূর্ব চায়না সাগর পাড়ে অবস্থিত ফুজহাউ অঞ্চল থেকে ভিয়েতনাম হয়ে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, কলকাতা, কলম্বো, নাইরোবি থেকে গালফ অব এডেন হয়ে ইয়েমেন ও সৌদি আরব হয়ে এথেন্স ও ইতালি পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। এর মাধ্যমে তিনটি সাগর, যথা—দক্ষিণ চায়না সাগর, দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর ও ভারত মহাসাগর কানেকটেড হবে আর এতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ওশেনিয়া ও উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোর মাধ্যমে সংযোগ স্থাপন হবে। চীনের প্রেসিডেন্ট ২০১৩ সালে ইন্দোনেশিয়ান পার্লামেন্টে বক্তৃতা দেওয়ার সময় এমন ধারণার কথা প্রথমবারের মতো প্রকাশ করেন। স্থলপথের সিল্ক রোড কিংবা জলপথের সিল্ক রোড এই উভয় রোডের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি সংযোগস্থল হিসেবে কাজ করবে। এ হিসাবেও বাংলাদেশের গুরুত্ব অপরিসীম। অন্যদিকে, চীনের আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তার ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ হতে পারে একটি ‘উৎক্ষেপণ মঞ্চ’। বহু আগ থেকেই বাংলাদেশ চীনের উন্নয়নের অংশীদার। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সেক্টরে চীনের রয়েছে গভীর, প্রাচীন ও ঐতিহাসিক প্রভাব। এরই সঙ্গে যোগ হবে অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব। দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৈরী আবহে বাংলাদেশ চীনের পুরাতন ও বিশ্বস্ত দেশ। সুতরাং বাংলাদেশকে বাদ দিয়ে চীন কিছু করতে চায় না।
বাংলাদেশের জন্য দুটি বিরাট চ্যালেঞ্জ—১. ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক ও কার্যকর সম্পর্ক বজায় রেখে চীনের এই ব্যাপক অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক প্রভাবের সঙ্গে নিজেকে একটি কার্যকরী অংশীদার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা ও টিকে থাকা এবং ২. চীনের এই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করে দেশের উন্নয়ন করা।
সরকারে যাঁরা আছেন এবং যাঁরা সরকারের বাইরে আছেন, এ ক্ষেত্রে আমাদের সবার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হতে হবে এক। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য আমি একটি চ্যালেঞ্জকে তুলে ধরব। তা হলো এত সব হাইপ্রোফাইল কর্মকাণ্ডে নিজেকে, সর্বোপরি দেশকে সম্পৃক্ত করার মতো যোগ্যতা আপনাদের আছে কি? থাকলে প্রমাণ করুন, জাতি আপনাদের দিকে তাকিয়ে আছে। শুধু সফরকে সফল করলেই চলবে না, সফর-পরবর্তী সফলতাই চূড়ান্ত সফলতা।
লেখক : মেজর (অব.), পিএসসি, জি, বর্তমানে আর্মি ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, সিলেটে উপপরিচালক (প্রশাসন ও হিসাব) হিসেবে কর্মরত আছেন।