জঙ্গি দমন
অপারেশন শরতের তুফান ও জঙ্গিদের গতিবিধি

অনেকটা ঝড়ের মতোই ৮ অক্টোবর তিন জেলার চার স্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জঙ্গিবিরোধী অভিযান ‘অপারেশন শরতের তুফান’ পরিচালিত হয়েছে। এই অপারেশনগুলো হলো গাজীপুরের পাতারটেক, হরিনাল, টাঙ্গাইলের কাগমারা ও আশুলিয়ার বাইপাইলের অভিযান। গুলশান, কল্যাণপুর কিংবা আজিমপুরের জঙ্গিবিরোধী অভিযানের প্রায় ১০০ দিনের মাথায় এসব অপারেশন পরিচালিত হয়েছে। তবে এবারের অপারেশন হয়েছে ঢাকার বাইরে গাজীপুর ও টাঙ্গাইলে।
মনে হচ্ছে, অব্যাহত গোয়েন্দা তৎপরতার মুখে জঙ্গিরা ঢাকা ছেড়ে দিয়ে ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলায় তাদের আস্তানা গেড়েছে। জঙ্গিদের এ তৎপরতার মধ্যে একটি বার্তা ফুটে এসেছে, যা ফেলে দেওয়া যায় না, তা হলো জঙ্গিদের ‘ডিসেপ্টিভ মুভমেন্ট’ বা ধোঁকাপূর্ণ চলাচলের রণকৌশলের বার্তা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মনোযোগ ঢাকা থেকে সরিয়ে নেওয়ার জন্যই এমন রণকৌশল অবলম্বন করতে পারে জঙ্গিরা।
এ কথা সত্যি যে, অব্যাহত সফল অপারেশনের মধ্যে জঙ্গিরা অনেকটা দৌড়ের ওপর আছে। নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থেই তারা আপাতত ঢাকা ছেড়েছে। তা ছাড়া ঢাকার বাইরের শহরগুলোতে গোয়েন্দা নজরদারি ততটা শক্তিশালী নয় বলেও জঙ্গিরা ধরে নিয়েছে, সেখানে ওইসব এলাকায় অর্থ ও অস্ত্র লেনদেন সহজতর, এমনকি বাড়িভাড়াও কম, এমন সব ফ্যাক্টর বিবেচনা করেই তারা আপাতত ঢাকা ছাড়তে পারে।
জঙ্গিবিরোধী অভিযানের আরেকটি ডাইমেনশন হলো অস্ত্র ও অর্থের উৎস খুঁজে বের করা। আমাদের বাহিনী যে এযাবৎকাল যেসব অস্ত্র উদ্ধার করেছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো একে-২২, সঙ্গে ছিল নাইন এমএম পিস্তল, হাতে তৈরি গ্রেনেড ও চাপাতি। প্রায় প্রতিটি অভিযানেই একে-২২ অস্ত্রটি উদ্ধার হয়েছে। এটি একটি একে-৪৭-এর আদলে তৈরি পয়েন্ট ২২ ক্যালিবারের আধা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। এর ম্যাগাজিন ক্ষমতা ৩০টি বুলেট। একেকটি করে গুলি ফায়ার করতে হয়। একে-৪৭ কালাশনিকভ অস্ত্রটি ১৯৪৮ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রস্তুত করেছিল। কিন্তু হালের এই পয়েন্ট ২২ একে-২২ অস্ত্র প্রস্তুত করেছে রোমানিয়ার উজিনেলে মাকানাইস জুগির কোম্পানি। এই অস্ত্রের বিশেষত্ব হলো, এটা সহজলভ্য, ভেঙে ভেঙে সহজেই বহন করা যায়, তুলনামূলক সস্তা এবং ফায়ারের সময় খুব একটা শব্দ করে না।
এবার দেখা যাক, এই অস্ত্র কীভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। রোমানিয়া হলো দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের একটি দেশ। দেশটি কৃষ্ণ সাগরের পশ্চিম তীরে অবস্থিত। আর কৃষ্ণ সাগরের পূর্বপাড়ে অবস্থিত পশ্চিম এশিয়া। সুতরাং এই অস্ত্র সহজেই কৃষ্ণ সাগর পাড়ি দিয়ে রোমানিয়া থেকে রাশিয়া, তুরস্ক কিংবা ইউক্রেনে চলে আসতে পারে। আর তুরস্কের পাশেই আছে সিরিয়া ও ইরাক, যেখানে রয়েছে আইএস জঙ্গিদের বাস। আবার এই অস্ত্র ইরাক থেকে চলে যায় দুবাই কিংবা ইরান হয়ে পাকিস্তান, ভারত ও মিয়ানমার। আর মিয়ানমার থেকে চট্টগ্রাম হয়ে অথবা ভারত থেকে রাজশাহী সীমান্ত দিয়ে অস্ত্র ব্যবসায়ীরা সহজেই বাংলাদেশে নিয়ে আসে। বাংলাদেশে এতটা পথ পাড়ি দেওয়ার পরও এর দাম পরে মাত্র তিন থেকে চার লাখ টাকা, যা জঙ্গিরা সহজেই কিনে নেয়। কেননা, জঙ্গিদের অর্থের কোনো অভাব নেই, তাই আমরা দেখে এসেছি এত দিন।
এ জন্যই জঙ্গিদের অর্থায়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা দেখছি, জঙ্গিরা লাখ লাখ টাকা হ্যান্ডেল করছে। এর উৎস হতে পারে দেশি ও বিদেশি অর্থ জোগানদাতা। তারা অর্থ পাচার কিংবা হুন্ডির মাধ্যমে এই টাকা পেতে পারে। সুতরাং কাউন্টার টেররিজমকে সফল করতে অস্ত্র ও অর্থের উৎস জানা অনেক জরুরি। এই দেশের কারা তাদের সহযোগিতা করছে, তা জানা প্রয়োজন। এ কথা অবধারিত সত্য যে, আমাদের দেশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটগুলো তাত্ত্বিকভাবে অনেক কিছুই জেনেছে। তাদের এখনকার কাজগুলো হতে পারে : ১. অস্ত্র ও অর্থের উৎস জানা এবং বন্ধ করা, ২. প্রান্তিক পর্যায়েও গোয়েন্দা কার্যক্রম বৃদ্ধি করা, ৩. জঙ্গিদের ডিসেপ্টিভ রণকৌশল নির্ধারণ করে কাউন্টার ব্যবস্থা নেওয়া এবং ৪. দেশি জোগানদাতাদের চিহ্নিত করা। আমি এর আগে আরেকটি লেখায় বলেছিলাম জঙ্গিরা হলো পানির নিচের মাছের মতো। তাদের চিহ্নিত করতে হলে কিংবা ধরতে হলে তাদের জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে জনগণের হৃদয়-মন জয় করা খুবই জরুরি।
লেখক : মেজর, পিএসসিজি (অব.), আর্মি ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে কর্মরত।