প্রতিক্রিয়া
জেগে ওঠো খাদিজা

রাতে টিভি ফুটেজে দেখলাম, ‘সাড়া দিচ্ছে খাদিজার শরীর।’ কয়েকটা শব্দের একটা বাক্য, কিন্তু আমার বুকের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। চোখ সজল হয়ে উঠল। এই বাক্যটির মতো কিছু শুনতে বোধ হয় আমি যুগ যুগ অপেক্ষা করছিলাম। মনে মনে প্রার্থনা করে যাচ্ছিলাম, ফিরে এসো খাদিজা। এর মধ্যে বাহাত্তর ঘণ্টার পর আরো অনেক ঘণ্টা পার হয়ে গিয়েছিল। অবশেষে ছিয়ানব্বই ঘণ্টা পর খাদিজা ফিরে আসার সিগন্যাল দিল। দু-তিন দিন ধরে সামাজিক নেটওয়ার্ক অন্যান্য মিডিয়ায় খাদিজা-সংক্রান্ত ভিডিও, খবর মানুষকে একটা অস্থিরতায় ফেলে দিয়েছে।
এই অস্থিরতার প্রেক্ষাপট আমাদের জানা। বারবার ফিরে আসছে তনু, মিতু, রিশা, খাদিজা বা ঘটে যাওয়া এমন অসংখ্য নারীর অত্যাচারিত হওয়ার কথা। কেন এমন ধরনের ঘটনা ঘটছে, সেটা নিয়ে গবেষণার অন্ত নেই। আলোচনা-সমালোচনা, টক শো, মিষ্টি শোর অভাব নেই। কিন্তু ফলের খাতায় শূন্য। খাদিজাকে নিয়ে সামাজিক নেটওয়ার্ক, টিভি, পত্রিকা সরগরম হয়ে উঠেছে, ঠিক যেমনটি ইস্যুভিত্তিক বরাবরই হয়ে থাকে। দুদিন পরে তলিয়ে যাবে অন্য কোনো খাদিজা বা রিশার গল্পের অন্তরালে।
রিশা ও খাদিজা সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া দুটি ঘটনাই ভয়াবহ। দুজনই ছাত্রী এবং দুটি ঘটনাই ঘটেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আশপাশে দিনের আলোয় লোকজনের সামনে। যারা ঘটিয়েছে, তারা ব্যর্থ প্রেমিক। কিন্তু আসলেই কি তারা প্রেমিক? প্রেমিকরা যাকে ভালোবাসে, তাকে হত্যা করতে পারে? আমার চিন্তায় কুলায় না। সত্যিকার অর্থে এরা মানসিক বিকারগ্রস্ত। খুব অবাক হতে হয়, কত সহজে এসব পুরুষ বলে দেয়, রাগ হয়ে গিয়েছিল বা মাথায় রক্ত উঠে গিয়েছিল, তাই নিজেকে সামলাতে পারিনি। বাহ! কী দারুণ যুক্তি। পুরুষের রাগ হবে, রক্ত টগবগ করে ফুটবে তাই চাপাতি দিয়ে নারীকে কোপাবে। নারীর কোনো রাগ নেই, শরীরে রক্ত নেই!
মেয়েটির জীবন মানুষের জীবন নয়, পতঙ্গের জীবন। পুরুষের রাগ হবে, কারণ নারীটি তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। একজন মেয়ে মানুষ (মানুষ নয়) পুরুষকে প্রত্যাখ্যান করবে এত বড় সাহস? পুরুষ ভালোবাসতে বললে নারীকে ভালোবাসতে হবে। সে হাসতে বললে হাসতে হবে। কাঁদতে বললে কাঁদতে হবে। আমরা ঘরের ভেতরেই কি এমন দেখি না? স্বামী কত সহজে স্ত্রীকে বলে দেয়, ঘ্যানঘ্যান করবে না। রাগিয়ে দেবে না আমাকে। ভাই বোনকে বলে দেয়, এটা করবি না, ওটা করবি না, ঠ্যাং ভেঙে দেবে, গলা কেটে ভাসিয়ে দেব। বোন এ ধরনের কথা কি ভাইকে বলতে সাহস পায়? কজন স্ত্রী স্বামীর দোষের শাস্তি দিতে পারে? মোদ্দাকথা হলো একজন ছেলেসন্তান জন্মের পর থেকেই দেখে আসছে মা-বাবার ওপর খবরদারি করছে, ভাই বোনের ওপর মাতব্বরি করছে, এমনকি ছেলে বড় হওয়ার পর মাকে সেই ছেলের নির্দেশমতো চলতে হচ্ছে। সুতরাং ছেলেটির মধ্যে এই ধারণাই মজ্জাগত হচ্ছে যে, নারী জাতি আলাদা একটা শ্রেণি এবং তাঁদের ওপর স্টিম রোলার চালানোর দায়িত্বটা প্রকৃতি পুরুষের হাতে দিয়েছে। তাই তো কথায় কথায় তাদের রাগ উঠে যায়। নারীর বুকে ছুরি চালায়, রেপ করে, শরীরের যেখানে ইচ্ছা সেখানে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে রাগ সামলায়। আচ্ছা, এমনকি হয়েছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে কোনো নারী আজ পর্যন্ত চাপাতি হাতে তুলে নিয়েছে? তাহলে এখন তার ওপর যখন জনসমক্ষে চাপাতি নেমে আসছে, সে কী করবে? আত্মরক্ষার জন্য ব্যাগে চাপাতি নিয়ে ঘুরবে? নাকি শাসনযন্ত্র পরপর ঘটে যাওয়া এসব ঘটনার যথাযথ বিচার করবে। আগামীতে যাতে এমন কোনো ধরনের ঘটনা না ঘটে, তার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করবে?
সামাজিক মাধ্যম বা আশপাশের অনেকের মুখে শুনছি, খাদিজার শরীরের যে অবস্থা তাতে সে জীবিত ফিরে এলে বরং কষ্টের হবে। কারণ, তাঁকে হয়তো পঙ্গুত্ববরণ করে দুঃসহ জীবনযাপন করতে হবে। এমনকি অনেকে তাঁর মৃত্যু কামনা করছেন। কিন্তু আমি সেটা মনে করি না। ও চলে যাওয়া মানে অন্যায়ের কাছে হেরে যাওয়া। তনু, মিতু, আফসানা, রিশা, এমন না জানি কত কত মা, মেয়ে, বোনকে হারিয়েছি। খাদিজাকে হারাতে চাই না। আমি চাই, খাদিজা ফিরে আসুক। ও যেন নিজের চোখে সেই পাপী বদরুলের শাস্তি দেখতে পায়। খাদিজার জেগে ওঠার মাধ্যমে এ দেশের নারী সমাজের পুনর্জাগরণ ঘটুক।
তাই বারবার প্রার্থনা করছি, জেগে ওঠো খাদিজা। প্লিজ, আল্লাহর ওয়াস্তে জেগে ওঠো।
লেখক : শিক্ষক