বিশ্ব প্রবীণ দিবস
মর্যাদায় বাঁচুন আমাদের মাতা-পিতা

যে ঘর তিল তিল করে গড়ে তোলেন মা-বাবারা, সন্তান খুব স্বার্থপর হয়ে উঠলে স্বর্গতুল্য সেই আপন নিবাসও ছেড়ে যেতে হয় তাঁদের। আপন ঘরেই হয়ে যান পর। পরম প্রশান্তি আর সব নির্ভরতার ভরসাস্থল মা-বাবার দুচোখে সাগরসম অশ্রুও পাষাণ সন্তান-সন্ততির মন গলাতে পারে না। মোহর মেরে দেওয়া হৃদয়ে টান পড়ে না। মাতা-পিতা সন্তানের জন্য সব সুখ বিসর্জন দেন আর সেই আদরের সন্তান সব বেমালুম ভুলে গিয়ে নিঃসঙ্কোচে চরম নির্মমতায় মাতা-পিতাকেই নির্বাসনের নিমজ্জনে পাঠায়।
বাংলাদেশ এটমিক এনার্জির বৈজ্ঞানিক এবং পরবর্তী সময়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. এম আব্দুল আওয়ালের কথা আমরা জানি। যার প্রতিষ্ঠিত দুই ছেলে ও এক মেয়ে থাকা সত্ত্বেও জীবনের শেষবেলায় এসে বসবাস করতে হচ্ছে আগারগাঁওয়ের প্রবীণ নিবাসে। ছেলেরা কৌশল করে তাঁর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি সবই হাতিয়ে নিয়ে নিঃস্ব করে দিয়ে বাবাকে করেছে পর। এমন উদাহরণ আমাদের সমাজে অহরহই মেলে।
সমাজ পরিবর্তনের সাথে সাথে যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে। সেইসাথে ভাঙছে পারস্পরিক সম্পর্কও। পরিবারগুলোর এমন ভাঙনে বঞ্চনা ও অবহেলার শিকার হচ্ছেন প্রবীণরা। এখন বৃদ্ধ মা-বাবার ভরণ পোষণ বা প্রবীণদের অধিকারের বিষয়টি আইনেও গড়িয়েছে। তবে এসব আইন সম্পর্কে অনেকেরই স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই। সামাজিক মূল্যবোধ জাগ্রত করার পাশাপাশি এসব আইনের প্রয়োগ ও বহুল প্রচার দাবি আইনজীবী ও সুশীল সমাজের।
অতীতে প্রবীণরা যৌথ পরিবারে সবার কাছ থেকে সেবা ও সহায়তা পেতেন। সমাজে প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শনসহ তাঁদের বেশি যত্ন নেওয়ার একটি বিশেষ মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি চালু ছিল। কিন্তু বর্তমানে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক নানা পরিবর্তনের ফলে যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে যাওয়ায় প্রবীণরা হারাচ্ছেন তাঁদের প্রতি সহানুভূতি, বাড়ছে অবহেলা আর বঞ্চনা। যে বয়সে নাতি-নাতনিদের সঙ্গে সময় কাটানোর কথা; সময় কাটছে বৃদ্ধাশ্রমের আবদ্ধ গণ্ডির ভেতরে। পরম মমতা ও গভীর ভালোবাসায় সন্তানদের বড় করে একসময় বৃদ্ধ মা-বাবা সেই সন্তানের কাছেই হয়ে যান বোঝা। তারপরও সন্তানের বিরুদ্ধে অভিযোগও নেই অনেকের। বুকের ভেতর কষ্ট চেপে রেখে আড়াল করতে চান সন্তানের সব অবহেলা।
প্রবীণদের বার্ধক্য, স্বাস্থ্যসমস্যা, কর্মঅক্ষমতা, পরিবার হতে বিচ্ছিন্নতা, একাকিত্ব ইত্যাদি বিষয় যথাযথভাবে গুরুত্ব দিয়ে তাঁদের কল্যাণের জন্য ১৯৮২ সালে ভিয়েনাতে অনুষ্ঠিত প্রবীণ বিষয়ক প্রথম বিশ্ব সম্মেলনে এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক পরিকল্পনা ও দিকনির্দেশনা গৃহীত হয়। আর ২০০২ সালে বিশ্বের ১৫৯টি দেশের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে স্পেনের মাদ্রিদে প্রবীণ বিষয়ক দ্বিতীয় বিশ্ব সম্মেলনে একটি সুসংবদ্ধ আন্তর্জাতিক পরিকল্পনা এবং রাজনৈতিক ঘোষণা গৃহীত হয় যা ‘মাদ্রিদ আন্তর্জাতিক কর্ম-পরিকল্পনা’ হিসেবে পরিচিত।
নাগরিক হিসেবে প্রবীণ ব্যক্তিরা পূর্ণ অধিকার, সার্বিক নিরাপত্তা ও মর্যাদার সাথে যাতে ভূমিকা পালন করতে পারেন সেজন্য মাদ্রিদ বিশ্ব সম্মেলনের সদস্য রাষ্ট্রগুলো সংশ্লিষ্ট নীতিমালা প্রণয়নের জন্য সুনির্দিষ্ট ঘোষণা উপস্থাপন করে। এই ঘোষণার অন্যতম প্রধান বিষয়গুলো হলো :
১) সব প্রবীণ নাগরিকের মৌলিক স্বাধীনতা ও প্রতিটি মানবাধিকারের পূর্ণ বাস্তবায়ন
২) নিরাপদ বার্ধক্য অর্জন অর্থাৎ প্রবীণ বয়সে দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং প্রবীণদের জন্য জাতিসংঘ ।
৩) নীতিমালা বাস্তবায়ন ।
৪) সামাজিক উন্নয়নের জন্য পারস্পরিক সংহতি, আন্তপ্রজন্ম নির্ভরশীলতার মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার স্বীকৃতি প্রদান।
৫) আন্তর্জাতিক কর্ম-পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপদান করার জন্য প্রবীণ ব্যক্তিরা নিজেদের ব্যক্তি, নাগরিক, সমাজ ও সরকারের সব মহলের সাথে সমঅংশীদারত্ব তৈরি করা।
৬) ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রবীণদের নিজস্বতা ও স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে তাঁদের সরাসরি উপকারে আসে এমন বিষয়ে কার্যকরভাবে সোচ্চার হওয়া ।
৭) নারী পুরুষের মধ্যকার জেন্ডার বৈষম্য বিলোপ করাসহ অন্যান্য পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে প্রবীণদের মধ্যে জেন্ডার সমতা প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করা।
৮) বার্ধক্যজনিত, ব্যক্তিগত, সামাজিক ও স্বাস্থ্যগত জটিলতা মোকাবিলা করতে বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা ও দক্ষতার সমন্বয় করা এবং প্রযুক্তির সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো, বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে।
পরবর্তী সময়ে ২০০২ সালে ‘মাদ্রিদ আন্তর্জাতিক কর্ম-পরিকল্পনা’ গৃহীত হওয়ায় বাংলাদেশ সরকার উক্ত পরিকল্পনার প্রতি রাষ্ট্রীয় সমর্থন ব্যক্ত করে এবং ২০১৩ সালে প্রবীণদের অধিকার, উন্নয়ন এবং সার্বিক কল্যাণে দীর্ঘমেয়াদি এবং স্থায়ী কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে একটি নীতিমালা আবশ্যক হওয়ায় ‘জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা -২০১৩’ প্রণয়ন করে।
আর এই আইনের লক্ষ্য বা Goal নির্ধারণ করা হয়, প্রবীণদের মর্যাদাপূর্ণ, দারিদ্র্যমুক্ত, কর্মময়, সুস্বাস্থ্য ও নিরাপদ সামাজিক জীবন নিশ্চিত করা। বাস্তবতা হলো আইনটি পাসের তিন বছর অতিক্রান্ত হলেও এসব নিশ্চয়তার বিষয়টি এখন পর্যন্ত দেশের কোনোস্তরেই দৃশ্যমান নয়!
বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রক্ষেপণ অনুযায়ী ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৩০ শতাংশ অর্থাৎ প্রতি পাঁচজনে একজন হবেন প্রবীণ। ২০০১ সালে আদমশুমারী অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রবীণের হার ছিল ৬.১ শতাংশ। নিজেদের স্বার্থচিন্তায় প্রবীণ মা-বাবার মায়ার বাঁধনও অবলীলায় ভুলে যায় সন্তানরা। কারোরই মনে থাকে না যে, পৃথিবীর তাবৎ ধর্ম-দর্শন বা নীতিকথাতেও মাতা-পিতার মর্যাদা সর্বাগ্রেই দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায় মা-বাবার ভরণ-পোষণ ও জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা নামে আইন পাস করাটা রাষ্ট্রের কাছেও অনিবার্যই হয়ে পড়ে বটে।
প্রবীণ নীতিমালা-২০১৩ অনুযায়ী প্রবীণ ব্যক্তিদের শেষ জীবনে সচ্ছলতা, আত্মপরিতৃপ্তি ও ব্যক্তিগত উন্নয়নের সংস্থান করার কথা রয়েছে এবং প্রবীণ ব্যক্তিরা যাতে পূর্ণ অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করতে পারেন তা নিশ্চিত করা এবং সব ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করার কথাও বলা আছে।
অপরদিকে পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন-২০১৩ অনুযায়ী মাতা-পিতা অথবা মাতা-পিতার অবর্তমানে দাদা-দাদি নানা-নানির ভরণ পোষণ অর্থাৎ খাওয়া-দাওয়া, বস্ত্র, চিকিৎসা ও বসবাসের সুবিধা এবং সঙ্গ প্রদানে সন্তান বাধ্য থাকবে- এমনটাই বলা হয়েছে। অন্যথায় মাত-পিতার লিখিত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সন্তান এক লাখ টাকা জরিমানা বা অনাদায়ে তিন মাসের কারাদন্ডে দণ্ডিত হবে।
তবে এখনো এই দুটি আইন সম্পর্কে অনেকেরই কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই। কারণ এসব আইনের ব্যাপারে সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে কোনো প্রচারণা নেই। কোথাও তেমন কোনো আলোচনাও চোখে পড়ে না। এমনকি রাষ্ট্র নিজেও তার প্রণীত আইন প্রয়োগে এখনো পুরোদস্তুর সুপ্ত অবস্থাতেই আছে।
হতে পারে সন্তানের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হওয়ার বিষয়টি মাথায় রেখে আইনের দ্বারস্থ হতে চান না বঞ্চনার শিকার মা-বাবারা। তবে সমাজে উদাহরণ সৃষ্টি করার জন্য হলেও আইনটি কার্যকরে উদ্যোগী হওয়া দরকার বলে মনে করেন মানবাধিকার আইনজীবীরা।
অবশ্য সমাজবিজ্ঞানী ও প্রশাসনিক আধিকারিকরা মনে করেন, মা-বাবার প্রতি দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে আইনের চেয়ে সামাজিক মূল্যবোধই বেশি জরুরি। তারপরও প্রবীণদের নিরাপত্তা বিধানে দেশে যেহেতু আইন বলবৎ রয়েছে, সেহেতু এই আইনগুলোর ব্যাপারে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সভা, সেমিনারে প্রচারণা চালানোটাও আবশ্যকীয়তার মধ্যেই পড়ে। না হয় কাজির গরু কিতাবে থেকে থেকে ঘুণপোকা ধরবে, তাকে কস্মিনকালেও আর গোয়ালে পাওয়া যাবে না। আর সন্তান কর্তৃক চলমান প্রবীণদের বঞ্চনা, অবহেলা বা ক্ষেত্রবিশেষে নিপীড়নের ইতিহাসের বদল ঘটবে না।
জাতিসংঘ বার্ধক্যকে মানবজীবনের প্রধানতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করে এ সমস্যা সম্পর্কে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষে ১৯৯১ সাল থেকে প্রতি বছর ১ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। আজকের জোয়ান সন্তান বা তার স্ত্রীও একদিন বার্ধক্যের যেই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে নিশ্চিত, সেই সন্তানের তবে বোধোদয় হোক, মানবিকতা জাগ্রত হোক -প্রাপ্য মর্যাদায় বাঁচুন আমাদের মাতা-পিতা। যুগ যুগান্তরে বর্তমান আর উত্তরকালে নবীণ আর প্রবীণের হার্দিক মিলেমিশেই সুশোভন সুন্দর হোক ধরিত্রী।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন