ভয়ংকর ‘ডিজিটাল মাদক’

সন্তান নিয়ে মা-বাবার উদ্বেগের শেষ নেই। রাতে ঘুমাতে যাবে তখনো সন্তানের রুমটাতে একটু ঢুঁ মারতেই হবে তাঁকে। কী করে তাঁর সন্তান? সন্তানের রুমে বাতি জ্বলতে দেখে মা-বাবা ভাববেন, ‘সে পড়ালেখা করছে।’ কিংবা আলো নেভানো দেখে ভাববেন, ‘সে ঘুমাচ্ছে।’ অথচ তাঁদের এ ধারণা ভুলও হতে পারে। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোসায়েন্স বিভাগের পরিচালক বলছেন, আমেরিকায় তরুণদের একটা বড় অংশ ‘ইলেকট্রনিক কোকেইন’-এ আসক্ত। যেটাকেই চায়নিজ গবেষকরা বলছেন ‘ইলেকট্রনিক হেরোইন’। যার আগ্রাসন আমেরিকা, ব্রিটেন, চীন হয়ে এখন বাংলাদেশি শিশু, কিশোর, তরুণ ও যুবকদের গ্রাস করছে।
সেদিন একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। প্রায় আটশ লোকের আয়োজন। যেখানে ৫ থেকে ১৫ বছর বয়সী বাচ্চাদের সংখ্যা হবে প্রায় ১০০ জন। খাবার পরিবেশনের আগে সবাই কথা বলছিল, একজন আরেকজনের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছিল, গল্প করছিল। কিন্তু এই বাচ্চাদের একটা বড় অংশকে দেখলাম সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া থেকে দূরে। তারা প্রায় সবাই স্মার্টফোন, আইফোন, ট্যাব নিয়ে ব্যস্ত। অথচ বিয়ে একটি সামাজিক অনুষ্ঠান। এখানে প্রায় সব নিকট আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা হয়। সাধারণত মা-বাবা তাঁদের ছোট ছেলেমেয়েদের অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। যার মাধ্যমে বাচ্চাদের সঙ্গে অপরিচিত আত্মীয়স্বজনের একটা মেলবন্ধন ঘটে। কিন্তু এই বিয়ের অনুষ্ঠানের চিত্র সম্পূর্ণ আলাদা। বাচ্চারা তাদের স্মার্টফোন, ট্যাব, ফেসবুক, গেম, ইউটিউব নিয়ে ব্যস্ত থাকার মাধ্যমে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। এটা ডিজিটাল আসক্তির একটা মাত্র বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। মার্কিন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ড. নিকোলাস কারদারাস এ ধরনের আসক্তিকে ‘ডিজিটাল মাদক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। আমাদের সমাজেও ডিজিটাল মাদকের সর্বগ্রাসী থাবা শুরু হয়েছে।
কিছুদিন আগে বিয়ে হয়েছে এমন এক আপুর সঙ্গে কয়েক দিন আগে কথা হচ্ছিল। তিনি অনুযোগের সুরে বলছিলেন, ‘তোমার ভাইয়া তো সারা দিন অফিসে থাকে আর রাতে এসে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে থাকে।’ এ অভ্যাস অনেক সময় পারিবারিক অশান্তির কারণ হয়ে উঠতে পারে। আমি প্রায়ই ক্লাসে প্রত্যক্ষ করি, কিছু শিক্ষার্থী ক্লাস চলাকালীন অবস্থায়ই মাঝেমধ্যে তাঁর মোবাইলের দিকে দৃষ্টি দিচ্ছেন। কখনো ফেসবুক কিংবা কখনো ‘ক্লাশ অব ক্লানস’ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন। এর মধ্যে একদিন মহাখালীতে ট্রাফিক জ্যামে বাসের মধ্যে বসে আছি। পাশেই দৃষ্টি দিয়ে দেখলাম মোটরসাইকেলে এক জোড়া তরুণ-তরুণী বসা। তাঁদের দেখে দম্পতিই মনে হবে। তরুণটি যিনি মোটরসাইকেল ড্রাইভ করছিলেন, তিনি মোবাইলে গেম খেলা শুরু করেছেন এবং পেছনে বসা তরুণী মোবাইলে ফেসবুক চালাচ্ছেন। রাস্তায় চলাচলের মধ্যেই পাওয়া একটু সময় তাঁরা কোনো কথা না বলে যে যারমতো ডিজিটাল ডিভাইসের সঙ্গে কথা বলছেন।
ছোট বাচ্চারা সাধারণত অপরিচিত কারো সঙ্গে কথা বলতে কিংবা দৃষ্টিবিনিময় করতে চায় না। আপনি যখন আপনার পকেটে থাকা স্মার্টফোনটি বের করে সামনে ধরবেন, তখন দেখবেন আপনার সঙ্গে সে কথা বলতে আগ্রহী হয়ে উঠবে। এটা একদিনে ঘটে নাই। অনেকের ছোট ছোট বাচ্চা রাতে ঘুমিয়ে থাকে, ঘুম ভেঙে কান্না শুরু করলে হাতে মোবাইল দিয়ে শান্ত করেন। এটাই আস্তে আস্তে তার অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। এতে বাচ্চাদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবোধ তৈরি হয়। বৈজ্ঞানিকভাবে এসব ডিজিটাল ডিভাইসের ক্ষতির বিষয়টি প্রমাণিত। ছোট বাচ্চাদের জন্য এ ক্ষতি আরো বেশি হয়। রাস্তায় কিংবা স্কুলে লক্ষ করলে দেখা যায়, অনেক শিশুর চোখে সমস্যা। শিশুকালেই চশমা ব্যবহার করতে হচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এর কারণ এই ডিজিটাল মাদকাসক্তি। কয়েক দিন আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছোট ভাই তার বড় আপুর মেয়ের চোখ পরীক্ষার জন্য ঢাকার ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালে গিয়েছিল। তার ভাষায়, ‘শিশু বিভাগের এক ডাক্তারের কক্ষে ৩৫ মিনিট অবস্থানকালে আমার সামনেই পাঁচ শিশুর (বয়স ৮-১৪) চোখ পরীক্ষা সম্পন্ন করলেন তিনি। ডাক্তারের পরীক্ষা, রোগী ও অভিভাবকদের কথায় জানা গেল চারটি শিশুর চোখেই মোবাইল-কম্পিউটারে অতিরিক্ত গেমস খেলা এবং টিভি দেখার কারণে সমস্যার সৃষ্টি। ব্যবস্থাপত্র দিয়ে সব অভিভাবককেই চিকিৎসকের পরামর্শ- বাচ্চাদের মোবাইল, কম্পিউটার ও টিভি থেকে দূরে রাখবেন। চিকিৎসক আপার সঙ্গে কথা বলে জানলাম, সাম্প্রতিক সময়ে শহরের অধিকাংশ শিশুই এ ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে, যা কিছুদিন পর ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। তিনি দুঃখ করে বললেন, ‘তথ্যপ্রযুক্তির বিস্তার কত বড় সম্পদটাই না ছিনিয়ে নিচ্ছে আমাদের কাছ থেকে, সবার অজান্তে।’
এই ডিজিটাল মাদকাসক্তির সামাজিক প্রভাব আরো ভয়াবহ। যোগাযোগব্যবস্থাকে সহজ করার জন্য আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির আবির্ভাব। কিন্তু এর যথাযথ ব্যবহার না হওয়ার ফলে ব্যবহারকারী তার পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। আমি গ্রিন ইউনিভার্সিটির কয়েকটি ক্লাসে শিক্ষার্থীদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, দৈনিক কী পরিমাণ সময় তারা অনলাইন কিংবা অফলাইনে মোবাইল, ট্যাব বা কম্পিউটারের পেছনে ব্যয় করে? তাদের প্রদত্ত তথ্য থেকে জানতে পারলাম, তারা গড়ে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা ডিজিটাল ডিভাইসের পেছনে ব্যয় করে, যার বড় অংশই একাডেমিক বা ব্যবসায়িক প্রয়োজনের বাইরে। অনেকেই অফিসে কিংবা বাসায় কোনো কারণ ছাড়াই সচেতন বা অবচেতনভাবে ফেসবুকের নিউজফিড স্ক্রলিং করে যাচ্ছে। এভাবে হয়তো মনের অজান্তেই অনেক সময় নষ্ট করে ফেলছে। রাতে ঘুমানোর সময় এ ধরনের একটা ডিভাইস হাতের নাগালে থাকা অনেকের ঘুমকে কয়েক ঘণ্টা প্রলম্বিত করে দেয়। এ অভ্যাস আস্তে আস্তে ঘুম না আসার কারণে পরিণত হতে পারে। ছোট শিশুরা মোবাইলে গেম খেলে অথবা কার্টুন দেখে। বর্তমান সময়ে শিশুরা যে ভিডিও গেম পছন্দ করে, তার অধিকাংশজুড়েই থাকে হিংস্রতা, মারামারি, যুদ্ধ, দখল প্রভৃতি। যেগুলো শিশুর মানবিক মূল্যবোধ তৈরির পথে অন্তরায় হিসেবে কাজ করতে পারে।
এসব মূল্যবোধের অভাবেই শাকিল, মুগ্ধ, সজীবরা তৈরি হচ্ছে। আর এর বলি হচ্ছে বাবা-মা, বন্ধু অথবা অন্য কেউ কিংবা কখনো সে নিজেই নিজেকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এ ব্যাপারে অভিভাবকরা এখনই সচেতন না হলে আমরা খুব শিগগিরই আবেগ-অনুভূতি ও মানবিক মূল্যবোধহীন একটা প্রজন্মের মুখোমুখি হব।
লেখক : শিক্ষক, সমাজবিজ্ঞান ও নৃবিজ্ঞান বিভাগ, গ্রিন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।