আন্তর্জাতিক শান্তি দিবস
সকল অশান্তি দূর হোক

ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেশে জাতিতে জাতিতে তখন যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগেই ছিল। আর সেটির অনিবার্য পরিণতি ছিল ১৯১৪-১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং ১৯৩৯-৪৪ সাল পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। সে সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যুদ্ধের শক্তি সঞ্চয় করার জন্য অসম প্রতিযোগিতার অংশ হিসেবে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হতে থাকে। কাজেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে বা তার অব্যবহিত পরে ১৯৪৫ সালে বিশ্ব শান্তির লক্ষ্যে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা সৃষ্টি করা হয়, যার নাম জাতিসংঘ।
সেই জাতিসংঘের মাধ্যমে মনে করা হয়েছিল বিশ্বের মানুষের জন্য শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। কিন্তু জাতিসংঘের মাধ্যমে সেই শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কতটুকু অগ্রসর হয়েছে সে বিষয়ে পক্ষে-বিপক্ষে অনেক তর্ক-বিতর্ক থাকলেও দিন শেষে নির্দ্বিধায় একটি কথা অবশ্যই বলা যায়, বিশ্বশান্তির ক্ষেত্রে জাতিসংঘ পুরোপুরি সফল না হলেও তা মোটেও ব্যর্থ হয়নি। সেই জাতিসংঘের মাধ্যমে মানবকল্যাণে গৃহীত বিভিন্ন কর্মসূচি বিভিন্ন দিবস হিসেবে পালন করা হয়ে থাকে। তারই অংশ হিসেবে ১৯৮১ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক তা ১৯৮২ সাল থেকে পালন শুরু হয়েছে। তখন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের মিটিং যেদিন উদ্বোধন করা হবে, সেই দিনটিই হবে আন্তর্জাতিক শান্তি দিবস। কারণ জাতিসংঘ নামক সংস্থাটিই বিশ্বমানবের শান্তির জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর ২০০১ সালের আগ পর্যন্ত সেটা পালন করা হতো সেপ্টেম্বর মাসের তৃতীয় মঙ্গলবার অর্থাৎ যেদিন সাধারণ পরিষদের অধিবেশন উদ্বোধন করা হতো। কিন্তু ২০০১ সালে জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনান সাধারণ পরিষদের মিটিংয়ের শুরুতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে সেটি ২১ সেপ্টেম্বর থেকে পালন করা হবে। তদানুযায়ী একটি রেজুলেশন গ্রহণ করা হয়, যার ভিত্তিতে ২০০২ সাল থেকে তা ২১ সেপ্টেম্বরই পালন করা হচ্ছে।
জাতিসংঘ কর্তৃক দিবসটি পালনের কিছু সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য রয়েছে। সেখানে প্রতিবছর দিবসটি পালনের একটি থিম ও প্রতিপাদ্য থাকে। সেভাবেই এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ইংরেজিতে The sustainable development goals : building blocks for peace’ বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায় শান্তির জন্য টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা হলো সিঁড়ির মতো। কারণ ২০১৫ সালে যখন ২০১৫-২০৩০ মেয়াদের জন্য টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় তখনই এবারের বিশ্বশান্তির জন্য এমন একটি লাগসই প্রতিপাদ্য বিষয় ঠিক করা হয়েছিল। কারণ বিশ্বনেতারা স্নায়ুযুদ্ধোত্তরকালে অস্ত্রের যুদ্ধের চেয়ে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে মানবকল্যাণের জন্য বেশি প্রয়োজনীয় বলে মনে করতে পেরেছেন। সে জন্য টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় গৃহীত যে ১৭টি নীতি গ্রহণ করা হয়েছে, সেগুলোই অর্জনের চেষ্টা করা হচ্ছে এখন। তবে তার মধ্যে মোট কথা হলো বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন কারণে যে অশান্তির আগুন জ্বলে, সেগুলো নিভিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা।
‘শান্তি’ শব্দটি একটি আপেক্ষিক শব্দ। একটি ঘটনা কিংবা বিষয় কারো জন্য শান্তির হলেও অপরের জন্য তা অশান্তির কারণ হতে পারে। বিভিন্ন দেশে-দেশে যুদ্ধ-বিগ্রহ, মানুষে মানুষে হানাহানি, ভেদাভেদ সৃষ্টিতে সহায়তা করে থাকে। এসব অশান্তির কারণ হতে পারে এক বা একাধিক দেশের মধ্যে আন্তরাষ্ট্রীয়ভাবে, হতে পারে দেশের অভ্যন্তরে অন্তরাষ্ট্রীয় কোনো ঘটনাকে কেন্দ্র করে। আর এসব ঘটে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্যকে বিস্তার নিয়ে। সে জন্য কখনো বা অস্ত্র ব্যবসার প্রসার কিংবা মোড়লীপনা করে আর্থিক আধিপত্য বিস্তার করা। আমরা জানি একসময় বিশ্বে শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে দ্বিকেন্দ্রিক শক্তিতে বলীয়ান ছিল। তার একটি ছিল সোভিয়েত রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক ব্লক, আরেকটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ধনতান্ত্রিক কিংবা গণতান্ত্রিক ব্লক। তখন এ দুই পরাশক্তির পতাকাতলে শামিল হয়ে সেভাবে বিশ্বরাজনীতি ও অর্থনীতি পরিচালিত হয়ে নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে।
পরবর্তী সময়ে সমাজতান্ত্রিক ধারার কমিউনিজম মার খেতে থাকলে বিংশ শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে এসে যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের নেতৃত্বাধীন পরাশক্তির কুটচালে সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। তখন একক রাশিয়া বিশ্ব শক্তিময়তা থেকে পিছিয়ে পড়তে থাকে আস্তে আস্তে। তখন থেকে শুরু যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে এককেন্দ্রিক শক্তির মহড়া। এসব ঐতিহাসিক বিষয় বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। কিন্তু একটি বিষয় তখন খুব কষ্টের সঙ্গে লক্ষ করা যেত যে, যখনই দুটি দেশের মধ্যে যুদ্ধ রেগে যেত কিংবা লাগানো হতো তখন তাদের শান্তির কথা বলে অদৃশ্য স্থান থেকে উসকে দেওয়া হতো। যেমন জার্মানির বিভক্তকরণ, কোরিয়ার বিভক্তকরণ, ভিয়েতনামে যুদ্ধ করা, ইরাক-ইরান যুদ্ধ, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, পাকিস্তান-ভারতের যুদ্ধ এবং এমনকি বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধেও এসব বিষয়কে কাজে লাগানো হয়েছে। এখন যে ইসরাইল-ফিলিস্তিন, আইএস ইস্যুতে সিরিয়ার সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশ, কাশ্মীর ইস্যুতে ভারত-পাকিস্তান ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে পরাশক্তিদের অদৃশ্য হাত রয়েছে বিধায়ই সেখানে তা দীর্ঘদিনেও সমাধান আসছে না। প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না কাঙ্ক্ষিত শান্তি। তবে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য জাতিসংঘের আন্তরিকতার কোনো অভাব নেই।
যদিও জাতিসংঘ নামক সংস্থাটিও এসব পরাশক্তির দাপটের কাছে তার নিজস্ব সামর্থ্য দেখানোর সৌভাগ্য অনেক সময় দেখানো সম্ভব হয়ে ওঠে না। আর সেখানে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী পাঁচ সদস্যের তো অদ্ভুত ভেটো ক্ষমতা দেখানোর সুযোগ রয়েছেই। তার পরেও সে সংস্থাটি শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কিছু কাজ করে চলেছে। জাতিসংঘ অশান্ত দেশে কিংবা স্থানে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করার জন্য তার অধীনে একটি শান্তিরক্ষী বাহিনী সৃষ্টি করেছে। তার মাধ্যমে সেসব জায়গায় শান্তির জন্য কাজ করতে পারছে। অশান্তি নিরসন করে শান্তি তৈরির কার্যক্রমগুলোর মধ্যে রয়েছে অশান্তি সৃষ্টিকারীদের দমিয়ে রাখার জন্য সেসব সংস্থা দেশের বিভিন্ন অর্থনৈতিক ও সামরিক নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ করা, জাতিসংঘের অধীনে সেসব দেশে শান্তিরক্ষা মিশন পাঠিয়ে জনগণতে সহায়তা দেওয়া ইত্যাদি। বাংলাদেশ সব সময়ই এসব শান্তি উদ্যোগে তার সামর্থ্যের মধ্যে ব্যাপক ভূমিকা রেখে থাকে। তারই অংশ হিসেবে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সমস্যাসংকুল বিভিন্ন স্থানে সবচেয়ে বেশি শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠিয়ে সুনাম অর্জন করেছে। কিন্তু তারপরও পাকিস্তান, আফগানিস্তান, লিবিয়া সিরিয়ার মতো দেশ আবার অপরদিকে ইসরায়েলের মতো দেশ এখনো সন্ত্রাসী জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডের পরাশক্তির মদদ পেয়ে অশান্তি তৈরি করার চেষ্টা করছে।
আল-কায়েদা, আইএস হলো শান্তি বিঘ্নকারী সন্ত্রাসী-জঙ্গিদের সর্বশেষ সংস্করণ। বাংলাদেশেও ইদানীং কয়েকটি ঘটনা সেই অশান্তির ধারাকেই যেন প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। তবে বর্তমান সরকার এসব বিষয়ে একেবারে জিরো টলারেন্স নীতিতে রয়েছে। যে কারণে আস্তে আস্তে এদের মূলোৎটপাটন করে শান্তি প্রতিষ্ঠার দিকে যাচ্ছে। আজ ২১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের উদ্বোধনী পর্বে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে জঙ্গিবাদ দমন করে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্বারোপ করে বক্তব্য দেবেন। আর বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় আগে থেকেই বাংলাদেশের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের প্রশংসা করেছেন বিশ্বনেতারা। আর সেভাবেই জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্র বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মসূচির মাধ্যমে দিবসটি পালনে তাদের নিজেদের মতো করে ব্যবস্থা নিচ্ছে। কাজেই আজকের এ দিবস পালনের প্রত্যয় হোক বিশ্ব থেকে দারিদ্র্য-বোমা অপসারণ করে শান্তির পথে এগিয়ে যাওয়া।
লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়