অভিমত
তরুণদের ওপর ভরসা হারালে চলবে না

হঠাৎ করেই কী যেন হয়ে গেল দেশ থেকে। মানুষের ভেতরে সব সময় একটি চাপা আতঙ্ক। মুখে প্রকাশ করুক আর না করুক, ভেতরে ভেতরে সবাই আতঙ্কিত। চিরচেনা দেশটা কি এবার মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশের মতো হয়ে যাবে? এই দেশে আর কি নিরাপদে সম্প্রীতি বজায় রেখে চলাফেরা করা যাবে না? এর পরের টার্গেট কোথায়? কারা শিকার হবে বর্বরতার? এই দেশ তো জঙ্গিবাদের দেশ নয়। আত্মঘাতী হামলা চালানোর মতো এমন ভয়ানক কাজটি করবে এই বাংলার আবহাওয়ায় বেড়ে ওঠা কোনো মায়ের সন্তান? ভাবনারও অতীত এমনই কিছু নৃশংসতা ঘটে গেল বেশ কিছুদিন ধরে। গোটা বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ এখন মূর্তিমান আতঙ্ক, যার হাতে পড়ে হাজার বছরের সম্প্রীতির বাংলাদেশ যেন অস্থিমজ্জায় নড়ে উঠেছে।
সবচেয়ে হতাশার বিষয় যেটি, তা হলো এইসব ভয়ংকর জঙ্গিবাদী এ দেশেরই সন্তান। আমাদেরই চারপাশে বেড়ে ওঠা কারো ভাই, কারো ছেলে। সবার বয়স নিতান্তই কম, ২০ থেকে ২৫-এর মধ্যে সকলেই। কেউ এইসএসসি পাস, কেউ পড়েন বিশ্ববিদ্যালয়ে। যে সময়ে তাদের দুই চোখ ভরা স্বপ্ন থাকবে সোনার বাংলাদেশ গড়ার, তারাই নেমেছে বাংলাদেশকে ধ্বংস করতে। শতশত বছর ধরে ধর্মীয় সম্প্রীতির রীতিতে চলা এই মাটিকে বিশ্বের দরবারে হেয় করার এক ধ্বংসলীলায় মেতে উঠেছে কতিপয় পথভ্রষ্ট তরুণ, যাদের এখনই সমূলে উৎপাটিত করতে না পারলে চড়া মূল্য দিতে হবে এই জাতিকে। এরই মধ্যে জঙ্গিবাদের শিকড় এ মাটির বহু নিচে গেঁথে গেছে।
তবে আশার কথা হলো এই যে, নষ্টভ্রষ্ট এই বিপথগামী জঙ্গিরা সংখ্যায় খুবই নগণ্য। অন্তত দেশের কয়েক কোটি সাধারণ তারুণ্যের তুলনায় তারা নেহাতই হাতেগোনা। এখন সারা দেশের সব তরুণ একজোট হয়ে যদি সিদ্ধান্ত নেয় যে দেশে জঙ্গিবাদের কোনো ঠাঁই হবে না, তবে এ কাজ খুব বেশি কঠিন হওয়ার কথা নয়। লাখ লাখ তারুণ্যের প্রাণশক্তির কাছে গুটি কতক জঙ্গি-সন্ত্রাসী ফুৎকারেই উড়ে যাওয়ার কথা।
এরই মধ্যে গতকাল মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে সারা দেশের সব স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে একযোগে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল জঙ্গিবাদবিরোধী স্মরণকালের সবচেয়ে সাড়াজাগানো মানববন্ধন। দলে দলে ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে আবারও প্রমাণিত হলো আমরা একেবারে ডুবে যাইনি। প্রমাণিত হলো গুটিকতক পথভ্রষ্ট তরুণের হাতে জিম্মি হয়ে পড়বে না দেশ। যে তারুণ্য জেগেছে সারা দেশে, তারাই রুখে দেবে জঙ্গিবাদের ভ্রষ্টতা, ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবে সন্ত্রাসীদের আস্তানা। তরুণদের শুধু সঠিক পথে চালিত করতে হবে।
পাশাপাশি এটিও ভেবে দেখা দরকার যে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে কোনোভাবেই যেন সাধারণ, নিরপরাধ তরুণরা হেনস্তার শিকার না হন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিশ্চিত করতে হবে তাদের নিরাপত্তা। এই তরুণদের উল্লেখযোগ্য অংশই ছাত্র। কেউ কেউ সবেমাত্র চাকরিতে প্রবেশ করেছেন। এখনো সংসার হয়ে ওঠেনি অনেকেরই। থাকেন কোনো ভাড়া বাড়িতে একা অথবা বন্ধুদের সঙ্গে।
সাম্প্রতিক জঙ্গিবাদী কার্যক্রমে একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেছে, জঙ্গিরা সচরাচর ব্যাচেলর বাসা বা মেস বাসায় আস্তানা গেঁড়ে কার্যক্রম পরিচালিত করে। পুলিশের পক্ষ থেকে বাড়িওয়ালাদের ব্যাচেলর ভাড়া দেওয়ার ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে। বাড়িওয়ালারা অনেকেই ভীত হয়ে ব্যাচেলর ভাড়াটিয়া নামিয়ে দিচ্ছেন বা ব্যাচেলরদের ভাড়া দিতে চাইছেন না। এতে করে সবচেয়ে বিপদে পড়েছে তরুণ সমাজ। ঢাকা শহরে বাস করা তরুণদের উল্লেখযোগ্য অংশই বিভিন্ন বাসাবাড়ি বা মেসে ভাড়া থাকেন। তাঁদের জীবনে হঠাৎ করেই নেমে এসেছে চরম অস্থিরতা, সে সঙ্গে আতঙ্ক। বাড়িওয়ালারা ব্যাচেলর ভাড়া দিচ্ছেন না বা বাসা ছেড়ে দিতে বলছেন। নতুন বাসা পাওয়াও কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে তাঁদের জন্য। উপরন্তু যাঁদের সঙ্গে মেসে বা ভাড়া বাসায় থাকছেন, তাঁদের নিয়েও মনের ভেতরে দানা বাঁধছে ভীতি। কারণ, কে কিসের সঙ্গে জড়িত, সেটা নিশ্চিত হওয়া যায় না বাইরে থেকে কোনোভাবেই।
তার ওপর পুলিশি হয়রানি তো আছেই। পুলিশ যখনই কোনো ব্যাচেলর বাসায় বা মেসে তল্লাশি চালাচ্ছে, নির্বিচারে সেই মেসে থাকা সবাইকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। হয়তো প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে নিরপরাধদের ছেড়ে দিচ্ছে; কিন্তু আতঙ্কিত যতটুকু হওয়ার, তার মধ্যেই হওয়া সাড়া। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে অন্যায়ভাবে হেনস্তা করার। অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার বিষয়টিও সামনে আসে কখনো কখনো। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক এমন আচরণের শিকার হলে ব্যাচেলর ভাড়া থাকা তরুণরা আস্থা হারিয়ে ফেলবে তাদের ওপর, যেটা কোনোক্রমেই কাম্য নয়। বিপুল পরিমাণ এই তরুণ সমাজকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে সুফল ঘরে তোলা যাবে না; বরং তাঁদের পাশে নিলে একসঙ্গে খুব সহজেই জঙ্গিবাদের বিষফোড়া নির্মূলের পথ পাড়ি দেওয়া সম্ভব হবে বলে মনে করি।
যেকোনো পরিস্থিতিতেই তরুণদের ওপর ভরসা হারালে চলবে না। এই ২০-২৫ বছর বয়সী তারুণ্যই এ দেশে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করেছে একাত্তরে। সেই সময়ে যেটা করেছে, এখনো করবে। ঠিকঠাক ডাক দিলে তারা আবারও দেশ ও মাটির সম্মান রক্ষার্থে যেকোনো ঝুঁকি মাথা পেতে নেবে অবশ্যই। অন্তত গতকালকের দেশব্যাপী লাখ লাখ তারুণ্যের সফল মানববন্ধন তারই ইঙ্গিত দিয়েছে। এত বিপুল পরিমাণ তারুণ্য গুটিকয় পথভ্রষ্ট তরুণের অস্ত্রের কাছে জিম্মি হয়ে পড়বে? আমার অন্তত তা মনে হয় না।
তরুণদেরই কাজে লাগাতে হবে। ভরসা করতে হবে তাদের ওপর। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যথাযথ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি দেশের তরুণ সমাজ জেগে উঠলে কোনো জঙ্গিবাদীর ক্ষমতা নেই দেশকে অস্থিরতায় ঠেলে দেয়। তারুণ্যের শক্তিতেই এ দেশ থেকে জঙ্গিবাদ বিতাড়িত হবে।
দুর্জয় তারুণ্য জঙ্গিবাদ রুখবেই!
লেখক : শিক্ষক, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।