সন্ত্রাসী হামলা
প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ

সন্ত্রাসী হামলা যুগে যুগে দেশে দেশে ঘটেই চলেছে। আতঙ্কের বিষয় হলো এখানেই যে, আমরা যতই সভ্য হচ্ছি ততই যেন বর্বরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। একবিংশ শতাব্দী হলো জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার একটি উর্বর কর্মক্ষেত্র। বিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানের যেসব চমকপ্রদ আবিষ্কার সাফল্য লাভ করেছে সেগুলোই একবিংশ শতাব্দীতে এসে মানুষের কল্যাণে ব্যবহারের জন্য তাদের দোরগোড়ায় এসে কড়া নাড়ছে। সে রকম কিছু আবিষ্কারের মধ্যে রয়েছে রেডিও, টেলিভিশন, টেলিফোন, কম্পিউটার, মোবাইল ফোন প্রযুক্তি ইত্যাদি। এগুলোর কল্যাণে গোটা বিশ্ব এখন হাতের মুঠোয়। বিশ্ব এখন একটি গ্রামে পরিণত হয়েছে ইংরেজিতে যাকে গ্লোবাল ভিলেজ হিসেবে নামাঙ্কিত করা হয়। কিন্তু পৃথিবী যত ছোট হয়ে আসছে ততই যেন এর সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করে একটি শ্রেণি সেই শান্ত পৃথিবীতে অশান্ত করে তুলছে প্রায়ই। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন দেশে বা একটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রকম সন্ত্রাসী হামলা ঘটিয়ে থাকে। কখনো জাতিগত দাঙ্গা, নির্দিষ্ট শ্রেণি বা গোষ্ঠীগত দাঙ্গা, রাজনৈতিক দলের মধ্যকার দাঙ্গা, বিভিন্ন দল-উপদলে দাঙ্গা, বর্ণবাদী দাঙ্গা, আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক দাঙ্গা, দেশে-দেশে সীমান্ত দাঙ্গা, অভিবাসী হওয়া ও অভিবাসী ঠেকানোর জন্য দাঙ্গা- ইত্যাদি নিত্যনৈমিত্তক হিসেবে ঘটতে দেখা যায়। কিন্তু এসবের সাথে এখন যুক্ত হয়েছে ধর্মীয় দাঙ্গা।
এ দাঙ্গা খ্রিস্টানদের মধ্যে ক্যাথলিক-প্রটেস্ট্যান্ট, মুসলমানদের ইসলাম ধর্মে শিয়া-সুন্নি মতাবলম্বীদের মধ্যে অনেক আগে থেকেই চলে আসছিল। অপরদিকে ইহুদি-মুসলিম দাঙ্গা তো একেক সময় একেক মাত্রা ধারণ করে। এই ইহুদি-মুসলিম ধর্মীয় দাঙ্গাটি শুধু জাতিগত দাঙ্গায় থেমে না থেকে দুটি দেশের দাঙ্গায় পরিণত হয়েছে অনেক আগেই। আর ইহুদিদের মুসলিমদের ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে লাগিয়ে দিয়েছে উন্নত বিশ্বখ্যাত ইউরোপ-আমেরিকা। তার পিছনেও গভীর দূরভিসন্ধি কাজ করছিল। মুসলমানগণ যখন তাদের শান্তির ধর্মখ্যাত ইসলাম প্রচারে এগিয়ে যাচ্ছিল। নবীজির শিক্ষা অনুযায়ী শান্তির ধর্ম ইসলামকে প্রথাগতভাবে সবার আস্থার জায়গায় নিয়ে এসে এর তড়িৎ প্রচার ও প্রসারের প্রয়াস পাচ্ছিল, ঠিক সেই ভয়ে বিধর্মীরা তখন ইসলামকে থামানোর জন্য এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে দেয়। মুলমানদের পবিত্রভূমিতে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় তাই উগ্রপন্থী ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে চলছে তো চলছেই এ নতুন খেলা। যার অনিবার্য পরিণতিই আজকের আইএসসহ অন্যান্য উগ্র ধর্মীয় জঙ্গিগোষ্ঠী।
এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইসলাম ধর্ম। আর এটিই তো মূলত বিধর্মীদের কাজ এবং তাদের সফলতা। কারণ তারা তো মুসলমানদের শান্তির ধর্ম ইসলামকে বিতর্কিত করে এর আদর্শ থেকে মানুষকে পরিকল্পিতভাবে বিচ্যুত করতে চেয়েছিল, সেখানে তারা সফল হয়েছিল এবং এখনো সফল হয়ে যাচ্ছে। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার নীতি নিয়েছে বিধর্মীরা। সেখানে মুসলামানে মুসলমানে বিরোধ লাগিয়ে দিয়ে তারা মোড়লের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে সেই ছিল এদের উদ্দেশ্য। আমরাও আসলে প্রকারান্তরে তাদের পাতানো ফাঁদেই পা দিচ্ছি বারবার এবং নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছি। তারা তাদের প্রয়োজনে ইরাকে সাদ্দামের মতো নেতা তৈরি করে আবার তাদের শিষ্যত্ব বরণ না করলে তাদের খারাপ পরিণতি হয়। তেমনিভাবে আল-কায়েদার মতো সংগঠন তৈরি করে লাদেনের মতো জঙ্গি সৃষ্টি করে আবার যখন যুক্তরাষ্ট্র ৯/১১-এর মতো ঘটনার শিকার হয় তখন আবার তারাই লাদেনকে খতম করে দিয়েছে।
এসব আন্তর্জাতিক ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদের অংশ হিসেবেই আমাদের শান্তিপ্রিয় বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত জেএমবি, হিজবুত তাহরির, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ইত্যাদি বিভিন্ন নামে জঙ্গি ও সন্ত্রাসী সংগঠন গোপনে তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এরা বিগত এক-দুই দশকে দেশে অনেক নাশকতার মাধ্যমে নির্বিচারে অনেক নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে। তারই ধারাবাহিকতায় দেশকে ক্রমাগতভাবে একটি জঙ্গিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে প্রমাণের যে প্রচেষ্টা দীর্ঘদিন যাবৎ চালনো হচ্ছে তার সর্বশেষ ছোবল হলো পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিনে ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যবাহী শোলাকিয়া ঈদগাহ্ মাঠের নিকট পরিকল্পিতভাবে বোমা হামলা ও গোলাগুলি চালিয়ে নির্বিচারে মানষ খুন করা। এক মাস ইসলাম ধর্মের বিধানমতে সর্বোচ্চ ত্যাগ-তিতীক্ষার মাধ্যমে সংযম প্রদর্শনপূর্বক বহু আকাঙ্ক্ষিত খুশির ঈদ উদযাপনের জন্য যখন পুরো জাতি প্রস্তুতি নিচ্ছিল, এবং উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় ঈদগাহ্ ময়দানে যখন দূর-দূরান্ত থেকে আগত ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ তাদের অশেষ সওয়াব হাসিলের জন্য বৃহত্তম ঈদ জামাতে নামাজ আদায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, ঠিক তখনই সেই মাঠের অদূরে আজিমুদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের কাছে একদল সন্ত্রাসী বোমা হামলা চালায়।
সেখানে ঝলসে ও ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায় নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যদের শরীর। সেখানে বোমার আঘাতে ও স্প্রিন্টারে মারাত্মক আহত এক পুলিশসদস্য জহিরুল কিশোরগঞ্জ সদর আধুনিক জেনারেল হাসতাপাতালে মারা যান। সেখানে মারা যায় এক হামলাকারীও। পরে সন্ত্রাসীদের ধরার জন্য অভিযান চলাকালে পার্শ্ববর্তী ঝর্ণা রানী নামের এক গৃহবধূ নিহত হন সেখানে। আহত সাত পুলিশ সদস্যকে চিকিৎসার জন্য ময়মনসিংহ সিএমএইচে আনার পথে আনসারুল নামের আরেক পুলিশ সদস্য নিহত হন। আর বাকী ছয় পুলিশ সদস্যেকে আশঙ্কাজনকভাবে আরো উন্নত চিকিৎসার জন্য হেলিকপ্টারে ঢাকা সিএমএইচে স্থানান্তর করা হয়েছে। অর্থাৎ ঈদের খুশির দিনের এ হামলায় সেখানে দুই পুলিশ সদস্যসহ মোট চারজনের মৃত্যু হয়েছে- যা খুবই অনভিপ্রেত।
এরইমধ্যে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন পুলিশের মহাপরিদর্শকসহ ঊধ্বতন কর্মকর্তারা। তিনি এ ঘটনার জন্য জেএবিকে দায়ী করেছেন প্রাথমিকভাবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময়কালে আবারো হুঁশয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, সন্ত্রাসীদের কোনো ধর্ম নেই। ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলামের নামে যারা নামাজ আদায় না করে ধর্ম পালনরত অবস্থায় মানুষ খুন করে তাদের কোনো অবস্থাতেই ছাড় দেওয়া হবে না। পবিত্র ঈদের দিনে এ ধরনের ঘৃণ্য কাজে একদিকে একটু সাময়িক ভীতির সৃষ্টি হলেও সারা দেশে একে চরম ঘৃণার চোখে দেখা হচ্ছে। যেখানে লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মানুষের ঈদের জামাতে নামাজ আদায় তাদের পছন্দ হয় না, তারা নাকি কথিত ইসলাম প্রচারের জন্য অমুসলিম নিধন করছে। তাদের কাছ থেকে মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা, ইমাম, মুয়াজ্জিন, পুরোহিত, ফাদার, ধর্মযাজক, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, লেখক, ব্লগারসহ কোনো ধর্মের কোনো ধর্মগুরু এমনকি মুক্তচিন্তার কেউই রেহাই পাচ্ছেন না। এর সর্বশেষ সংযোজন হলো শোলাকিয়া মাঠের এ হামলা। অথচ এ মাঠের ঐতিহাসিক এবং ঐতিহ্যের জন্যই এখানে নামাজ আদায়ের জন্য প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষের সমাগম ঘটে থাকে।
তার আগে রাজধানী ঢাকার অভিজাত পাড়াখ্যাত গুলশানে ঘটেছে আরেক হৃদয় বিদারক ঘটনা। যে মুহূর্তে শান্তিপ্রিয় দেশবাসী এক মাস সিয়াম ও সংযম সাধন করে রোজা রাখার পর একটি সুন্দর ও পবিত্র কুরআন নাজিলের দিন লাইলাতুল ক্বদর এবং আসন্ন একটি আনন্দময় ঈদের প্রত্যাশা করছিল। অপরদিকে রাজধানী ঢাকার কর্মজীবী মানুষ এবার যখন নয়দিনের এক লম্বা ঈদ ছুটিতে ব্যস্ততম চিরচেনা রাজধানী ছেড়ে পরিবার-পরিজনের সাথে ঈদের খুশি ভাগাভাগি করতে গ্রাম-গ্রামান্তরে ছুটে যাচ্ছিল। ঠিক এমন একটি সময়ে বাংলাদেশের ইতিহাসের এক ঘৃণ্য জিম্মি কর্মকা- গোটা জাতিকে আরেকবার শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে রেখে দিয়েছিল। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক এলাকা গুলশান ২-এ অবস্থিত হলি আর্টিজান নামের একটি স্পেনিস রেস্টুরেন্ট। সেখানে দেশি বিদেশি অনেক ক্রেতা সন্ধ্যার পর রাতের খাবার খাওয়ার জন্য বসেছিল। সেখানে একদল বন্দুকধারী ও অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী সেই রেস্টুরেন্টে থাকা নিরীহ দেশি-বিদেশি মানুষদের জিম্মি করে রাখে। সেই অভিযানে বনানী থানার ওসি সালাহ উদ্দিন খান ও গুলশান জোনের ডিবি পুলিশের এসি রবিউল ইসলামসহ বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন এবং পরে হাসপাতালে মারাত্মকভাবে আহত বনানী থানার ওসি সালাহউদ্দিন খান ও গুলশান জোনের ডিবি পুলিশের এসি রবিউল ইসলাম- এ দুজনেই মৃত্যুবরণ করেন।
অবশেষে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী, পুলিশ, সোয়াত, বিজিবি, র্যাবসহ মিলিশিয়া ও প্যারামিলিশিয়া বাহিনীর একটি যৌথ বাহিনীর সম্মিলিত কমান্ডো অভিযান ‘অপারেশন থান্ডার বোল্ট’ পরিচালনা করে তিন বিদেশি নাগরিক, নারী ও শিশুসহ মোট ১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। সেখানে জিম্মি হওয়া সাধারণ ও নিরীহ ২০ জন নাগরিকের লাশ পাওয়া গেছে, যাদেরকে সন্ধ্যারাতেই হত্যা করা হয়েছে বলে পোস্টমর্টেম রিপোর্টে প্রকাশ পেয়েছে। সেখান থেকে ৬ জঙ্গির লাশ এবং এক জঙ্গিকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনা এটাই প্রথম, এর আগে কখনো এ রকম ঘটনার নজির নেই। কিন্তু গত বছর কোরবানি ঈদের আগে তাভেল্লা সিজার নামে এক ইটালিয়ান নাগরিক, ঈদের পরে হোসে কুনিও নামের এক জাপানি নাগরিককে হত্যা করে বিদেশিদের মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়েছিল। এরপর থেকে আজ এখানে তো কাল ওখানে একেরপর এক হত্যাকাণ্ড ঘটানো হচ্ছে।
দেখা গেছে, প্রত্যেকটি হত্যাকাণ্ড একই কায়দায় ঘটানো হচ্ছে। এদের কাছ থেকে মসজিদের ইমাম থেকে শুরু করে কোনো ধর্মশালার ধর্মগুরুই বাদ যাচ্ছেন না। তেমনি বাদ যাচ্ছেন না বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকও। আন্তর্জাতিকভাবে দেখতে গেলে, গত বছর ফ্রান্সের এক রেস্টুরেন্টে সন্ত্রাসী হামলায় দেড় শতাধিক মানুষ মেরে ফেলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের খোদ হোয়াইট হাউজের সামনে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে, সম্প্রতি সেখানে অন্যায়ভাবে কৃষ্ণাঙ্গ হত্যার প্রতিবাদকারী কয়েকজনকে হত্যা করা হয়েছে, জন্য হামলা হয়েছে সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশের বিমানবন্দরে, সেখানে মারা পড়েছে অর্ধশতাধিক। প্রতিক্ষেত্রেই আইএসের পক্ষ থেকে দায়িত্ব স্বীকার করে নেওয়া হয়। অন্যন্য দেশে আইএসের বিষয়টি পরিষ্কার, কিন্তু বাংলাদেশেও এগুলোর ক্ষেত্রে প্রতিবারই আইএসর নাম ব্যবহার করা হচ্ছে। অথচ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে জড়িত যাদের এখন পর্যন্ত ধরা হয়েছে তাদের কারো সাথেই আইএসের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। তাহলে এরা কারা?
কেনই বা শান্তিপ্রিয় নিরীহ বাঙালির ওপর দুদিন পরপর এমন বর্বরোচিত ঘৃণ্য ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। এভাবে কী ইসলাম প্রচার করা যায়? জিহাদের নামে এসব কী? নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা অবশ্য এগুলোর সাথে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের একটি যোগসূত্র স্থাপন করতে পেরেছেন। কারণ যখনই কোনো একটি যুদ্ধারাধীর বিচারের রায় কার্যকরের দ্বারপ্রান্তে এসে যায় তখনি ভিন্ন মাত্রায় নতুন ভয়াবহতায় আবার কোন না কোন কায়দায় তাদের অপতৎপরতা লক্ষ করা যায়। এবারো তার ব্যতিক্রম হয়নি বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। তবে এগুলো ঘটনার পরও বীর বাঙালি ও উৎসবপ্রিয় দেশবাসীর মধ্যে সাময়িক একটা আতঙ্ক কাজ করলেও ঈদের উৎসব থেকে তাদের নিভৃত রাখতে পারেনি। ঈদে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের পর্যটন ও বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে উপচেপড়া ভিড় লক্ষ করা গেছে। এ ক্ষেত্রে একটি বিষয় সামনে আনা দরকার যে, বাংলাদেশে কোনো ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের প্রতিরোধে জিরো টলারেন্স নীতি রয়েছে এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বিষয়ে নিজেই অনড় অবস্থানে রয়েছেন। গুলশান ও শোলাকিয়া দুটি ঘটনার পরই যাদের আহত কিংবা জঙ্গিকে শনাক্ত করা হয়েছে তাদের বেশির ভাগই ধনী ও উচ্চবিত্ত ঘরের দুলাল।
একটি ধারণা ছিল জঙ্গিবাদের সাথে শুধু নিম্নবিত্ত কিংবা মাদ্রসার ছাত্ররা জড়িত হয়, কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি পুরোপুরি উল্টো। আর আতঙ্ক এবং চিন্তার বিষয়টি এখানেই যে, আধুনিক ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিতরাও এর সাথে জড়িত হয়ে পড়ছে। এসব ক্ষেত্রে নর্থ সাউথ নামের ঢাকাস্থ একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যায়ের নাম জড়িয়ে যাচ্ছে বারবার। নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে নাকি নামাজঘরে ‘পাঠসভা’ নামে রীতিমতো জঙ্গিবাদের প্রশিক্ষণ চলে! কথিত আছে, এর আগে ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ও ব্লগার ইঞ্জিনিয়ার রাজীব হায়দারকে হত্যা করেছিল একই বিশ্বদ্যিালয়ের পাঁচ ছাত্র, যারা পুলিশ হেফাজতে স্বীকারোক্তি দিয়েছে বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। এবারের দুটি ঘটনার ক্ষেত্রেও নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইংরেজি মাধ্যমের স্কলাস্টিকা স্কুলের নাম এসেছে। এদের একটি উপসর্গ এ রকম যেকোনো একটি ঘটনার কমপক্ষে চার মাস আগে থেকে এরা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অবশ্য বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, পরিবারে দীর্ঘদিন যাবৎ যাদের যোগযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে, তাদের বিষয়ে শুধু একটি জিডি করেই ক্ষান্ত না হয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তাদের তথ্য দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
তার সূত্র ধরেই শোলাকিয়া মিশনে অংশ নেওয়া আবিরের বাবা ঈদের আগের দিন অর্থাৎ ৬ জুলাই ২০১৬ তারিখে তাঁর ছেলে হারানোর জিডি করেছিলেন। গত কয়েকদিনে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় প্রায় ৭৭টি হারানো সন্তানের ডিডি করা হয়েছে বলে গণমাধ্যমে প্রকাশ যা খুবই উদ্বেগজনক। গুলশানের ঘটনার পর নিহত জঙ্গি ইশতিয়াকের বাবা এবং শোলাকিয়ার ঘটনার পর নিহত আবিরের বাবা তাদের শনাক্ত করে সন্তানদের এ ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন এবং ব্যর্থ বাবা হিসেবে দেশবাসীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। কিন্তু কথা হলো তাতেই কী দায় শেষ হয়ে গেল? এসব প্রতিরোধ করার জন্য সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মিলিত ঐক্য প্রয়োজন। পাশাপাশি একাত্তরের মতো দেশের সব নাগরিককে আবারো একতাবদ্ধ হয়ে এ সন্ত্রাস নির্মূলে ব্রতী হতে হবে। আর তরুণ সমাজের ভিতর যাতে জঙ্গিবাদের বিষবাষ্প এভাবে ছড়াতে না পারে এবং তাদের ব্রেইন ওয়াশ করতে না পারে সেজন্য সারা দেশে বিভিন্ন মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডসহ সব ধর্মীয় উপাসনালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাদের মোটিভেশন দিতে হবে। আর যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম এগুলোর সাথে জড়িয়ে গেছে সেগুলোকে কড়া নজরদারির আওতায় নিয়ে আসতে হবে। আমরা জানি পরিবারই হলো সভ্যতার ও সমাজের সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম আদি ইউনিট। কাজেই প্রত্যেকটি পরিবারকে তাদের সন্তানের প্রতিটি কাজের ও কর্মকাণ্ডের নজরদারি করতে হবে। তাদের সময় দিতে হবে। তাহলে কাউকেই হয়তো আর ইশতিয়াক কিংবা আবিরের বাবার মতো হাতজোড় করে দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাওয়ার প্রয়োজন হবে না এবং তাদের শিকার হয়ে নিরীহ মানুষকে প্রাণ দিতে হবে না।
লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়