অভিমত
খুনিদের লক্ষ্য আসলে কী?

সাম্প্রতিক গুপ্তহত্যা বা টার্গেট হত্যা নিয়ে দেশের মানুষের মধ্যে এক অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছে। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বাইরের দেশের সংগঠনসহ এই গুপ্তহত্যার বিরুদ্ধে খোদ জাতিসংঘের বিবৃতিও আমরা লক্ষ করেছি। কিন্তু বরাবরই গুপ্তহত্যাকারীরা থেকে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। টার্গেট হত্যার মিশনে মাঠ পর্যায়ের কিছু সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করা হলেও মূল পরিকল্পনাকারীদের এখনো শনাক্ত করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আর এই হত্যার পর কথিত বার্তা পাঠিয়ে জঙ্গি সম্পৃক্ততার কথা জানান দিয়ে হত্যার নেপথ্য উদ্দেশ্য অন্যদিকে পরিচালিত করাও একটা সংস্কৃতিতে পরিণত করেছে।
কিন্তু এখন পর্যন্ত পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুকে টার্গেট কিলিংয়ের পর কথিত বার্তা দিয়ে এ গুপ্ত হত্যাকাণ্ডের দায় কেউ স্বীকার করেনি। অন্যদিকে একই কায়দায় মোটরসাইকেলযোগে তিনজন ব্যক্তির সমন্বয়ে ঝিনাইদহের সদর উপজেলায় পুরোহিত আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলীকে হত্যা করে সেই ধারাবাহিক সংস্কৃতিতে রূপ নেওয়া কথিত বার্তা পাঠিয়ে হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে দুর্বৃত্তরা।
বাংলাদেশে আইএস, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, আল-কায়েদার ভারতীয় শাখা বা এ ধরনের কোনো জঙ্গি সংগঠন আছে কি-না, তা প্রশাসনযন্ত্র এ ব্যাপারে তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে পরিষ্কার বলতে পারবে। তবে এ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের আলোকে সাধারণ জনগণের মধ্যে রীতিমতো এক আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে, এটা এখন আর লুকানোর বিষয় নয়।
আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো একটু পর্যবেক্ষণ করলে এই আতঙ্ক একেবারেই উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ আছে বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি না।
তথাকথিত মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে অনেককেই দেখেছি, প্রত্যেকটা হত্যার পর কতিপয় মানুষ ওই হত্যাকে জায়েজ করার জন্য ইনিয়ে-বিনিয়ে খুন হওয়া লোকের অতীত নিয়ে শুরু করে কথা চালাচালি। ফেসবুকে কখন কোন স্ট্যাটাস দিয়েছে, কখন কোন লেখায় ধর্মানুভূতিতে আঘাত দিয়েছে কিংবা কার বিতর্কিত লেখায় লাইক-কমেন্ট করেছে, তা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বের করে নানান রঙে রাঙিয়ে গুপ্তহত্যাকারীদের পক্ষে এক ধরনের মৌন সমর্থন দিয়েছিল। আর যদি ব্লগার-লেখক হয়, তাহলে তো কথাই নেই! শুরু হয় কতিপয় মিডিয়ার সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়ার যোগসাজশে রং ছড়াছড়ি।
পাঠক, শুধু একটু অন্য রকম দেখা যাচ্ছে এসপিপত্নী মিতু হত্যাকাণ্ডটি। প্রচারমাধ্যমের সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়াও বেশ সতর্ক। সতর্ক কথিত বার্তা প্রেরণকারী ইন্টেলিজেন্স সাইটও। হত্যার দায় স্বীকার না করে বরং আল-কায়েদা ভারতীয় উপমহাদেশ (একিউআইএস) শাখা পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যায় জঙ্গিদের দায়ী করায় নিন্দা জানিয়ে একিউআইএস তাদের বিবৃতি দিয়ে বলেন, এ হত্যাকাণ্ড ইসলামে ‘অনুমোদনযোগ্য নয়’।
এখানে একটু লক্ষ করলে আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে, জঙ্গি দমনে দেশজুড়ে পুলিশি সাঁড়াশি অভিযান কতটুকু যৌক্তিক, তা এই অভিযানের একদিনের মাথায় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওয়েবসাইটটির এই বিবৃতিটি উল্লেখযোগ্য!
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ নাট্য থিয়েটারকর্মী সোহাগী জাহান তনু হত্যার পরও কথিত আইএসের বার্তা না এলেও তনুর চরিত্র হননে উঠেপড়ে লেগেছিল কতিপয় অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট। ব্যাঙের ছাতার মতন গজানো কতিপয় অনলাইন মিডিয়াও সোশ্যাল মিডিয়ার সঙ্গে গা ভাসিয়ে রমরমা সংবাদ পরিবেশন করে তাদের ভিউয়ার বাড়াতে দেরি করেনি। অন্যপক্ষও খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে বের করার চেষ্টা করেছে তনুর চরিত্রের উল্টো দিক প্রকাশ করে হত্যাকাণ্ড জায়েজ করা যায় কি না।
যখন তথাকথিত মিডিয়া, কিছু অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট বা ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে যখন রাষ্ট্রযন্ত্রের দায়িত্ববান ব্যক্তিদের বক্তব্য-বিবৃতি মিলে যায়, তখন দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে অসহায়ত্ববোধ জন্ম নেয়। রাষ্ট্রযন্ত্র তখন বিতর্কিত হয়। প্রশ্নবিদ্ধ হয় প্রশাসনযন্ত্রের কর্তাব্যক্তিদের কর্মদক্ষতা আর সন্দেহ তৈরি হয় তাদের কাজের আন্তরিকতার ওপর।
আমরা দেখেছি, যাঁরা ব্লগে লেখেন না বা ব্লগ সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণাও নেই, এ রকম অসংখ্য ব্যক্তিকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছিল দেশের প্রখ্যাত ব্যক্তিদেরও। রাজশাহীতে শিক্ষককে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছিল। কুড়িগ্রামে মুক্তিযোদ্ধা হোসেন আলীকে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছিল। পুরোহিতকে হত্যা করা হয়েছিল। যদিও তাঁদের কোনো ব্লগে কোনো অ্যাকাউন্ট নেই বা আমার জানামতে তাঁরা কোনো ব্লগে লেখেন না। এমনকি পুলিশ অফিসারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুও কোনো ব্লগে লিখতেন বলে এই পর্যন্ত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তথ্য পাওয়া যায়নি যারা খুন হয়েছে, তারা কখনো কোনো ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করেছে বা করতে সহায়তা দিয়েছে।
পাঠক, এখানে একেবারেই স্পষ্ট বোঝা যায়, মুক্তমনা লেখক, অধ্যাপক, ব্লগার, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ধর্মীয় নেতা, ভিন্ন মতাবলম্বী কিংবা মিতুকে হত্যা করার জন্য একটা ভ্রান্ত বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন। আর সেটাই তারা ধর্মীয় অনুভূতি মিশ্রিত করে এই ধরনের গুপ্তহত্যাকে জায়েজ করার লক্ষ্যে সমাজ ও রাষ্ট্রের দুর্বল লোকের সামনে উদ্ভট সংস্কৃতি প্রচলন করার ষড়যন্ত্র করছে। তাদের মূল সমস্যা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। ’৭১-এর মতো মেধাবীদের তালিকা তৈরি করে দেশকে মেধাশূন্য করার নীলনকশা করতে চায় তারা, যা এরই মধ্যে পরিস্থিতি উপলব্ধি করে তিন দেশ সফর শেষে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও চেতনাবোধ জাগানোর কথা বলেছেন।
গত ৭ আগস্ট, ২০১৫ ঢাকায় ঘরের ভেতর ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয়কে হত্যার পর আইনশৃঙ্খলা নিয়ে নানাবিধ সমালোচনার মুখে এই কথাগুলো যখন রাষ্ট্রযন্ত্রের দায়িত্ববান কর্তাব্যক্তিদের মুখ থেকে প্রকাশ পায়, তখন দেশের সাধারণ জনগণ সত্যিই অসহায় হয়ে পড়ে। আর অন্যদিকে উৎসাহ পায় অপরাধীরা, সংগঠিত অপরাধ অব্যাহত রাখে।
ব্লগার নীলয়ের ফেসবুক থেকে জানতে পেরেছি, একের পর এক ব্লগার খুন হওয়ার পর নিজের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা থেকে থানায় জিডি করতে গেলে কর্তব্যরত পুলিশ কর্মকর্তা সাধারণ ডায়েরি না নিয়ে বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয়কে। আর এর সত্যতাও আমি উপলব্ধি করতে পেরেছি খুন হওয়ার পর নিলয়ের বাসায় গিয়ে।
বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর পুলিশপ্রধানসহ পুলিশের প্রতিটি সদস্য আমার-আপনার-আমাদের কারো না কারো ভাই-বোন-বন্ধু। গত বছর হরতাল-অবরোধের নামে যখন পুলিশ সদস্যের মাথা থেঁতলে দিয়েছিল, যখন কুমিল্লায় বিজিবি সদস্যকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল, তখন আমরা যাঁরা কলমসৈনিক-সাংবাদিক, ব্লগার-লেখক মিডিয়ায় ও সোশ্যাল মিডিয়াতে তার তীব্র নিন্দা জানিয়েছিলাম। নতুন প্রজন্মকে পুলিশের পাশে ভাই-বন্ধুর মতন পাশে থাকার আহ্বান করেছিলাম।
অথচ, ঢাকা শাহবাগ আজিজ সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলায় জাগৃতি প্রকাশনীর ফয়সল আরেফিন দীপনকে উপুড় করে কুপিয়ে হত্যার প্রায় আড়াই ঘণ্টার বেশি সময় পরে সিআইডির কর্মকর্তাদের উপস্থিতি দেখে শুধু আমিই নই, খোদ অন্য ইউনিটের সিনিয়র অফিসার রীতিমতো দেরি হওয়ার কারণ জানতে ক্ষোভের সঙ্গে প্রশ্ন করেন। সেদিনও সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলার সময় ব্লগার-লেখকদের নিয়ে নেতিবাচক কথা শুনেছি।
২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করে এই লেখাটি পর্যন্ত প্রায় ১৭ জন ব্যক্তিকে ধর্মীয় মতবাদের বিরোধের সূত্র ধরে হত্যা করা হয়েছে। খুনের ধরন, হত্যার শিকার ব্যক্তিদের জীবনাদর্শ এবং দায় স্বীকার করে বার্তা দেওয়ার খবরের তথ্য যাচাই করে এসব হত্যাকাণ্ডের মধ্যে মিল খুঁজে পেয়েছে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
এদিকে এসপিপত্নী মিতু হত্যার ধরন এক হলেও ঠিক কোন মতবাদ বা জীবনাদর্শ কিংবা কোন সীমা লঙ্ঘনের অপরাধ থেকে এ গুপ্তহত্যা করেছিল, তা এখনো পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। তবে বাবুল আক্তার সিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার থাকাকালে জঙ্গিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অভিযান, জঙ্গিদের বিরুদ্ধে বাবুল আক্তারের সাহসী অ্যাকশন ছিল উল্লেখযোগ্য। ধারণা করা হয়, এ কারণেই টার্গেটে পরিণত হন বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু। আর এই হত্যাকাণ্ডেও জঙ্গিদের সম্পৃক্তার তথ্য খুঁজে পেয়েছে প্রশাসন।
বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যার পর রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন ইউনিট এই হত্যাকাণ্ডটির ব্যাপারে গুরুত্বের সঙ্গে যেভাবে তৎপর রয়েছে, তা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। কিন্তু এই তৎপরতা যদি আরো আগে গ্রহণ করা যেত, তাহলে একের পর এক হত্যার মধ্য দিয়ে এ ধরনের হত্যার সংস্কৃতি বাংলাদেশে গড়ে উঠত না।
এখানে সরকার ও সরকারের পরিচালিত রাষ্ট্রযন্ত্রের কর্তাব্যক্তিদের উচিত হবে মূল সমস্যা চিহ্নিত করা এবং সে অনুযায়ী তাদের পরিচালিত অ্যাকশন অব্যাহত রাখা। যদিও শুধু পুলিশ বাহিনী বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্বারা রাজনৈতিক জঙ্গি তৎপরতা বন্ধ করা সম্ভব হলেও ধর্মীয় জঙ্গিবাদ একেবারেই বন্ধ করা ততটা সহজ হবে না। কারণ, ধর্মীয় জঙ্গিবাদ সৃষ্টি হয় বিশ্বাসগত বিষয় থেকে। কারণ, তারা সমাজের বিভিন্ন অনুষঙ্গ থেকে সৃষ্টি। এখানে দেশের মানুষের সচেতনতার পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে একটা বোঝাপড়া থাকা প্রয়োজন। যা সব রাজনীতিবিদের উচিত হবে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদকে আশ্রয়-প্রশ্রয় না দেওয়া এবং সর্বোপরি সামাজিক-অর্থনৈতিকভাবে বয়কটের মাধ্যমে কোণঠাসা করে রাখা।
লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম (বোয়াফ)