দৃষ্টিপাত
ভেজাল ওষুধ মানুষ হত্যার শামিল

ভেজাল এখন কিসে নেই, সেটা আর হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে ওষুধে ভেজাল, এটা চিন্তা করতেই গা শিউরে ওঠে। তার মানে হলো, মরেও শান্তি নেই কিংবা ঠিকমতো মরতেও দেওয়া হবে না ইত্যাদি, ইত্যাদি। এসবে ভেজাল দিয়ে আসছে দীর্ঘদিন থেকে, তা আমরা শুনে আসছি। কিন্তু সম্প্রতি বিষয়টি আবার মিডিয়ায় হেডলাইন হয়েছে। বেশ কয়েক দিন ধরে লক্ষ করা যাচ্ছে, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় এ-সংক্রান্ত কিছু প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে। কারণ, ভেজাল ওষুধে বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। জুন-২০১৬ মাসের প্রথম দিকে দেশের বেশ কিছু পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, দেশের বাজারে নকল ও ভেজাল ওষুধের দৌরাত্ম্যের খবর। দেদার তৈরি ও বিক্রি হচ্ছে নকল-ভেজাল ওষুধ, আর প্রতারিত ও বিপদগ্রস্ত হচ্ছেন ভোক্তারা।
দেশের চাল-ডাল, আটা-ময়দা, ফলমূল থেকে শুরু করে এমন কোনো পণ্য নেই, যাতে ভেজাল দেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু ওষুধে ভেজাল বিশেষভাবে গুরুত্ব দাবি করে। কারণ, মানসম্পন্ন ওষুধ যেমন মানুষের জীবন রক্ষা করতে পারে, তেমনি মানহীন ওষুধ স্বাস্থ্যহানি, এমনকি জীবননাশের কারণও হতে পারে। ধরা যাক, একজন রোগী মুমূর্ষু অবস্থায় কোনো কঠিন রোগে অজ্ঞান হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ডাক্তার প্রথমেই সেই রোগীকে সাধারণত জ্ঞান ফেরানোসহ ভালো করার সর্বশেষ চেষ্টা করতে গিয়ে জীবন রক্ষাকারী (সেভ আওয়ার সোলস—এসওএস) ওষুধ হিসেবে স্টেরয়েড জাতীয় ইনজেকশন পুশ করে থাকেন। সেই ওষুধে অনেক সময় রোগীর মিরাকল হিসেবে জ্ঞান ফিরতে দেখা যায়। কিন্তু সেই ওষুধটি যদি নকল কিংবা ভেজাল হয়, তবে কী অবস্থা হতে পারে তা সবাই একটু ভেবে দেখুন। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাই। কাজেই ওষুধের মান সংরক্ষণ অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
অন্য খাদ্যপণ্যের মতো ওষুধের গুণমান ভোক্তাদের নিজেদের পক্ষে যাচাই করা সম্ভব হয় না। এ কাজটির জন্য প্রয়োজন হলো প্রাতিষ্ঠানিক তদারকি। এখানে একটি উদ্বেগজনক ব্যাপার হলো, ওষুধের বাজারে নকল-ভেজাল রোধে আমাদের দেশে প্রাতিষ্ঠানিক তৎপরতা নেই বললেই চলে, নতুবা থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারে অপর্যাপ্ত। সেখানে কি লাইসেন্সধারী, কি ভুয়া কোম্পানি—সবাই একই রকম কাজ করে। সম্প্রতি স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি কর্তৃক ২০১৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঔষধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ড. আ ব ম ফারুকের নেতৃত্বে গঠিত পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি ৮৪টি ওষুধ কারখানা সরেজমিনে পরিদর্শনপূর্বক এর বিভিন্ন ধাপ পর্যবেক্ষণ করে একটি প্রতিবেদন প্রদান করে। সেখানে মানহীন, নিম্নমানের ও ভেজাল ওষুধ প্রস্তুতের জন্য ২০টি কোম্পানিকে সিলগালা মেরে বন্ধ করে দেওয়ার প্রস্তব করা হয়। আরো ১৪টি ওষুধ কোম্পানিকে তাদের অ্যান্টিবায়োটিক উৎপাদন না করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়। তদানুযায়ী সরকার থেকে আদেশও জারি করা হয়। পরবর্তী সময়ে এসব ওষুধ কোম্পানির মালিকদের পক্ষ থেকে সরকারি আদেশ বন্ধের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করা হয়। কিন্তু ‘হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ’ জনস্বার্থে আপিল করলে সরকারি আদেশই বহাল থাকে। অর্থাৎ এখন হাইকোর্টে রায় অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট কারখানাগুলো সাত দিনের মধ্যে বন্ধ করার নির্দেশনা রয়েছে।
কোন কোন কারখানার ওষুধ বন্ধ করেছে, তা জনসাধারণকে জানানো উচিত। তা না হলে তাদের উৎপাদিত সেসব নিম্নমানের এবং ভেজাল ওষুধ আবার ব্যবহার করে ক্ষতিগ্রস্ত হবে জনগণ। যে ২০টি কারখানা সিলগালা করে দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, সেগুলো হলো—এক্সিম, এভার্ট, বিকল্প, ডলফিন, ড্রাগল্যান্ড, গ্লোব ল্যাবরেটরিজ, জরপা, কাফমা, মেডিকো, ন্যাশনাল ড্রাগ, নর্থ বেঙ্গল, রিমো, রিদ, স্কাইল্যাব, স্পার্ক, স্টার, সুনিপুণ, টুডে ফার্মাসিউটিক্যালস, ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইউনিভার্সেল ফার্মাসিউটিক্যালস। এ ছাড়া ১৪ কোম্পানির পেনিসিলিন, নন-পেনিসিলিন ও সেফালোস্পোরিন গোত্রের অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ উৎপাদন করতে পারবে না। এরা হলো—আদ-দ্বীন, আলকাদ, বেলসেন, বেঙ্গল ড্রাগস, ব্রিস্টল ফার্মা, ক্রিস্টাল, ইন্দো-বাংলা, মিল্লাত, এমএসটি ফার্মা, অরবিট, ফার্মিক, পনিক্স, রাসা ও সেভ ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি ইত্যাদি। একটু ভালোভাবে লক্ষ করলেই দেখা যাবে, এসব তালিকায় অনেক নামীদামি কোম্পানিও রয়েছে।
দেশের একটি বেসরকারি সংস্থার তথ্যমতে, বাংলাদেশের বাজারে শতকরা ১০ ভাগ নকল-ভেজাল ওষুধ বিক্রি করা হয়। আর এসবের বেশির ভাগ উৎপাদন ও বিক্রি হয় ঢাকার মিটফোর্ড এলাকায় একেবারে প্রশাসনের নাকের ডগায়। বেশি চাপাচাপি করলে বলা হয় ঔষধ প্রশাসনে জনবলের অভাব। অথচ অভিযোগ রয়েছে, ঔষধ প্রশাসনের লোকজনের যোগসাজশেই নাকি এসব কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়ে থাকে। ঔষধ প্রশাসনের তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ কারখানার সংখ্যা ২৮১টি, ইউনানির সংখ্যা ২৬৬টি, আয়ুর্বেদিক ২০৭টি, হোমিওপ্যাথিক ৭৯টি এবং হারবাল ৩২টি। তবে এগুলো কোম্পানির ওষুধ উৎপাদন ও বিপণনের সময় ঔষধ প্রশাসন কর্তৃক ম্যাজিস্ট্রেট ও প্রয়োজনীয় ব্যক্তিদের দ্বারা প্রায়ই অভিযান পরিচালনা করা হলেও তা বন্ধ করা যাচ্ছে না, যা খুবই উদ্বেগজনক।
সংশ্লিষ্টদের মতে, এই খাতে দুর্নীতি, আইন প্রয়োগে শৈথিল্য, প্রশাসনের নজরদারির অভাব, দুর্বল বিচারব্যবস্থা, প্রযুক্তিগত অসমর্থতা, দক্ষ প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব ইত্যাদি ভেজাল ওষুধ বাজারজাতকরণ রোধ করতে না পারার প্রধান কারণ। কিন্তু ওষুধের বাজার ভেজালমুক্তকরণ খুবই জরুরি। এর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিশেষ তৎপরতা প্রয়োজন। ওষুধের বাজার ও বাজার মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা জোরদারকরণ, প্রচলিত আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা, প্রয়োজনে বর্তমান আইনকে আরো কঠোর করতে হবে, ওষুধ প্রশাসনকে বাড়তি জনবল দিয়ে ঢেলে সাজাতে হবে, সর্বোপরি জনস্বার্থে নকল-ভেজাল ওষুধ উৎপাদক ও বিক্রেতাদের সিন্ডিকেট ভাঙার জন্য সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার। এ চক্র যত ক্ষমতাবানই হোক না কেন, তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। তাহলেই দেশের জনগণকে রক্ষা করা যাবে।
লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়