আগত ভয়, অনাগত সংকট

২৩ এপ্রিল, সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস ধরবেন বলে বাসা থেকে বের হন অধ্যাপক এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকী। কিন্তু বাসা থেকে ১০০ গজ যেতেই তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। রেজাউল করিমকে যেখানে খুন করা হয়, সেখান থেকে তিন-চারটা ঘর পরেই শালবাগান বাজারের বটগাছ, ওখানেই বাস দাঁড়িয়ে থাকত। অর্থাৎ যেখানে খুন করা হয়েছে সেটি যেমন আবাসিক এলাকা, তেমনি বাজারেরও অংশ। আর সেখানে সকাল সাড়ে ৭টা মানে অল্প-বিস্তর হলেও মানুষের আনাগোনা থাকাটাই স্বাভাবিক।
অন্যদিকে পরিবারের সদস্যদের ভাষ্যমতে, রেজাউল করিমকে বিদায় দিয়ে মাত্র ঘরে এসেছে, এরই মধ্যে কেউ একজন ছুটে এসে জানায় তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। হয়তো হত্যাকাণ্ডটি কেউ না কেউ দেখেছে, যার জন্য তাঁর পরিবার এত দ্রুত সংবাদ পেয়েছে। একজন সংবাদকর্মী হিসেবে প্রত্যক্ষদর্শী খোঁজার চেষ্টা করলাম। কিন্তু যার সঙ্গে কথা বলি সেই বলে চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে পরে সবাই এসেছে। তাহলে প্রথম চিৎকারটা দিল কে?
যে বাসার সামনে খুন হয়েছে, সেই বাসার মালিক বলেন, তিনি শব্দ শুনেছেন। কিন্তু বাজার হওয়ায় ওই রকম শব্দ প্রায়ই শোনেন। তাই বের হননি।
পাশের ঘরের অন্য এক মহিলার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি সকাল ৭টায় ছোট ছেলেকে স্কুলে দিয়ে এসেছেন, ৮টায় মেয়েকে নিয়ে স্কুলে যাবেন। প্রস্তুত হচ্ছিলেন, এমন সময় অনেক চেঁচামেচি এক মহিলার ‘কে কে’ শব্দ শুনে বাইরে বের হন। ততক্ষণে খুনিরা চলে গেছে। ‘কে কে’ বলে চিৎকার করা মহিলার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনিও বলেন খুনিদের দেখেননি।
এরপর যখন শূন্য হাতে ফিরে আসব, ওই সময় কথা হচ্ছিল স্থানীয় এক লোকের সঙ্গে। আমার সঙ্গে কথা বলতে দেখে স্থানীয় অন্য এক লোক এসে ওই লোককে বলল, ‘দেখতেছিস না দেশের অবস্থা কী, এত কথা বলিস কেন? আয়।’ এই বলে নিয়ে গেল।
এতগুলো কথা বলা, কে দেখেছে কে দেখেনি সেটা প্রমাণ করার জন্য নয়। বলছি, সাধারণ মানুষের ভয়ের কথা, তারা কেউ কোনো কথা বলছে না। একটা মানুষ সাত-সকালে খুন হয়ে গেল এ নিয়ে টু শব্দটি কেউ বলতে রাজি না! তার মানে, আপনি-আমি খুন হলে, কেউ দেখে থাকলেও কোনো কথা বলবে না! এ থেকে বোঝা যায়, মানুষের জানমালের নিরাপত্তা দেবে বলে যে রাষ্ট্র ও তার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সর্বসাধারণের কাছে দায়বদ্ধ, সেই প্রতিষ্ঠানটির ওপর এই হলো মানুষের আস্থার নমুনা!
অবশ্য রাষ্ট্রের সূচনালগ্ন থেকেই যদি এর চরিত্র বোঝার চেষ্টা করা হয়, দেখা যাবে, এটি নিজে খুনখারাবি করে কিংবা খুনখারাবিকে সমর্থন করে সাধারণের মধ্যে ভয় ঢুকিয়ে রাখতেই কাজ করে। তাই সাধারণ মানুষ যখন ভয়ে রেজাউল করিমের হত্যা নিয়ে কোনো কথা বলে না, তখন রাষ্ট্র তার জায়গা থেকে সফল। এই সফলতা বৃহৎ আকারে ধরা দেয়, এই শিক্ষক হত্যার আগে-পরে একই কায়দায় ধারাবাহিকভাবে খুন করা হয়েছে ব্লগার লেখক প্রকাশক শিক্ষক বিদেশি হিন্দু মুসলিম দর্জিসহ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ। অর্থাৎ এ দেশে বসবাসকারী সর্বস্তরের জনগণ এখন ভয়ের মুখে, যেকোনো সময় যে কেউ খুন হয়ে যেতে পারেন। তাই মোটাদাগে সবাই চুপ!
২.
এখন প্রশ্ন, রাষ্ট্রের হর্তাকর্তারা এসব হত্যাকাণ্ডের কোনো সুরাহায় যাচ্ছে না কেন? একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার সারা বিশ্বেই নিজেকে ‘জঙ্গি’বিরোধী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। আর বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে ‘জঙ্গিবাদের’ পক্ষের শক্তি হিসেবে তকমা লাগিয়ে দিয়েছে। তাই যতই খুনখারাবি হোক না কেন, তাতে বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের বিশেষ কোনো ক্ষতি নেই। বরং বর্তমান সরকার যেহেতু ‘জঙ্গি’বিরোধী আর হত্যাগুলো করছে ‘জঙ্গি’ সংগঠনগুলো, সে জন্য এই সরকারেরই ক্ষমতায় থাকা দরকার -এমন ধারণা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।
তাই বর্তমান সরকারের তুরুপের তাস এখন ‘জঙ্গি’। আর যদি তাই না হতো, সরকার হত্যাকাণ্ডগুলোর পেছনে কারা জড়িত, কারা করছে তা তথ্য-প্রমাণসহ জনগণের সামনে হাজির করত। প্রমাণসহ বলত, এই খুনটা জঙ্গিরা করেছে কিংবা অমুক গোষ্ঠী করেছে। কিন্তু তা তো দেখা যায়ই না, বরং এতগুলো হত্যার ঘটনা ঘটল তার একটিরও ভালোভাবে আজ পর্যন্ত বিচারই শুরু হয়নি। এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, এই ঘরানার যেকোনো হত্যাকাণ্ড হলেই সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বলতে দেখা যায়, এই হত্যার সঙ্গে ব্লগার বা অমুক-তমুক (যেসব হত্যাকাণ্ডে দায় জঙ্গিরা স্বীকার করে) হত্যার মিল রয়েছে। আর মিডিয়াগুলো ঢাক-ঢোল পিটিয়ে তার প্রচার শুরু করে দেয়। তদন্তের অগ্রগতি বলতেও ওইটুকুই। তাই সরকারের আলাদা করে বলার প্রয়োজন পড়ে না, এই হত্যার সঙ্গে ‘জঙ্গিরা’ জড়িত।
৩.
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, বিশ্বের হর্তাকর্তারা কি বর্তমান সরকারের ‘জঙ্গি’ প্যাকেজ বোঝে না? হয়তো বলতে হবে, নিশ্চয় বোঝে। বোঝে বলেই তা আরো সুষ্ঠুভাবে যেন এই রাজনীতি চলতে পারে সে জন্য এদেশে যে ‘জঙ্গি’ আছে তা খতিয়ে দেখছে যুক্তরাষ্ট্র। তাই বর্তমান সরকারকে তারা সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যাদের ‘জঙ্গি’, ‘সন্ত্রাস’ দমনে সাহায্য করে সেসব দেশের কী অবস্থা হয় তা হয়তো অনেক পাঠকেরই জানা আছে। পাকিস্তান, আফগানিস্তান, সিরিয়া, লিবিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ এর ভালো উদাহরণ।
হয়তো কথা উঠতে পারে, বাংলাদেশ তো মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকার মতো অত খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ না। তাহলে তাদের এ সাহায্য না নেওয়ার কী আছে? এ ক্ষেত্রে হয়তো বলতে হবে, এ দেশের ভৌগোলিক অবস্থানটা ভুলে যাওয়া উচিত হবে না। বর্তমানে পরাক্রমশালী পুঁজিপতি হয়ে ওঠা চীন, ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মধ্যাঞ্চল বাংলাদেশ। এই অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হলে সবার আগে বাংলাদেশে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা দরকার।
৪.
আলোচনার এ পর্যায়ে এসে বলতে হয়, বাংলাদেশ যে অনাগত সংকটের দিকে ধাবিত হচ্ছে তা থেকে উত্তরণ পেতে হলে ভয়ের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে জনগণকেই এগিয়ে আসতে হবে। আর সেজন্য বর্তমানে যে চাপাতির রাজনীতি চলছে, এর সঙ্গে কারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনতে সরকারকে বাধ্য করতে হবে। কিংবা অন্য কোনো বিকল্প চিন্তা করতে হবে। তা না হলে একের পর চাপাতির আঘাতে খুন হতেই থাকবে আর সেই সুযোগে বিদেশি ঘাতকরা ঢুকবে এই বাংলায়। রচিত হবে রক্তাক্ত বাংলা, যখন আর কেঁদে-কেটে কাজ হবে না। জীবন বাঁচাতে লিবিয়া, সিরিয়ার মতো আমাদের ছুটতে হবে পরজীবীর বেশে আশ্রয়ের জন্য।
লেখক : সাংবাদিক